ডক চাকে, ময়লার ভাগাড়ে জন্ম নেয়া এক মেটাল ব্যান্ড
ময়লার পাহাড়, খোলা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং চারিদেকে ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থ, এমনই এক স্থানে জন্ম নিয়েছে 'ডক চাকে' নামে একটি মেটাল ব্যান্ড। যার প্রতিটি সদস্য একেকজন চরম দারিদ্র্য আর অবহেলার প্রতীক।
কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনের উপকণ্ঠে এক বিশাল ময়লার ভাগাড় যেন দারিদ্র্যের সবচেয়ে বড় শক্তিশালী প্রতীক হয়ে উঠেছিল। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত যেখানে অনেক মানুষ বাস করতো ।
স্টাং মিঞ্চে নামের এই ময়লার ভাগাড়টি , নমপেনের অনেকের কাছেই ছিল নিজের বাড়ির মতো।
১০০ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত জঞ্জালের পাহাড়। তার মধ্যে থেকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জিনিষ খুঁজে বিক্রি করার জন্য ময়লা ঘেঁটে বেড়াতো প্রায় ২,০০০ নারী, পুরুষ, এবং শিশু।
স্টাং মিঞ্চে ছিল একটি বিপজ্জনক জায়গা। খোলা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং ক্ষতিকর বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে এর আশেপাশে থাকা মানুষেরা অসুস্থ হয়ে পড়তো।
এমনই এক স্থানে জন্ম নিয়েছেন সোক ভিচে, আউচ থেয়ারা এবং আউচ হিং।
"আমাদের দিনের পর দিন কোন খাবার থাকতো না। আমরা কেবল প্লাস্টিকের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সারা শহর ঘুরে ঘুরে ক্যান কুড়াতাম, বিক্রি করার জন্য।,", বলছিলেন ১৮ বছর বয়সী ভিচে।
"প্রখর সূর্যের নীচে কাজ করতে গিয়ে খুব গরম লাগতো কিন্তু আমাদের কাছে খাবার মতো পানি ছিল না। আমরা কখনও স্কুলে যেতে পারিনি। আমাদের আসলে কোন উপায় ছিল না।"
থেয়ারার মা মারা গিয়েছিলেন আগেই এবং তার বাবাও তাকে ছেড়ে চলে যান। তিনি তার খালা এবং তার সাত সন্তানের সাথে স্টাং মিঞ্চেতে বাস করতেন।
ভিচে পাশের বাসায় থাকত এবং সেও তার বাবাকেও হারিয়েছিল। তার মা কয়েক ডলার রোজগারের জন্য প্রতিদিন ময়লা আবর্জনায় ঘেঁটে বেড়াতেন।
শুধু ভিচে বা থেয়ারাই নয়। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০০৭ কম্বোডিয়ার ৪৭% মানুষ দরিদ্রতার মধ্যে জীবনযাপন করতো। যাদের অনেকের দৈনিক এক ডলারেরও কম পয়সায় বেঁচে থাকতে হতো।
থেয়ারা, হিং এবং ভিচে যখন কৈশোরে পা রাখে, তখন তাদের পরিবারের সদস্যরা তাদের জন্য আর থাকা খাওয়ার যোগান দিতে পারছিল না।
এমন অবস্থায় তাদের তিনজনকে স্থানীয় এনজিও মমস এগেইন্সস্ট পভার্টি-এর তত্ত্বাবধানে রাখা হয়।
সেখানেই তাদের পরিচয় হয় সুইস-জার্মান সমাজকর্মী টিমন সেইবেলের সাথে।
নিজেদের পুরো শৈশব ময়লার ভাগাড়ে কেটে যাওয়ায় তারা ভীষণ রেগে থাকতো, এবং তারা সেই ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো না।
"বিশেষত থেয়ারা একদমই রাগ সামলাতে পারতো না," বলেন টিমন।
"তার এই মনোভাবের কারণে অনেক বড় কিছু সে অর্জন করেছে এবং তার যা কিছু আছে বা সে যা কিছু পেতে পারে সেজন্য তাকে লড়াই করতে হয়।"
"বাবা-মা না থাকার দুর্ভাগ্য সত্যই সে কখনই মেনে নিতে পারেনি। যখন সে উন্মাদ হয়ে পড়ে, তখন সে অনেক সক্রিয় এবং হাসিখুশি থাকে। তারপরে সে আবার বিরাট হতাশায় ডুবে যায়। এর মধ্যেই সে খুব রেগে গিয়ে অনেক বড় ধরণের হামলা চালাতো। অন্যান্য বাচ্চাদের সে মারধোর করতো এবং তাদের হুমকি দিতো।"
থেয়ারা একজন থেরাপিস্টের কাছে গেলে তিনি থেয়ারাকে তার বাবাকে খুঁজে বের করার পরামর্শ দেন।
অবশেষে থেয়ারা তার বাবাকে খুঁজেও পান এবং আবিষ্কার করেন যে তিনি একজন ধনী স্থপতি এবং যিনি তার বর্তমান পরিবারের কাছে থেয়ারা সম্পর্কে কখনও কিছু বলেননি।
তার বাবা এরপর তাকে অর্থ দেওয়া শুরু করেন, কিন্তু তারপরে থেয়ারা সিদ্ধান্ত নেয় যে সে তার বাবার সঙ্গে এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চায়।
টিমন এই ছেলেটির ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সব ধরণের চেষ্টা করে গেছে - ফুটবল, ছবি আঁকার ক্লাস -সবকিছুতে যুক্ত করেছেন। তবে লাভের লাভ কিছুই হয়নি।
এক পর্যায়ে টিমন বুঝতে পারছিলেন না তিনি কী করবেন।
টিমন ছিলেন ব্যক্তিগতভাবে মেটাল সংগীতের অনুরাগী।
একদিন তিনি এই ছেলেদের নিয়ে কম্বোডিয়ান হার্ডকোর ব্যান্ড স্লিটেন সিক্স আইএক্সের পারফর্মেন্স দেখতে নমপেনের একটি পানশালায় যান।
ব্যাস, এখানেই কাজ হয়ে যায়।
"আমি সবেমাত্র মঞ্চের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম এটা কোন ধরণের সংগীত?" বলেন ভিচে, "আমি বুঝতে পারছিলাম না তারা কী ধরণের গান করছে। তাদের ড্রামস এবং গিটারের মিউজিক, আমি সত্যি কিছুই বুঝতে পারি নি।"
"তবে শো' শেষ হওয়ার পরে আমরা এই ধরণের সংগীতে আগ্রহী হই, আর এই মিউজিকগুলো বাজানো বেশ সহজ ছিল তাই আমরা জ্যামিং শুরু করি।"
পরে টিমন তাদেরকে স্লিপনট এবং রেইজ এগেইন্সস্ট দ্য মেশিনের বাছাই করা কয়েকটি গানের সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেন।
এবং ছেলেরা তৎক্ষণাৎ এই সঙ্গীতের আক্রমণাত্মক প্রকৃতির বিষয়টি জানতে পারে- অনেক কম্বোডিয়ানদের প্রিয় সংবেদনশীল প্রেমের গানগুলোর চাইতে এই গানগুলো একদমই আলাদা।
"আমি মেটাল বেশি পছন্দ করি কারণ আমরা আমাদের ক্রোধ চিৎকার করে বের করে দিতে পারি এবং আমরা নিজেদের ইচ্ছামতো বাজাতে পারি"- বলেন ভিচে।
"আমরা মিউজিক রুমে যাই, অ্যাম্প চালু করি এবং আমাদের ভেতরে জমে থাকা রাগ বের করে দেই। আমাদের অতীতের জীবন সত্যই খুব কঠিন ছিল" "
তারপরেই এই ছেলেরা একটি ব্যান্ড শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয় - নাম দেয় ডক চাকে। যার অর্থ "কুকুরের মতো"।
অর্থাৎ ব্যান্ডটি এমন একটি নাম রাখতে চেয়েছে যেটা কিনা দরিদ্রতার মধ্যে বসবাসকারী ময়লা কুড়ানি মানুষদের সমাজ কীভাবে অবহেলা করে সেটা প্রতিনিধিত্ব করবে।
তাদের গানের কথাতেও এই বিষয়গুলো উঠে এসেছে। স্থানীয় খামের ভাষায় চিৎকার করে গেয়ে যায় তারা।
-"কারও জীবন আমার মতো নয়,
প্রতিদিন আমি একটা কুকুরের মতো বাঁচি,
আমরা রাস্তায় হেঁটে হেঁটে ,আমাদের খাবারের সন্ধান করি,
আমি যেখানেই বর্জ্য পাই সেখান থেকে তা কুড়িয়ে নেই,
আমি যদি এটি না করতাম, তবে আমি এই জীবনটাও পেতাম না,
আমি এটা করি কারণ আমার বাবা-মা নেই"
________________________________________
ডক চাকে ২০১৫ সাল থেকে নমপেনের আশেপাশে বিভিন্ন শো-তে পারফর্ম করতে শুরু করে এবং কম্বোডিয়ার একমাত্র হার্ড রক রেকর্ড লেবেল 'ইয়াব মং' রেকর্ডস থেকে তাদের একক অ্যালবাম প্রকাশ করে।
সেখানে জায়গা পেয়েছে খাম নেয়া ডক চাকে (কুকুরের মতো একে অপরকে কামড়াও) গানটি।
নিনা রুল, ডক চাকের লাইভ শো দেখে ব্যান্ডটির ভক্ত হয়ে যান।
তিনি একসময় নম পেনে থাকলেও এখন তার জন্মস্থান জার্মানি ফিরে এসেছেন।
"আপনি তাদেরকে দেখতে দর্শকদের ভিড় দেখতে পাবেন: তারা ভীষণ মিষ্টি এবং তারপরে তারা বাজাতে শুরু করে এবং তৎক্ষণাৎ ভেতরের আবহটাই যেন বদলে যায়। সবাই গানের তালে লাফাতে শুরু করে, মাথা দোলাতে থাকে। তাদের প্রতি তখন দৃষ্টিভঙ্গি একদম আলাদা হয়ে যায়।, তিনি বলেন।
"আমি এর আগে মেটাল সংগীত বেশি একটা পছন্দ করতাম না তবে যখন আমি এই ছেলেদের মঞ্চে বাজাতে দেখি, আমি অবাক হয়ে যাই।"
ডক চাকে বিশ্বের মেটাল সংগীত অঙ্গনে ছোট ছোট তরঙ্গ তৈরি করতে শুরু করে।
২০১৮ সালে জার্মানির ওয়্যাকেন ওপেন এয়ারে তাদের পারফর্ম করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
জার্মানির ওই শো-টি হল পৃথিবীর মেটাল উৎবগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়।
তবে জার্মান কর্তৃপক্ষ ব্যান্ডটিকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
তারা বিমানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে- এমন যুক্তিতে ভিসা অস্বীকার করা হয়েছিল। "সাধারণ ভাষায়? তারা খুব গরিব ছিল," টিমন বলে।
মেটাল সম্প্রদায়ের অনেকেই এই সিদ্ধান্তে অনেক ক্ষুব্ধ হয়ে যান এবং ভিসা দেয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়ে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ এ বিষয়ে একটি অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর করেন।
ব্যান্ডটি অবশেষে চলতি বছরের অগাস্টে ভিসা পায় এবং ওয়্যাকেনে হাজারো মানুষের ভিড়ের সামনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে পারফর্ম করে।
"আমি খুব উত্তেজিত ছিলাম," বলেন ব্যান্ডের প্রধান কণ্ঠশিল্পী থেয়ারা, এখন তার বয়স ২০ বছর।
"আমরা আটটি গান বাজানোর পর যখন শেষ করতে যাই তখনও ভিড় থেকে চিৎকার করছিল: 'আরও একটি গান।' 'আরও একটি গান।' তাদেরকে সত্যিই খুশি দেখাচ্ছিল, আর চাইছিল আমরা যেন গেয়ে যাই।
"আমি এর আগে আর কখনও এমনটা দেখিনি। সেখানে অনেক লোক ছিল।"
কম্বোডিয়ান ব্যান্ডগুলোর মধ্যে ডক চাকে দেশের বাইরে এতো বড় শো-তে পারফর্ম করা সত্ত্বেও, দেশটির গণমাধ্যম এতে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি।
"কেউ আমাদের সাক্ষাৎকার নিতে আসেনি, সব নীরব ছিল," থেয়ারা বলেন। "তারা সেই সংগীত পছন্দ করে না, কারণ এই গান খুব দ্রুত লয়ের আর প্রচুর চিৎকার করা হয়েছে। তারা বুঝতে পারেনি।"
ব্যান্ডটি এবার তাদের নেতৃত্বে একটি নতুন ওয়ার্কশপ করার পরিকল্পনা করছে, যা দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা অন্যান্য তরুণ কম্বোডিয়ানদের মেটাল সংগীতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে।
ব্যান্ডটির আশা তাদের এই সঙ্গীত অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করবে। যেভাবে তারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
স্টাং মিঞ্চে ময়লার ভাগার এক দশক আগে বন্ধ হয়ে যায়। যদিও এখনও সেখানে অনেক মানুষ বসবাস করেন এবং কাজ করেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কম্বোডিয়ায় দারিদ্র্য যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। দেশটির দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে এখনও অনেক মানুষ পিছিয়ে আছে।
জার্মানিতে বড় ধরণের সাফল্যের পরও এই ব্যান্ড সদস্যদের কোনভাবে খেয়ে পড়ে থাকতে হচ্ছে।
রিহার্সাল এবং শো-এর বাইরে এখন তারা টুকটাক কাজ করেন অনলাইনে পণ্যদ্রব্য বিক্রি করে রোজগারের চেষ্টা করেন।
ডক চাকে নতুন একটি ইপি রেকর্ড করছে। এবং এটি প্রকাশের পরে তারা ইউরোপ সফরে যাত্রা করতে পারবেন বলে তারা বলে আশাবাদী।
যদিও তারা নিজেদের জন্মভূমিতে অনেকটাই উপেক্ষিত। এখন ইউরোপীয়দের মেটাল সংগীতের প্রতি আকর্ষণ - তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা দেখায়।
আরও পড়তে পারেন:
ধর্ষণ আর হয়রানি: সংগীত জগতের 'অন্ধকারের' গল্প
নজরুল সংগীত তরুণদের কতটা টানছে
সৌদি আরবে র্যাপার নিকি মিনাজের কনসার্ট বাতিল