For Quick Alerts
ALLOW NOTIFICATIONS  
For Daily Alerts
Oneindia App Download

স্বাধীনতার ৫০ বছর: ব্রিটেনের 'তৃতীয় বাংলায়' ১৯৭১-এ 'প্রবাসীদের মুক্তিযুদ্ধ'

উনিশ'শ একাত্তর সালের ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানী সৈন্যদের সামরিক অভিযান চালানোর তিন দিনের মাথায় ৮হাজার কিলোমিটার দূরে ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম শহরে বাংলাদেশের পতাকা উড়েছে।

  • By Bbc Bengali

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রিটেন প্রবাসী বাঙালিদের অবদান নিয়ে লেখা অনেকগুলো স্মৃতিচারণামুলক গ্রন্থের একটির নাম 'তৃতীয় বাংলায় মুক্তিযুদ্ধ।' বইয়ের লেখক লন্ডনে অবসরপ্রাপ্ত চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট মাহমুদ এ রউফ।

কেন তার বাইয়ের এই টাইটেল তিনি দিলেন? এ প্রশ্নে তার যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, "বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার বাইরে ১৯৭১ সালে সবচেয়ে বেশি বাঙালির সংখ্যা ছিল ব্রিটেনে। এবং এখানকার প্রবাসী বাঙালিরা অস্ত্র হাতে না নিলেও স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য তারা যা করেছে তা যুদ্ধের সমান।"

মাহমুদ রউফ হয়তো বইয়ের নাম দেওয়ার সময় আবেগ তাড়িত ছিলেন, কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার পক্ষে এবং একাত্তরে পাকিস্তানী সৈন্যদের হত্যা-নির্যাতনের বিপক্ষে বিশ্বে জনমত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন সে সময়কার ব্রিটেনে পূর্ব বাংলার প্রবাসী বাঙালি জনগোষ্ঠী। অল্প কজন শ্বেতাঙ্গ ইংরেজকেও তারা সাথে পেয়েছিলেন।

ব্রিটিশ এবং ভারতীয় মিডিয়ার সূত্রে ২৫শে মার্চের রাতের নৃশংসতার অস্পষ্ট চিত্র পাওয়ার সাথে সাথেই যে স্বতঃফূর্ত ক্ষোভ প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে তৈরি হয়, তা পরের নয় মাস ধরে সংগঠিত এক আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল।

বিক্ষোভ আর অনশন

প্রবাসী বাঙালি রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র-ছাত্রী, পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী, গৃহবধূ কখনো পৃথকভাবে আবার কখনো সংঘবদ্ধভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে অব্যাহত তৎপরতা চালিয়ে গেছেন।

কনকনে শীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আবার কখনো রাতভর লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করেছেন, অনশন করেছেন। অন্য কাজ ফেলে দলবদ্ধভাবে ব্রিটিশ রাজনৈতিক দলগুলোর অফিসে, বিদেশী দূতাবাসগুলোতে গিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের হত্যা-নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন।

সেই সাথে, শরণার্থীদের জন্য, মুক্তিযোদ্ধাদের এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের জন্য আয়ের একাংশ তুলে দিয়েছেন তারা।

একাত্তরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করেছেন কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশী উজ্জল দাস। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি পশ্চিমা বিশ্বে সমর্থন তৈরিতে ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবদান অসামান্য যার স্বীকৃতি এখনও তারা যথার্থভাবে পাননি।

"একটা কথা হয়ত অনেকেই জানেননা যে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বৈদেশিক মুদ্রা গিয়েছিল ব্রিটিশ বাংলাদেশীদের তোলা চাঁদার অর্থ।" ব্রিটেন থেকে চাঁদা হিসাবে তোলা তিন লাখ ৯২ হাজার পাউন্ড তোলা হয়েছিল যা স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল।

ব্রিটেনে বসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সেই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশ নেয়া মানুষদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছেন তাদের বয়স হয়েছে। কিন্তু এখনও সেই সময়ের কথা তুলতেই তারা গর্বে-আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে এমন কয়েকজনের সাথে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা।

বার্মিংহামে বাংলাদেশের পতাকা

ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধিকার আন্দোলন এবং পরে ১৯৭১ এ স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলনে বিশেষ তৎপর ছিলেন ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বার্মিংহামের প্রবাসী বাঙালিরা।

একাত্তরের দু বছর আগেই বার্মিংহামে 'ইস্ট পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট' নামে এক সংগঠন তৈরি হয়েছিল যেটির নাম বদলে ১৯৭১ এ বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি রাখা হয়।

একাত্তরের ২৫মে মার্চের পরপরই ব্রিটেনে বাঙালিদের সবচেয়ে বড় বিক্ষোভটি হয়েছিল বার্মিংহামে। আঠাশে মার্চ শহরের স্মলহিথ পার্কের সেই জমায়েতে ব্রিটেনের মাটিতে প্রথমবারের মত বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।

প্রবাসী বাঙালি ছাড়াও ১৯৭১ এ স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরির সেই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন পল কোনেট দম্পতি বা গর্ডন স্লাভেনের মত মানবাধিকার কর্মী, এবং জন স্টোনহাউজ এমপি বা পিটার শোর এমপির মত বেশ কজন ব্রিটিশ রাজনীতিক।

স্কুল শিক্ষক রজার গোয়েন

বার্মিংহামের স্কুল শিক্ষকরজার গোয়েন ছিলেন তেমনই একজন।

উনিশ'শএকাত্তরে এ বার্মিংহাম এবং লন্ডনে বাঙালিদের অনেক বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নিয়েছেন তিনি। সে সময়কার সে মিছিল সমাবেশের যেসব ছবি বিভিন্ন বই-পত্রিকায় পরে প্রকাশিত হয়েছে তার অনেকগুলো তার তোলা।

একাত্তর সালে ব্রিটেনে বাঙালিদের তৎপরতা নিয়ে একটি বইও লিখেছেন তিনি।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি রজার গোয়েনের সমর্থন সহমর্মীতার একটি ইতিহাস অবশ্য রয়েছে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি বছর দুয়েক একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করেছেন তিনি। পরে দেশে ফিরে যখন বার্মিংহামে স্কুল শিক্ষক হিসাবে পেশা শুরু করেন তখন একটি বাঙালি পরিবারে দুই বছর লজিং ছিলেন।

বাংলাও বলতে পারতেন, ফলে বার্মিংহামের বাঙালি সমাজের সাথে তার জানাশোনা ওঠবস ছিল।

উনিশ'শ একাত্তর সালের ২৮শে মার্চ বার্মিংহামের স্মলহিথ পার্কে বাঙালিদের যে বিক্ষোভ সমাবেশে প্রথমবারের মত ব্রিটেনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয় সেখানে ছিলেন রজার গোয়েন ।

বার্মিংহাম থেকে টেলিফোনে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, "পার্ক ভর্তি মানুষ ছিল সেদিন। তাদের চোখে মুখে কণ্ঠে ছিল প্রচণ্ড আবেগ, সেই সাথে দেশে স্বজনদের ভাগ্যে কি হচ্ছে তা নিয়ে ছিল উদ্বেগ। "

জ্বালাময়ী বক্তা বদরুন নেসা

জগলুল পাশা নামে বার্মিংহামের এক বাসিন্দা, যিনি পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে সে সময় বাঙালিদের মধ্যে খুব পরিচিত মুখ ছিলেন, তিনিই ছিলেন ঐ বিক্ষোভ সমাবেশের প্রধান আয়োজক। তাকে এবং তার স্ত্রী বদরুন নেসা পাশাকে চিনতেন রজার গোয়েন।

"একটা মঞ্চ মতো করা হয়েছিল সেখানে লাউড স্পিকারে ভাষণ চলছিল। অনেকে ভাষণ দিয়েছিলেন তবে সবচেয়ে আবেগী এবং জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছিলেন জগলুল পাশার স্ত্রী বদরুন নেসা । নিজের সব গহনা বাংলাদেশের জন্য দান করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। অন্যদেরকেও উৎসাহিত করছিলেন।"

সংঘর্ষ এবং রক্তপাত হয়েছিল ঐ সমাবেশে, কারণ বার্মিংহামের অভিবাসীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীরা। তাদের একদলের সাথে সমাবেশে উপস্থিতি বাঙালিদের একাংশের প্রথমে কথা কাটকাটি এবং পরে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়। বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল।

রজার গোয়েন বলেন, পুরো একাত্তর জুড়েই বার্মিংহামের কিছু এলাকায় চাপা উত্তেজনা ছিল। "অনেক কারখানায় দুই পাকিস্তানের লোকজনই কাজ করতো। সে সব জায়গায় বেশ উত্তেজনা ছিল।"

ট্রাফালগার স্কয়ারে সমাবেশ

আঠারোই এপ্রিল লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে পাকিস্তানী সেনা অভিযানের বিরুদ্ধে যে মিছিল-জমায়েত হয়েছিল সেখানে বার্মিংহামের বাঙালিদের সঙ্গী হয়ে বাসে চেপে এসেছিলেন রজার গোয়েন। সারা ব্রিটেন থেকে কোচ ভর্তি করে বাঙালিরা যোগ দিয়েছিলেন ঐ মিছিলে। অনেক ছবি তুলেছিলেন।

ট্রাফালগার স্কয়ারের সেই মিছিল-সমাবেশের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মি গোয়েন বলেন, "ব্রিটেনে বোধ হয় এর আগে অন্য কোনো একটি দেশের মানুষের এত বড় মিছিল-সমাবেশ হয়নি। মানুষজন বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল।। অসামান্য মুহূর্ত ছিল সেসব।"

তিনি বলেন, বাঙালিদের ঐ সমাবেশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্রিটিশ প্রেস এবং রাজনীতিকদের মনোযোগ এবং সহমর্মীতা আদায়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে আবার স্বাধীন বাংলাদেশে স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করতে গিয়েছিলেন রজার গোয়েন। উনিশ'শ পচাত্তর সালের ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ড এবং সেনা অভ্যুত্থানের এক সপ্তাহ আগে তিনি দেশে ফেরেন।

ফিরে এসে বার্মিংহামে বাঙালিদের মধ্যে সমাজকর্মী হিসাবে কাজ শুরু করেন। অভিবাসন সংক্রান্ত নানা কাজে বাঙালিদের সাহায্য করতেন। বাঙালি পরিবারের ছেলেমেয়েদের টিউশন দিতেন। পরের ২০ বছর ঐ কাজই করেছেন তিনি।

.
BBC
.

যে বৈষম্যের কারণে বাঙালিরা পাকিস্তান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়

ছয় দফা ঘোষণা করে যেভাবে নেতা হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব

ভুট্টো যেভাবে পাকিস্তানে ক্ষমতার ভাগ চেয়েছিলেন

পঁচিশে মার্চের হত্যাযজ্ঞের পর যেভাবে এল স্বাধীনতার ঘোষণা

ইন্দিরা গান্ধী যেদিন তাজউদ্দীনকে প্রবাসে সরকার গঠনের পরামর্শ দিলেন

ভারতে বসে যেভাবে কাজ করেছে মুজিবনগর সরকার


পঞ্চাশ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশ কেমন করেছে? এই প্রশ্নে ৭৯ বছরের মি. গোয়েন বিবিসিকে বলেন, "বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক ভালো করেছে। প্রশংসা করার মত। বাংলাদেশী দ্বিতীয়- তৃতীয় প্রজন্ম ব্রিটিশ সমাজ এবং অর্থনীতিতে অনেক অবদান রাখছে।"

কিন্তু, তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের পর থেকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির রাস্তাটা "বাঁকা " হয়ে গেছে। "ঐ ধাক্কা আর কাটেনি। রাজনীতিতে সহিংসতা ঢুকেছে। গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রের যে আকাঙ্ক্ষা বাঙালির ছিল সেটি দুঃখজনক ভাবে সেভাবে এগুতে পারেনি। তবে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের যাত্রা ইতিবাচক। সবচেয়ে বড় কথা সাধারণ মানুষের অভাব কমেছে।"

টার্গেট পাক দূতাবাস এবং সুলতান শরিফ

ব্রিটেনে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে তৎপরতার নেতৃত্বে থাকা যে কয়েক ডজন মানুষের নাম ঘুরেফিরে উচ্চারিত হয় তাদের অন্যতম সুলতান মাহমুদ শরীফ এবং তার প্রয়াত স্ত্রী নোরা শরীফ।

সুলতান শরীফ ১৯৬৩ সালে ব্রিটেনে ছাত্র হিসাবে আসার আগে থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। এই বয়সে এখনও তিনি ইউকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট।

তৎকালীন পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে লন্ডনে বাঙালিদের তৎপরতার পুরোভাগে ছিলেন সুলতান শরীফ এবং সেই সময় নিয়ে বিস্তর স্মৃতি রয়েছে তার। সুযোগে এখনও তিনি সেসব স্মৃতি হাতড়ান।

বিবিসিকে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ছয় দফা আন্দোলনের সাথে তাল মিলিয়ে একাত্তরের অনেক আগে থেকেই ব্রিটেনে বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পড়তে আসা ছাত্র সমাজ রাজনৈতিকভাবে তৎপর ছিল।

"আমাদের সেই আন্দোলন ছিল পাকিস্তানে গণতন্ত্রের আন্দোলন, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন। সেই আন্দোলনে শুধু বাঙালি নয় পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশে থেকে পড়তে আসা ছাত্রদেরও অংশগ্রহণ ছিল।"

সুলতান শরীফ বলেন, গণতন্ত্রের সেই আন্দোলনে তাদের বিক্ষোভ দেখানোর, দাবি জানানোর প্রধান টার্গেট ছিল লন্ডনে নাইটস ব্রিজ এলাকায় পাকিস্তান দূতাবাস।

তিনি বলেন ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি এবং কয়েকজন পাকিস্তানী দূতাবাসে ঢুকে ব্যালকনিতে কালো পতাকা টাঙিয়ে দিয়েছিলেন যে ছবি লন্ডনের দৈনিক দি টাইমসে ছাপ হয়েছিল।

"আমরা তখন বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলতাম । হাই কমিশনে বাঙালি অফিসার নিয়োগের কথা বলতাম। এই সব দাবি নিয়ে মাঝে মধ্যেই হাই-কমিশনের সামনে গিয়ে হৈচৈ করে স্মারকলিপি দিয়ে আসতাম," মি. শরিফ বলেন।

পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকারের নেতারা ব্রিটেনে এলেই তারা গিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করতেন।

"সত্তর এর জুলাইতে ইয়াহিয়া খান লন্ডন হয়ে ওয়াশিংটন যাচ্ছিলেন। খবর পেয়ে আমরা জনা পঞ্চাশ বাঙালি ক্ল্যারিজ হোটেলের উল্টোদিকে অবস্থান নিয়ে স্লোগান তুললাম 'ডাউন উইথ ইয়াহিয়া। ডাউন উইথ ডিক্টেটরশিপ, উই ওয়ান্ট ডেমোক্র্যাসি'।

''একসময় ইয়াহিয়া খান নিজে বেরিয়ে এসেছিলেন। মনে আছে আমাদের স্লোগানের সামনে ক্রদ্ধ হয়ে তিনি বলেছিলেন 'আই উইল প্রটেক্ট পাকিস্তান অ্যান্ড ইসলাম উইথ মাই ব্লাড (আমি রক্ত দিয়ে পাকিস্তান এবং ইসলাম রক্ষা করবো)।"

সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের ফল মানা টালবাহানা নিয়ে দেশের ভেতর বাঙালিদের ক্ষোভের প্রতিফলন ব্রিটেনের বাঙালিদের মধ্যে সংক্রমিত হচ্ছিল।

মি শরিফ বলেন দেশের অবস্থার পরিস্থিতি বিচার করে ১৯৭১ সালে লন্ডনে খুব বড় পরিসরে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। "আগে আমরা স্লোগান দিতাম 'জাগো বাঙালি জাগো।' শুরু হলো 'জেগেছে বাঙালি জেগেছে' স্লোগান।"

জয় বাংলা নিয়ে আপত্তি

ইয়াহিয়া খান নতুন পার্লামেন্ট বসতে দেবেন কি দেবেন না এই অনিশ্চয়তার মধ্যে একদল বাঙালি ২৮শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান দূতাবাসে সামনে বিক্ষোভে 'জয় বাংলা' স্লোগান দেয়। সুলতান শরীফ বলেন, "গণতন্ত্র-পন্থী অনেক পশ্চিম পাকিস্তানী ছাত্রও ছিল ঐ বিক্ষোভে। জয় বাংলা স্লোগানে তারা কয়েকজন আপত্তি তুলেছিল। অবশ্য পহেলা মার্চ থেকেই জয় বাংলা স্লোগান একমাত্র স্লোগানে পরিণত হতে শুরু করে।"

সে সময়কার অনেক স্মৃতি রয়েছে সুলতান শরীফের।

মার্চের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানো ঘটনা, ২৫শে মার্চের গভীর রাতে ফ্লিট স্ট্রিটের পত্রিকায় পত্রিকায় গিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের নৃশংসতা নিয়ে লিখিত বিবৃতি দেওয়া, এবং পরপরই ২৬ এবং ২৮শে মার্চ বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির ব্যানারে টাইমস পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপানোর পেছনে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা ছিল তার।

"ঐ বিজ্ঞাপনে আমরা লিখেছিলাম 'আওয়ার পিপল আর বিয়িং বুচার্ড, সাপোর্ট আস (আমাদের মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে। আমাদের সমর্থন করুন)। ঐ বিজ্ঞাপন এদেশের মানুষের নজর কেড়েছিল। তারা জানতে পেরেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্যরা গণহত্যা করছে," মি. শরিফ বলেন।

লন্ডনের রাজপথে বাঙালি নারী

উনিশ'শ একাত্তর সালে ব্রিটেনে প্রবাসী বাঙালি নারীরা বাংলাদেশ উইমেনস আ্যাসোসিয়েশন গঠন করে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে নানা তৎপরতা শুরু করেছিলেন। তেসরা এপ্রিল লন্ডনে শাড়ি পরা কয়েকশ বাঙালি নারী পোস্টার, প্ল্যাকার্ড হাতে মিছিল করেছিলেন যে দৃশ্য ছিল লন্ডনে বিরল।

বাঙালি নারীদের ঐ মিছিল নিয়ে মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান তার 'বৃটেনে বাংলাদেশী' বইতে লিখেছেন, " ১৯৭১ সালের ৩রা এপ্রিল শনিবার। সকাল বেলা লন্ডনের টেমস নদীর পাড় চেয়ারিং ক্রস এমব্যাংকমেন্টে দাঁড়িয়ে আছেন প্রায় ৩শ বাঙালি মহিলা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে। পথচারীরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন।

''প্ল্যাকার্ডের একদিকে বাংলায় এবং অন্যদিকে ইংরেজিতে লেখা স্টপ জেনোসাইড, রিকগনাইজ বাংলাদেশ...। 'আমার দেশ তোমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশে স্লোগান দিয়ে তারা চললো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের দিকে .... প্রবাসে বঙ্গনারীদের এই প্রথম মিছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সূচনা করেছিল নতুন এক অধ্যায়ের।"

গ্যাঞ্জেস রেস্তঁরাএবং গুলনাহার খান

উনিশ'শ একাত্তর সালের ৩রা এপ্রিলের ঐ মিছিলে ছিলেন গুলনাহার খান। উনিশ'শ তেষট্টি সালে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে লাইফ সায়েন্স পড়তে এসেছিলেন। উনিশ'শ একাত্তর সালে ছাত্রত্ব শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে কাজ করতেন।

বিবিসিকে তিনি বলেন, "ঐ মিছিলের কথা জীবনে ভোলার নয়। সে এক অন্য আবেগ। অনেক ইংরেজ নারী আমাদের সাথে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করছিলেন কেন আমরা মিছিল করছি। তাদের অনেকে আমাদের সাথে সাথে হাঁটছিলেন।"

রাজনীতির সাথে কোনো যোগাযোগ ছিলনা গুলনাহার খানের, কিন্তু পরিচিত বা বন্ধুদের সাথে আড্ডায় দেশের পরিস্থিতি নিয়েই কথা হতো বেশি। "তারপর ১৯৭১ এ পুরোপুরি সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। মার্চ থেকে ধ্যান-জ্ঞানই ছিল কিভাবে আমরা কি করবো যাতে পাকিস্তানীরা আমাদের ক্ষোভ টের পায়।"

উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃত্ব পর্যায়ে না থাকলে সমমনা কয়েকজনের সাথে ঐ সমিতির ডাকা বিভিন্ন কর্মসূচিতে স্বতঃফূর্তভাবে অংশ নিতেন গুলনাহার খান।

ইউনিভার্সিটির ল্যাবে কাজ করতেন। কাজের সময়টা বাদে অন্যদের সাথে রাস্তার মোড়ে, পার্কে জড় হয়ে পরদিন কি করা হবে তা নিয়েই পরিকল্পনা হতো। রাত জেগে পোস্টার লিখতেন। বেতনের অনেক টাকা বাংলাদেশের জন্য চাঁদা দিয়েছেন।

"পিকাডেলি সার্কাসের কাছে গ্যাঞ্জেস নামে একটি বাংলাদেশি রেস্তঁরা ছিল আমাদের বৈঠকের আরেকটি জায়গা। রেস্তোঁরার মালিক তাসাদ্দুক হোসেন দরাজ মনের লোক ছিলেন। দুপুর বা সন্ধ্যায় ব্যবসার ব্যস্ত সময়টা বাদে রেস্তঁরা আমাদের দখলে চলে যেত। অনেকদিন গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে বসেই পরের দিনের বিক্ষোভের পোস্টার লিখেছি। তাসাদ্দুক ভাই খাওয়ারও জোগান দিতেন। "

'হাই কমিশনারের গাড়িতে আগুন'

পুরো একাত্তর জুড়ে লন্ডনে পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে নিয়মিত বিক্ষোভ হতো। সেখানে প্রায়ই যেতেন গুলনাহার খান। একদিন হাই কমিশনের দারোয়ান এবং অন্যান্য স্টাফরা আচমকা বিক্ষোভের ওপর চড়াও হয়েছিল।

"হাই কমিশনের স্টাফ, দারোয়ানরা প্রায়ই উর্দুতে আমাদের গালিগালাজ করতো। একদিন হামলা করে বসলো। একজন পায়ের জুতো খুলে আমাকে পিটিয়েছিল। রাগে আমরা পরিকল্পনা করেছিলাম হাই কমিশনারের গাড়িতে আগুন দেব। গাড়িটা রাস্তায় পার্ক করা থাকতো। আমরা চিনতাম। পরে অবশ্য মামলার ভয়ে আর তা করিনি।"

"এসব কাজ যখন করতাম ভয় যে একেবারে ছিলনা তা নয়। ভয় পেতাম আর দেশে ফেরা হবে কিনা। কিন্তু সেই ভয় আমাদের নিরস্ত করতে পারেনি।"

আইয়ুব-এর পতন এবং মাহমুদ এ রউফ

উনিশ'শ একাত্তর সালে ব্রিটেনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্দোলনের সামনের সারীর আরেক নাম ছিল মাহমুদ এ রউফ।

চুয়াত্তর বছরের সাবেক এই চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট এখন লন্ডনে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন, কিন্তু একাত্তরে তিনি ছিলেন টগবগে যুবক, ছাত্র এবং রাজনৈতিক কর্মী।

উনিশ'শ আটষট্টি সালে অ্যাকাউনটেন্সি পড়তে লন্ডনে আসার পর থেকে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে যান। দেশে বাম ধরার ছাত্র রাজনীতি করতেন, ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত ছিলেন।। ফলে ব্রিটেনে এসেই সমমনা লোকজনের সাথে ভিড়ে যান।

বিবিসিকে তিনি বলেন, "১৯৭১ এর আগে লন্ডনে আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের প্রধান ইস্যু ছিল পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা। ক্লাসের পর প্রায় প্রতিদিনই সেন্ট্রাল লন্ডনের হোবর্ন, চ্যান্সারি লেন এলাকার কোনো খোলা জায়গায় বা পার্কে আমরা কয়েকজন জড় হতাম। তারপর চলতো কীভাবে পাকিস্তানে গণতন্ত্র আনা যায় তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ।"

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মি রউফ জানালেন ১৯৬৯ সালের ২০শে জানুয়ারি যখন তারা খবর পান যে আইয়ুব খান পদত্যাগ করেছেন, তারা রাস্তায় নেমে উল্লাস করেছিলেন।

এরপর ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরুর পরপরই এপ্রিলে যখন ব্রিটেনে বাংলাদেশে স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি তৈরি হয়, ঘনিষ্ঠভাবে তিনি যুক্ত হন তার সাথে। আন্দোলন কর্মসূচির পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে সামনের সারীর কর্মী ছিলেন মাহমুদ রউফ। একাত্তরে ব্রিটেনে বাঙালিদের আন্দোলনের সেই ইতিহাস নিয়ে 'তৃতীয় বাংলায় মুক্তিযুদ্ধ' নামে একটি বই লিখেছেন তিনি।

মি রউফ বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে সহানুভূতি-সমর্থন আদায়ে ব্রিটেনের রাজনৈতিক এবং ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের কাছে যারা যেতেন তিনি ছিলেন তাদের একজন।

"লেবার পার্টির একটি অংশ খুবই সহানুভূতিশীল ছিল। ট্রেড ইউনিয়নগুলো অনেক সহানুভূতি দেখাতো,'' তিনি বলেন।

''বিশেষ করে টাইমস পত্রিকায় যখন বাংলাদেশে সেনা নির্যাতন নিয়ে অ্যান্থনি ম্যাসকারানাসের রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় তারপর থেকে ব্রিটেনে বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতি অনেক বেড়ে গিয়েছিল।"

কিছু কিছু ঘটনা এখনও মাহমুদ রউফের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে। তার একটি হলো গণ সাংস্কৃতিক সংসদের ব্যানারে 'অস্ত্র হাতে তুলে নাও' নামে একটি গীতিনাট্য নিয়ে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে গিয়ে তার মঞ্চায়ন। "প্রচুর বাঙালি দেখতে আসতেন। টিকেট বিক্রি করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য চাঁদা তোলা হতো।"

"বাঙালিরা প্রচণ্ড আবেগ-তাড়িত হয়ে পড়েছিল। এমন অভিজ্ঞতাও আমার হয়েছে যে কারখানার একজন মাঝবয়সী শ্রমিক তার শুক্রবারের মজুরীর পুরোটা আমাদের হাতে তুলে দিয়ে আমাদের বলছে বাবারা তোমরা একটা কিছু করো।"

পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের 'শান্তিতে থাকতে দেইনি'

যে আরেকটি পর্ব কখনই ভোলেননি মি রউফ তা হলো যুদ্ধ চলার সময় সফরকারী পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ম্যাচের সময় মাঠের বাইরে গিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন।

"সম্ভবত জুন মাসে পাকিস্তান দল সিরিজ খেলতে ইংল্যান্ডে আসে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যেখানে খেলা হবে আমরা গিয়ে বিক্ষোভ করবো,'' তিনি বলেন।

''লর্ডস, ওভাল ছাড়াও কোচ ভাড়া করে বার্মিংহামেও গেছি প্রতিবাদ করতে। প্ল্যাকার্ড নিয়ে মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিয়েছি। তাদের শান্তিতে থাকতে দেইনি।"

বড় কোনো বাঁধার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের? এই প্রশ্নে তিনি বলেন, "ঝুঁকি তো একটা ছিলই।''

''আমরা শুনেছি পাকিস্তান হাই কমিশনে আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা বাঙালিদের একটি তালিকা তৈরি হয়েছে। যদি বাংলাদেশে স্বাধীন না হতো, আর হয়তো দেশে ফেরাই হতোনা। তবে সেসময় আমরা তোয়াক্কা করিনি,'' মি. রউফ বলেন।

English summary
50 years of independence: Britain's 'Third Bengal' in 1971 'Expatriate Liberation War'
চটজলদি খবরের আপডেট পান
Enable
x
Notification Settings X
Time Settings
Done
Clear Notification X
Do you want to clear all the notifications from your inbox?
Settings X