১৯১৮-২০১৩: ম্যান্ডেলার সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্ত
১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ রাজ্যের ভেজো গ্রামে জন্ম হয় নেলসন ম্যান্ডেলার। বাবা-মা নিরক্ষর হলেও ছেলেকে দীক্ষিত করেছিলেন মানবিক মূল্যবোধে। ক্লার্কবেরি বোর্ডিং ইন্সটিটিউট থেকে মাধ্যমিক স্তরের পড়াশুনো শেষ করে তিনি ভর্তি হন ফোর্ট বোফোর্টের একটি কলেজে। এখানকার অধ্যক্ষ ছাত্রদের শ্বেতাঙ্গ সভ্যতার আভিজাত্য সম্পর্কে বোঝাতেন। প্রথম প্রতিবাদ করেন তরুণ ম্যান্ডেলা। ইতিহাস ঘেঁটে তিনি পাল্টা যুক্তি দেন, মানবসভ্যতার পথ চলা শুরু প্রাচীন আফ্রিকা থেকেই। এর ফলে তাঁকে কর্তৃপক্ষের বিষ নজরে পড়তে হয়। এই সময় থেকে শরীরচর্চা, মুষ্টিযুদ্ধ, উদ্যানপালন ইত্যাদি কাজে তিনি নিজেকে ডুবিয়ে দেন। ভালো রাগবি খেলতেন।
১৯৪১ সালে জোহানেসবার্গে এসে এক ইংরেজ সাহেবের কোম্পানিতে দ্বাররক্ষীর চাকরি নেন। এখানে তিনি দেখেছিলেন কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের দুর্ব্যবহার। একই পদে কাজ করা সত্ত্বেও একজন শ্বেতাঙ্গ যা বেতন পেত, তার থেকে একজন কৃষ্ণাঙ্গ বেতন পেত অনেক কম। কালো চামড়ার লোকেদের খাটানো হত অনেক বেশি সময় ধরে। এর প্রতিবাদ করায় চাকরি যায় তাঁর। কিছুদিন পরে আলাপ হয় ওয়াল্টার সিসুলুর সঙ্গে। এই লোকটি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। এঁর সাহায্যেই করণিকের চাকরি পান নেলসন ম্যান্ডেলা। এএনসি-র অফিসে যাতায়াত শুরু হয়, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে ওই দলে তখনও যুক্ত হননি তিনি। চাকরি করতে করতে ১৯৪৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
এরপর আইন নিয়ে পড়াশুনো শুরু করেন তিনি। ১৯৪৩ সালে এএনসি-র যুব শাখা তৈরি হলে নেলসন ম্যান্ডেলা তার কর্মসমিতিতে নিজের জায়গা করে নেন। শুধু হয় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই। ১৯৪৪ সালের অক্টোবরে তিনি বিবাহ করেন। দেশের আইন অনুসারে, ১৯৪৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে শুধু শ্বেতাঙ্গরাই ভোট দেন। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন ম্যান্ডেলা। এর জেরে আইনের পরীক্ষায় তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবে পাশ করানো হয়নি। ১৯৫৮ সালে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন তিনি। তার আগে প্রথম স্ত্রীয়ের সঙ্গে দীর্ঘ বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা চলে। তাতে অবশ্য তাঁর জনপ্রিয়তার বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। তাঁর দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস এ সময় বিচ্ছিন্নভাবে হিংসাত্মক আন্দোলনও শুরু করে।
১৯৬২ সালে শেষ পর্যন্ত নেলসন ম্যান্ডেলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা, ধর্মঘটে প্ররোচনা দেওয়া ইত্যাদি অভিযোগ আনা হয়। শুরু হয় কুখ্যাত 'রিভোনিয়া' বিচারপর্ব। আন্তর্জাতিক মহলের অনুরোধ উপেক্ষা করে তাঁকে আমরণ কারাবাসের সাজা দেওয়া হয়। ১৯৬৪ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত, দীর্ঘ ১৮ বছর তাঁকে রোবেন দ্বীপে একটি নির্জন সেলে বন্দী করে রাখা হয়। অমানুষিক পরিবেশে সেখানে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল নেলসন ম্যান্ডেলাকে। নিয়মিত চলত শারীরিক অত্যাচার।
এরপর আরও দু'টো কারাগারে স্থানান্তরিত করা হয় তাঁকে। জেলের নোংরা সেলে থাকতে থাকতে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন তিনি। শেষ পর্যন্ত ঘরোয়া আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে ১৯৯০ সালে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৯৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে সর্বজনীন ভোটাধিকার স্বীকৃতি পায়। এই প্রথম দেশের ভাগ্য নির্ণয়ে শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে এক সারিতে দাঁড়িয়ে ভোট দেয় কৃষ্ণাঙ্গরাও। ওই বছরই দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি পদে বসেন তিনি। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা ভোগ করেন। ১৯৯৮ সালে ৮০ বছর বয়সে বান্ধবী গ্রাকাকে বিবাহ করেন ম্যান্ডেলা। রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পরও নানা কাজে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ৫ ডিসেম্বর রাত ন'টায় জীবনাবসান হল এই বর্ণময় পুরুষের।