বিমস্টেক সামিটের শেষ দিনে সাক্ষরিত হয়েছে কাঠমান্ডু ডিক্লেরেশন, কী আছে এই ঘোষণাপত্রে
কাঠমান্ডু ডিক্লেরেশন স্বাক্ষরের মাধ্যমে শেষ হয়েছে চতুর্থ বিমস্টেক সম্মেলন। সেখানে এই ১৮ পয়েন্ট উল্লেখ করা হয়েছে।
শুক্রবার নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে শেষ হয়েছে চতুর্থ বিমস্টেক সামিট, অর্থাত বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টোরাল টেকনিকাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোয়াপারেশন সামিট। সামিটের শেষদিনে ১৮ দফার কাঠমান্ডু ডিক্লেরেশন সাক্ষরিত হয়। এই ডেক্লারেশন এই অঞ্চলে বিভিন্ন টেকনিকাল ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করাপ মাধ্যমে বিমস্টেক সেক্রেটারিয়েটের কার্যকারিতা বাড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। কি আছে এই ডিক্লেরেশন-এ?
১. ১৯৯৭ সালের ব্যাঙ্কক ডেক্লারেশন প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঠিক হয়েছে বিমস্টেকের দেশগুলি পরস্পরকে সাহায্য করার ভিত্তি হবে সার্বভৌম সমতার নীতি, আঞ্চলিক সংহতি, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং পারস্পরিক সুবিধা।
২. বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলকে শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও টেকসই করে তোলার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ব্যাঙ্কক ডিক্লারেশনে বর্ণিত বিমস্টেকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য উপলব্ধি করার প্রচেষ্টাকে আরও বাড়াতে সম্মত হওয়ার পাশাপাশি বিমস্টেককে শক্তিশালী, আরো কার্যকরী ও ফলপ্রসু সংগঠন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
৩. দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মধ্যে একটি সেতু হিসাবে বিমস্টেকের অনন্য অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের স্তরকে উন্নত করা, এবং এই অঞ্চলের শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যে, সংগঠনটিকে একটি কার্যকরি প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত করার জন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সহযোগিতা আরও দৃঢ় ও গভীর করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে দেশগুলি।
৪. বিমস্টেকের দেশগুলি সহ বিশ্বের সকল অংশে সন্ত্রাসবাদী হামলা এবং যেখানেই হোক, যারাই করুক সকল প্রকার সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করা এবং সন্ত্রাসবাদী কর্যকলাপের পেছনে কোনও যুক্তি থাকতে পারে না বলে সম্মত হয়েছে দেশগুলি। বলা হয়েছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই মানে শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদী, সন্ত্রাসবাদী সংগঠন এবং নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে লড়াই নয়। যেসব রাষ্ট্র এবং সংস্থা সন্ত্রাসবাদকে উৎসাহ, সমর্থন বা অর্থায়ন করে, সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলিকে নিরাপদ আশ্রয় দেয় এবং তাদের ভুয়ো গুণগান করে তাদের চিহ্নিত করে জবাবদিহি চাওয়া হবে। সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া এবং সন্ত্রাসবাদীদের অর্থায়ন রোধ করা এবং দেশগুলির নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলিতে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করা, সন্ত্রাসবাদীদের নিয়োগ এবং সীমান্ত পেরিয়ে করা আন্দোলনকে রোধ করা, র্যাডিকালাইজেশন প্রতিহত করা, সন্ত্রাসের উদ্দেশ্যে ইন্টারনেটের অপব্যবহার এবং সন্ত্রাসবাদীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ধ্বংস করার বিষয়ে একটি ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি প্রণয়ন করতে সকল দেশকে আহ্বান জানান হয়েছে।
৫. রাষ্ট্রসংঘের চার্টারের নীতি ও উদ্দেশ্যসমূহের উপর দ্ব্যর্থহীনভাবে বিশ্বাস রাখা এবং সমসাময়িক গ্লোবাল চ্যালেঞ্জগুলির প্রেক্ষিতে এই বহুজাতিক ব্যবস্থাকে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে এর নিয়মাবলী, প্রতিষ্ঠানগুলি ও ইনস্ট্রুমেন্টগুলি সংস্কারের মাধ্যমে একে শক্তিশালী করার চেষ্টা করা এবং সম্মিলিত স্বার্থরক্ষার্থে একটি ন্যায্য, ন্যায়পরায়ণ, নিয়ম-ভিত্তিক, ন্যায়সঙ্গত ও স্বচ্ছ পৃথিবীর জন্য যৌথস্বর গড়তে একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছে দেশগুলি।
এরজন্য ১৩ দফা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কথা বলা হয়েছে কাঠমান্ডু ডিক্লেরেশনে।
১. বিমস্টেক সেক্রেটারিয়েটকে ১৯৯৭ সালের ব্যাঙ্কক ঘোষণার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠানটির চার্টারের একটি প্রাথমিক খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সহযোগিতার জন্য দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিভিন্ন স্তরের ভূমিকা এবং দায়িত্বসমূহকে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা এবং কোন পদ্ধতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ হবে তা জানাতে হবে ওই খসড়ায়। পঞ্চম শীর্ষ সম্মেলনের আগেই এই খসড়া গ্রহণ করার লক্ষ্যে বিমস্টেকের স্থায়ী ওয়ার্কিং কমিটি (বিপিডব্লিউসি) এবং প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য উচ্চতর সংস্থাগুলি সেই খসড়া বিবেচনা করবে। বিমসপিডব্লিউসি-কেই বিমস্টেকের রুলস অফ প্রসিডিওর (আরওপি) তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
২. বিমস্টেক সেক্রেটারিয়েট ও বিমস্টেক কেন্দ্র ও সংস্থার প্রশাসনিক ও আর্থিক বিষয়াদি দেখা, পাশাপাশি মিটিং এর সময়সূচী প্রস্তুত, অগ্রাধিকার এবং প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বাগ করে দেওয়ার জন্য বিমস্টেকের একটি স্থায়ী কার্যনির্বাহী কমিটি প্রতিষ্ঠা করার কথা ঠিক হয়েছে।
৩. উপযুক্ত সময়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলির স্বেচ্ছাবদানে বিমস্টেক উন্নয়ন তহবিল (বিডিএফ) গড়া যায় কিনা, তার সম্ভাবনা যাচাই করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির প্রাসঙ্গিক মন্ত্রক বা জাতীয় সংস্থাগুলিকে। এই তহবিল সদস্য রাষ্ট্রগুলির সম্মতিক্রমে বিমস্টেকের গবেষণা ও পরিকল্পনা এবং প্রকল্প ও অন্যান্য কার্যক্রমের অর্থায়নে ব্যবহার করা হবে।
৪. আর্থিক ও মানব সম্পদগুলির মাধ্যমে বিমস্টেক সেক্রেটারিয়েটের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে বিমস্টেকের কার্যক্রম ও কর্মসূচির বাস্তবায়নে সমন্বয়, নিরীক্ষণ এবং সহজতর করতে সক্ষম হবে সেক্রেটারিয়েট। সদস্য রাষ্ট্রগুলির সম্মতিতে প্রকল্পের প্রস্তাবনা শুরু করার পাশাপাশি এটি অন্যান্য দায়িত্ব কার্যকর করতে পারবে। সেইসঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্র থেকে প্রতিনিধি নিয়ে ডিরেক্টরের সংখ্যা বাড়িয়ে সাতজন করা হবে।
৫. সাধারণ স্বার্থের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে প্রয়োজনমতো সম অবস্থান নিয়ে ও আন্তর্জাতিক বহুরাষ্ট্র সংগঠন ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে গোষ্ঠী পরিচয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মহলে বিমস্টেকের পরিচিতি ও মর্যাদা বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
৬. সহযোগিতার মূল ক্ষেত্রে অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা, বিমস্টেক সহযোগিতার বিদ্যমান এলাকাগুলির পর্যালোচনা, পুনর্গঠন এবং যুক্তিসঙ্গতকরণ এবং কার্যক্রমের বাস্তবায়ন, প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়নের মাধ্যমে ফলাফল লাভ করার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিমস্টেক সহযোগিতার স্তম্ভগুলিকে ঢেলে সাজিয়ে পাঁচটি স্তম্ভের দিকে অগ্রসর হওয়ার যে ধারণা থাইল্যান্ড দিয়েছে তাকে স্বাগত জানান হয়েছে। তবে এনিয়ে বিমস্টেক স্থায়ী কার্যনির্বাহী কমিটিতে আরও আলোচনা করা হবে।
৭. অভ্যন্তরীণ অনুমোদনের প্রক্রিয়ার জন্য যেসব আইনি নথি এবং ইনস্টুমেন্ট চুড়ান্ত হওয়া বাকি আছে, সেগুলিকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে সম্মত হয়েছে রাষ্ট্রগুলি।
৮. বিভিন্ন সেক্টরে অগ্রগতির জন্য এগিয়ে থাকা দেশগুলির ভূমিকাকে প্রশংসা করা হয়েছে এবং তাদের সেই প্রয়াসকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে।
৯. বিমস্টেকের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল সুমিত নাকান্দলার মূল্যবান অবদানের জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে এবং বিমস্টেকের নতুন সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে বাংলাদেশের এম. শহীদুল ইসলাম-কে স্বাগত জানান হয়েছে।
১০. ২০১৪ সালের মার্চ থেকে বিমস্টেক-কে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নেপালের তারিফ করা হয়েছে এবং বিমস্টেকের নতুন চেয়ার হিসাবে শ্রীলঙ্কাকে স্বাগত জানান হয়েছে।
১১. আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রক্রিয়াকে আরও বাড়াতে বিমস্টেকের শীর্ষ সম্মেলন এবং অন্যান্য বৈঠকের সময়মত করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।
১২. সেক্টরভিত্তিক পর্যালোচনার উপর সদস্যদের অবস্থান, অঙ্গীকার এবং বিবৃতিগুলি ঘোষণাপত্রের অংশ হিসাবে সংযুক্তিকরণে প্রকাশ করা হয়েছে।
১৩. শীর্ষ সম্মেলনের জন্য চমৎকার ব্যবস্থা এবং উষ্ণ আতিথেয়তার জন্য নেপাল সরকারকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানানো হয়েছে।