কী কারণে যোগীর রাজ্যে কৈরানায় মুখ থুবড়ে পড়ল মোদীর জয়রথ, সামনে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য
পশ্চিম উত্তর প্রদেশ হল রাষ্ট্রীয় লোক দলের আঁতুরঘর। কিন্তু, ২০১৪ ও ২০১৭ সালে বিজেপি-র কাছে পর্যদুস্ত হয় অজিত সিং-এর দল। উত্তর প্রদেশের এই অঞ্চলে রয়েছে ১০টি লোকসভা ক্ষেত্র।
পশ্চিম উত্তর প্রদেশ হল রাষ্ট্রীয় লোক দলের আঁতুরঘর। কিন্তু, ২০১৪ ও ২০১৭ সালে বিজেপি-র কাছে পর্যদুস্ত হয় অজিত সিং-এর দল। উত্তর প্রদেশের এই অঞ্চলে রয়েছে ১০টি লোকসভা ক্ষেত্র। এগুলি হল ফতেপুর সিক্রি, মথুরা, আলিগড়, হাতরাশ, ভাগপাট, কৈরানা, বিজনৌর, গাজিয়াবাদ, মেরঠ ও মুজফ্ফরনগর। এই প্রত্যেকটি লোকসভাতেই প্রভাব রয়েছে রাষ্ট্রীয় লোক দলের। উত্তর প্রদেশের এই অঞ্চলে মুসলিম ও জাঠ ভোটারদের সংখ্যাটাই বেশি। এরা পেশায় আবার কৃষক। রাষ্ট্রীয় লোক দলের উৎপত্তি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে জনতা দল (সেকুলার) থেকে। জনতা দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী চরণ সিং। রাষ্ট্রীয় লোক দলের প্রধান অজিত সিং-এর বাবা ছিলেন চৌধুরী চরণ সিং। তিনি পশ্চিম উত্তর প্রদেশে মুসলিম ও জাঠদের কৃষক ভোটব্যাঙ্ককে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। আর এই ভোটব্যাঙ্কই ছিল আরএলডি-র সাফল্যের হাতিয়ার। কিন্তু, একটা সময় এলাকার জাঠ কৃষক গোষ্ঠীর মনে হয়েছিল যে আরএলডি অত্যাধিক মাত্রায় মুসলিম তোষণ করছে। যার ফলে আরএলডি-র প্রতি একটা বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছিল।
২০১৩ সালে মুজফ্ফর দাঙ্গায় বিজেপি এই অঞ্চলে ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতিতে ভালোই ফায়দা তোলে। যার জেরে ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে এই অঞ্চলের ক্ষমতা চলে যায় বিজেপি-র হাতে। জাঠেদের দল হয়েও হেরে গিয়েছিল আরএলডি। কারণ, জাঠরা এই যাত্রায় বিজেপি-কেই সমর্থন দিয়েছিল। ২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনেও এক ছবি দেখা যায়। কিন্তু, এরপর যেন বিজেপি-তে মোহভঙ্গ ঘটতে থাকে পশ্চিম উত্তর প্রদেশে বসবাসকারী জাঠেদের।
এলাকার বহু জাঠেদেরই অভিযোগ বিজেপি কোনও প্রতিশ্রুতি পালন করেনি। যার ফলে, তাঁরা ফের আস্থা রেখেছেন আরএলডি-র উপরেই। ধর্মের মেরুকরণ করে আসলে বিজেপি যে ভোট জিততে চেয়েছিল তা তাঁদের সামনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে বলেই মনে করছেন এইসব জাঠেরা। বিজেপি-র কথা মেনে চলতে গিয়ে এলাকায় বসবাসকারী মুসলিমদের সঙ্গে জাঠেদের একটা দূরত্বও তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। সামাজিক ক্ষেত্র থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক কাজকর্মেও এই বিভেদ প্রভাব ফেলেছে বলে মানছেন এঁরা। বিজেপি-র কথায় ভোট দিয়ে এলাকার কোনও উন্নয়ন হয়নি তারমধ্যে।
জাঠেদের এই বিরূপ মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে কৈরানা লোকসভার উপনির্বাচনে। আরএলডি-র মুসলিম প্রার্থী তবস্সুম হাসান-কেই সমর্থন দিয়েছেন কৈরানা লোকসভার জাঠ সম্প্রদায়। কৈরানা লোকসভা এলাকায় ৫.৫ লক্ষ মুসলিম ভোটার রয়েছেন। জাঠ ভোটারের সংখ্য়া ১.৫ লাখ। তবস্সুম হাসান পেয়েছেন ৪.৮১ লক্ষ ভোট। সেখানে বিজেপি প্রার্থী পেয়েছেন ৪.৩৬ লক্ষ ভোট। অধিকাংশ জাঠ ভোটারের সমর্থন গিয়েছে তবস্সুমের পক্ষে।
উপনির্বাচনের সময় কৈরানা লোকসভার একাধিক বুথে ইভিএম খারাপের অভিযোগ ওঠে। এর ফলে বহু মানুষ ভোট দিতে পারেননি বলেও অভিযোগ ওঠে। খোদ তবস্সুম ইভিএম খারাপের জন্য বিজেপি-র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছিলেন। ২০১৬ সালে এই লোকসভার বিজেপি সাংসদ হুকুম সিং-এর মৃত্যু হয়। এরপর থেকেই আসনটি ফাঁকা পড়ে ছিল। উপনির্বাচনে বিজেপি হুকুম সিং-এর মেয়ে মৃগাঙ্কা সিং-কে প্রার্থী করেছিল। অন্যদিকে তাবাস্সুম হাসানকে ভোটে প্রার্থী করাটা আরএলডি-র কাছে জুয়া খেলার মতো। কারণ, সম্প্রতি সমাজবাদী পার্টি ছেড়ে আরএলডি-তে যোগ দিয়েছিলেন তাবাস্সুম। একটা সময় তিনি বিএসপি-র টিকিটে সাংসদও হয়েছিলেন। তাবাস্সুম-এর স্বামী তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ার শুরু করেছিলেন জনতা দলে। পরে সপা-য় চলে যান। তাবাস্সুম ভোটে প্রার্থী হলে তাঁর পিছনে কতজন লোক থাকবে তা নিয়েও সন্দেহ ছিল। কিন্তু, নির্বাচনী প্রচারে বারবার দেখা গিয়েছে আরএলডি কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে সঙ্গে বিএসপি, সপার-র কর্মী-সমর্থকরাও লাগাতার প্রচার চালান। এইভাবেই বিজেপি-র বিরুদ্ধে একজোট হওয়া বিরোধীদের মুখ হয়ে উঠেছিলেন তাবাস্সুম।
এমনকী, আরএলডি-এর শীর্ষ নেতা তথা অজিত সিং-এর ছেলে জয়ন্ত চৌধুরী মাত্র ১০দিনে ১৪৫টি মিটিং করেছিলেন তাবস্সুমের জন্য। অন্যদিকে অজিত সিং জাঠেদের ছোট ছোট গোষ্ঠীর কাছে গিয়ে বুঝিয়েছিলেন বিজেপি-র বিপদ। বুঝিয়েছিলেন কেন জাঠ ও মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের এক হওয়া উচিত। আসলে একদিকে আরএলডি যখন সপা ও বাসপার সমর্থন নিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা দরজায় দরজায় গিয়ে বোঝাচ্ছিল ঠিক তখন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ মুজফ্ফরনগর দাঙ্গায় নিহত দুই যুবক শঙ্কর ও গৌরবের নাম নিয়ে প্রচার করেন। হিন্দুত্বের জয়গান গাইতে এখানে প্রচারে আনা হয় হিন্দুত্ববাদী বলে পরিচিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সতপাল সিং, প্রাক্তন মন্ত্রী সঞ্জীব বালিয়ান, শাম্লীর বিধায়ক তেজেন্দ্র নিরওয়াল, গাঙ্গোহ বিধায়ক প্রদীপ চৌধুরী, প্রাক্তন আরএলডি বিধায়ক সোহেন্দ্র সিং রামালা, বুধনার বিধায়ক উমেশ মালিক, ক্যাবিনেট মন্ত্রী লক্ষীনারায়ণ চৌধুরী, আর এক মন্ত্রী ভূপেন্দ্র চৌধুরীদের। এরা সকলেই হিন্দুত্বের আওয়াজ তুলেছিলেন প্রচারে। কিন্তু গণনার ফলে দেখা গেল এই হিন্দুত্ব লাইন বুমেরাং হয়ে গেল বিজেপি-র কাছে।
২০১৪ সালে হুকুম সিং কৈরানা আসনে পেয়েছিলেন ৫,৬৫,৯০৯টি ভোট। আর সেবার বিএসপি ও সমাজবাদী পার্টি প্রার্থীরা যা ভোট পেয়েছিলেন তা মেলালে হয় ৫,৩২,২০১। জোট বাঁধলে যে এবার বিজেপি-কে হারানো সম্ভব তা বুঝেছিল আরএলডি, বিএসপি ও সপা। তাই ২০১৪ সালের মতো ভুল আর তারা করতে চায়নি কৈরানার উপনির্বাচনে। বিজেপি-র প্রতি মোহভঙ্গ জাঠেদের দল তাই বিরোধী ঐক্যের প্রতি আস্থা পোষণ করেছে।