
নিরামিষাশী কুমীর, চলে গেল পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের রক্ষাকর্তা
তার পরিচিতি ডিভাইন নামে। কীভাবে নামকরণ কেউ জানে না। পৃথিবীর একমাত্র আশ্চর্য ও দিব্য কুমির যার আমিষ খাবারে রুচি ছিলনা। দেবভূমি কেরলের কাসারগড়ের নামকরা মন্দির অনন্তপুরা। যা পদ্মনাভস্বামী মন্দির বলে খ্যাত। শাকাহারী বাবিয়া মন্দির সংলগ্ন পুকুরে থাকত। আজ মারা গেল বিখ্যাত নিরামিষভোজী কুমির।

'বাবিয়া' শান্ত এক কুমির
'বাবিয়া' শান্ত এক কুমির। বছর দুয়েক আগে হঠাৎ বাবিয়াকে মন্দিরের ভিতরে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। বাবিয়া কারও কোনও ক্ষতি করেনি। মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের কথায় জলাশয়ে ফিরে যায়। স্থানীয় মতে বাবিয়া মন্দিরের পুকুরে ৭০ বছরেরও বেশি সময় বাস করত। বাবিয়া মন্দিরের প্রসাদ ও ভাতের দলা খেয়েই থাকত। পুরোহিতরা তাকে ভাতের দলা খাইয়ে দিত। বাবিয়া মাছ ভর্তি পুকুরে থাকলেও কোন মাছের ক্ষতি করেনি। সনাতনী রীতি নীতি মেনে দেহের সৎকার করা হয়েছে।

পদ্মনাভস্বামী
পদ্মনাভস্বামী বলা হয়ে থাকে বিষ্ণুকে। বিষ্ণুর নাভিপদ্মে অবস্থান করেন ব্রহ্মা; তাই তাঁকে বলা হয় পদ্মনাভস্বামী। অর্থাৎ এই মন্দিরের কুলদেবতা স্বয়ং বিষ্ণুই! আঠারো এবং উনিশ শতকে কেরালার মধ্য ও দক্ষিণ অংশ নিয়ে গঠিত ট্রাভাঙ্কোর রাজ্যের শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরটি ষোল শতকে স্থাপিত হয়েছিল বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। তবে এর আগে থেকেই এখানে মন্দির থাকার অনেক বর্ণনা পাওয়া যায় ইতিহাসে, সে অনুসারে এর স্থাপনকাল সঠিকভাবে জানা যায় না। ট্রাভাঙ্কোর রাজ্য সৃষ্টির অনেক অনেক আগে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালের মুদ্রাও রক্ষিত আছে মন্দিরের ভল্টের ভেতরে, যদিও তা পরবর্তী সময়ে নৈবদ্য হিসেবে আসতে পারে এমন ধারণাও রয়েছে। ব্রাহ্ম, মাৎস্য, বরাহ, স্কন্দ, পদ্ম, বায়ু, ও ভগবত এই পুরাণগুলোতে এবং মহাভারতে এই স্থানের মন্দিরের উল্লেখ রয়েছে।
খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সাল থেকে খ্রিস্টের জন্মের ৩০০ সালের মধ্যে রচিত প্রাচীন তামিল সাহিত্যের সঙ্গম আমল নামক সময়কালের রচনায় এই মন্দিরকে 'স্বর্ণমন্দির' রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে এর বিপুল সম্পদের কারণে। মন্দিরের নির্মাণ সংক্রান্ত রেকর্ডে উল্লেখ আছে, কলিযুগ শুরু হবার পর দিবাকর মুনি এই মন্দিরটির নির্মাণকাজ শুরু করেন এবং এটি তৈরি হতে সময় লেগেছিল প্রায় ৯৬৪ দিন।আঠারো শতকের মাঝামাঝিতে ট্রাভাঙ্কোরের রাজা হন আনিঝাম থুরিনাম যিনি পরিচিত মার্তণ্ড ভার্মা হিসেবে। মার্তণ্ড ভার্মা ১৭৫০ সালে ট্রাভাঙ্কোর রাজ্যটি দেবতা পদ্মনাভস্বামীর পদচরণে সমর্পণের ঘোষণা দেন। তার পরবর্তী বংশধর 'পদ্মনাভ দাস' হিসেবে ট্রাভাঙ্কোর শাসন করবে, দেবতার নিকট এমন প্রতিশ্রুতির ঘোষণাও দেন তিনি। সেই থেকে ট্রাভাঙ্কোরের রাজ পরিবারের পুরুষ সদস্য ও রাজারা নামের আগে শ্রী পদ্মনাভ দাস উপাধি এবং নারী সদস্যরা শ্রী পদ্মনাভ সেবিনী উপাধি ধারণ করে আসছেন।

ধন-সম্পদ
বেশিদিন আগের কথা নয়, ২০১১ সালেই ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে এ মন্দির থেকে বিপুল পরিমান ধন-সম্পদ বের করে আনা হয় মানুষের সামনে! শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দির, ভারতের কেরালা রাজ্যে অবস্থিত এই মন্দির পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো এবং সবচেয়ে রহস্যময় মন্দিরগুলোর মধ্যে একটি।এই মন্দির পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মন্দির। কিন্তু পৌরাণিক এবং মাহাত্ম্যের দিক থেকে এটি যত না সুপরিচিত তার থেকে বেশি পরিচিত এর পেছনে লুকিয়ে থাকা রহস্যের জন্য। আসলে এই মন্দিরে এমন কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে যা এই মন্দিরটিকে অন্যান্য মন্দির গুলির থেকে আলাদা করে তোলে।প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ মনে করত এই মন্দিরের নিচে গুপ্তধন লুকানো আছে, এই মন্দিরে ভেতরে অনেকগুলি গুপ্ত দরজা আছে, যেগুলিকে কখনোই খোলা হয়নি।
খোঁজ করার পর জানা যায় যে, এই মন্দিরে মোট ছয়টি গুপ্ত দরজা রয়েছে, কিন্তু কেউ জানে না, যে কি রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এই দরজার আড়ালে।২০১১ সালে ইন্ডিয়ান সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এই মন্দিরের দরজা গুলিকে একের পর এক খোলা হয় এবং অবশেষে পাঁচটি দরজা খোলা হয়। এই দরজার পেছনে যা পাওয়া গিয়েছিল তা সারা বিশ্বকে হতভম্ব করে দিয়েছিল। ওই দরজা গুলির পেছনে পাওয়া যায়, প্রচুর পরিমাণে সোনা, সোনার তৈরি অসংখ্য প্রাচীন মূর্তি এবং প্রচুর সোনার মুদ্রা যার মূল্য কয়েকশো কোটি নয়, কয়েকশো হাজার কোটি।

পাঁচটি ভল্ট
আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এই পাঁচটি ভল্টের সম্পদের সম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশ না করা হলেও, কমিটির সদস্য ও অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী করা পত্রিকার রিপোর্ট থেকে সেখানে বিদ্যমান অজস্র ধন দৌলতের মধ্যে কিছু কিছু সম্পদের বর্ণনা জানা যায়। এই ভল্টের সম্পদের মধ্যে আছে,সাড়ে ৩ ফুট দীর্ঘ একটি স্বর্ণের বিষ্ণুমূর্তি যাতে খচিত আছে হীরা ও রুবিসহ মূল্যবান রত্ন পাথর।স্বর্ণের তৈরি একটি সিংহাসন যাতে অন্তত সাড়ে ৫ মিটার দীর্ঘ একটি মূর্তি স্থাপন করা যায়। সিংহসনের গায়ে খচিত আছে শত শত হীরা ও অন্যান্য রত্ন পাথর।সাড়ে ৫ মিটার লম্বা একটি স্বর্ণের চেইন।৫০০ কেজি ওজনের একটি স্বর্ণের স্তুপ।৩৬ কেজি ওজনের একটি পর্দার মত আবরণী।রত্নখচিত স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে বানানো ১,২০০ টি চেইন।স্বর্ণের জিনিসপত্র, নেকলেস, মুকুট, হীরা, রুবি, নীলকান্তমণি, পান্না, রত্ন পাথর ও মূল্যবান ধাতব দ্রব্যাদি ভর্তি কয়েকটি বস্তা।দেবমূর্তির শরীর আচ্ছাদনের জন্য প্রায় ৩০ কেজি ওজনের স্বর্ণের আবরণ।স্বর্ণ নির্মিত নারকেলের মালা যাতে খচিত আছে রুবি ও পান্না।১৮ শতকের নেপোলিয়নের আমলের মুদ্রা।রোমান সাম্রাজ্যের কয়েক হাজার মুদ্রা।খ্রিস্টপূর্ব ২০০ সালের ১,৯৫০০০ টি স্বর্ণমুদ্রা যেগুলোর ওজন সব মিলিয়ে ৮০০ কেজি।অন্তত ৩টি (বিভিন্ন রিপোর্টে বিভিন্ন সংখ্যার উল্লেখ আছে) সম্পূর্ণ স্বর্ণ নির্মিত আর হীরা ও অন্যান্য রত্ন খচিত রাজমুকুট।কয়েকশ স্বর্ণের চেইন।কয়েক হাজার স্বর্ণের পট ও জার।প্রাচীন মালায়লাম ও তামিল ইতিহাসের এক বিশাল ভাণ্ডার হল 'কজনপত্র' বা তালপাতায় লিখিত ইতিহাস। এমন ৩,০০০ টি বান্ডেল আর্কাইভে সংরক্ষিত রয়েছে, যার প্রতিটি বান্ডেলে রয়েছে কয়েক হাজার তালপাতা। সেখানে লিখিত আছে হাজার বছর ধরে শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরে স্বর্ণ ও মূল্যবান দ্রব্যাদি নৈবদ্য প্রদান করার তথ্য। এর মাত্র অল্প কিছু পাতা এখনো গবেষণা করা হয়েছে। বাকিগুলো থেকে তথ্য উদ্ধার করা গেলে হয়ত জানা যাবে মন্দিরের বিপুল ধনভাণ্ডারের উৎসের ইতিহাস।
সম্পূর্ণ বিবরণী প্রকাশ করা হয় নি তাতেই এই অবস্থা, প্রকাশিত হলে আরও কী কী পাওয়া যেতে পারে তার পুরোটা অনুমান করা হয়ত কোনো মানুষের পক্ষেও সম্ভব নয়। শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের এই বিপুল পরিমাণ ধন সম্পত্তি কোথা থেকে এল এমন প্রশ্ন তো আছেই। বিশ্বাস করা হয়, হাজার হাজার বছর ধরে মন্দিরের দেবতার উদ্দেশ্যে দান করা সম্পদগুলোই জমা হয়ে আছে ভূগর্ভস্থ ভল্টে। ভারতের বিভিন্ন সময়ের শাসনকারী রাজপরিবারগুলো এখানে দান করেছে। মেসোপটেমিয়া, গ্রিস, রোম, জেরুজালেম হতে শাসকবৃন্দ ও বণিকেরাও ভারতবর্ষে এসে মন্দিরে দান করেছে। এরপর ঔপনিবেশিক শাসনের সময়েও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে দানের সামগ্রী।
এ তো কিছুই না। শ্রী পদ্মনাভস্বামী টেম্পলের আসল আকর্ষণ তো এর 'ভল্ট বি' মানে ছয় নম্বর দরজা! এই ভল্টটিকে ঘিরে রহস্য এবং কিংবদন্তির কোনো শেষ নেই। কারণ একটিই - অন্য ভল্টগুলো খোলা হলেও এটি এখনো খোলা হয় নি!দেশটির সুপ্রিম কোর্ট থেকে জানানো হয়েছে 'ভল্ট এ'-তে থাকা মূল্যবান সামগ্রীগুলো ঠিকমতো নথিভুক্ত করা গেলে তবেই খোলার অনুমতি দেয়া হবে এ ভল্টটি। তবে এমন ঘোষণায় বসে নেই গবেষকেরা। বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তারা যে দাবী করছেন তাতে বিস্ময়ে মুখ 'হাঁ' হয়ে যেতে বাধ্য।তাদের মতে ভল্ট বি-তে মজুদকৃত সম্পদের বাজারমূল্য এক ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে! ধারণা করা হয়, ভল্ট বি'র দরজার সামনে দুটো কোবরা সাপের প্রতিকৃতি রয়েছে।কিংবদন্তি প্রচলিত আছে যে, ভল্ট বি'র দরজা ভেতর থেকে পাহারা দিয়ে রেখেছে বিশালাকৃতির দুটি কোবরা। যদি কোনো অনুপ্রবেশকারী সম্পদের লোভে সেখানে প্রবেশ করেও থাকে, তবে সাথে সাথেই সাপের ছোবলে পরপারে পাড়ি জমাবে সে।তবে এটি শুধু রহস্যের শুরু এখনও আসল রহস্য আপনার সামনে তুলে ধরা হয়নি। সবচেয়ে রহস্যময় ব্যাপারটি হল এই দরজাতে মানে ভোল্ট বি তে না কোন চাবির গর্ত আছে, না কোন এমন জিনিস যার সাহায্যে এই দরজাটি খোলা যায় অর্থাৎ এটি এমন একটি দরজা যাকে কেউ সহজে খুলতে পারবে না।বলা হয়ে থাকে এই দরজাটিকে একমাত্র ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী খোলা সম্ভব।এটিকে, একটি মন্ত্র দ্বারা খোলা যেতে পারে, যাকে গারুদা মন্ত্র বলে আর এই দরজাটি সেই পবিত্র মানুষই খুলতে পারবে যার মনের শক্তি সবচেয়ে বেশি, যিনি মহান আর মনে করা হয় সেই মহান মানুষের জন্ম আজ পর্যন্ত হয়নি, যিনি এই দরজাটি খুলতে পারবেন।স্থানীয়রা বিশ্বাস করে - কেউ যদি জোর করে এই দরজাটি খোলে তাহলে তাঁর জীবন অভিশপ্ত হয়ে যাবে। আর সেই জন্য এই দরজাটিকে পুনরায় সিল করে দেয়া হয় আজ পর্যন্ত কেউ জানে না এই দরজার পেছনে কি রয়েছে! কিন্তু, এর আগেও বহুবার এই দরজা গুলিকে খুলবার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল।
আজ থেকে ১০০'রও বেশি বছর আগে ১৯০৮ সালে এই দরজাগুলিকে খোলার প্রথম চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই সময় যখন তারা প্রথম দরজাটিকে খোলার চেষ্টা করে তখন প্রচুর পরিমাণে সাপ তাদের সামনে বেড়িয়ে আসে যার ফলে তারা একটিও দরজা খুলতে পারিনি।কিন্তু এরপর ১৯৩১ সালে আরো একবার এই দরজাগুলিকে খোলার চেষ্টা করা হয়েছিল এবং এবার একটি দরজা খোলা হয় আর ওই দরজার পিছনে থেকে বেরিয়েছিল প্রচুর পরিমাণে সোনা। এর মানে হচ্ছে, আসলে প্রথম দরজাটি ১৯৩১ সালেই খোলা হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারা বাকী দরজাগুলিকে কেন খুলতে পারিনি তার কারণ কেউ জানে না।এবার একটা রহস্য সামনে উঠে আসছে। ১৯০৮ সালে দরজা খোলার সময় প্রচুর পরিমাণে সাপ দেখা গিয়েছিল। কিন্তু ১৯৩১ সালে যখন পুনরায় চেষ্টা করা হয় তখন কিন্তু কোন সাপ দেখা যায়নি, তাহলে যখন এবার কোনো বাঁধা ছিলনা, যখন কোন সাপই তাঁদের সামনে আসেনি তাহলে তারা প্রথম দরজাটিকে খোলার পর অন্যগুলি খোলার চেষ্টা কেন করেনি?কিছু মানুষের মনে করে যে জিনিসগুলি এই দরজার পেছন রয়েছে সেগুলি সব দৈবীয় জিনিস, মনে করা হয় এগুলি মানুষের হাতে আসা উচিত নয়, আর এই জন্যই হয়তো তারা বাকি দরজা গুলি খোলেনি এবং প্রথমে খোলা দরজাটিকেও বন্ধ করে দেয়।আর এই রহস্যের জন্যই মানুষ এই মন্দিরটির প্রতি আকর্ষিত হয়ে পড়ে এবং প্রচলিত হয়ে যায় যে এই মন্দিরে প্রচুর পরিমাণে গুপ্তধন লুকানো আছে।
ভেঙে পড়ল সাড়ে ১৯ কোটির আন্ডারপাস, দুর্নীতির প্রশ্ন তুলছে কংগ্রেস