তিন মন্ত্রে বিরোধীদের পিছনে ফেলেছেন নরেন্দ্র মোদী, হয়ে উঠেছেন অন্যতম শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী
'মিত্রোঁ'- যার বাংলা করলে দাঁড়ায় 'বন্ধু'। আর এই বন্ধুত্বের আহ্বানেই আসমুদ্র-হিমাচলের মন জয় করেছেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। দৃঢ়, প্রত্যয়ী, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর এক রাজনৈতিক নেতা।
'মিত্রোঁ'- যার বাংলা করলে দাঁড়ায় 'বন্ধু'। আর এই বন্ধুত্বের আহ্বানেই আসমুদ্র-হিমাচলের মন জয় করেছেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। দৃঢ়, প্রত্যয়ী, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর এক রাজনৈতিক নেতা। যাঁর 'মিত্রোঁ' ডাকে গরিব-দুঃখী থেকে শুরু করে সমস্ত শ্রেণির মানুষই তাঁকে আপন করে নেন। মানুষের এই নির্ভরতাই তাঁর ইউএসপি বলে মানেন মোদী।
ছোটবেলায় যে খুব আর্থিক স্বচ্ছলতায় মানুষ হয়েছিলেন এমনটা নয়। কিন্তু, লড়াই কোনও দিনই থামাননি। গুজরাটের ভাড়নগর রেল স্টেশনে চা-বিক্রি করা ছেলেটা কিন্তু কোনও দিন স্বপ্ন দেখতে ভয় পাননি। নিজেকে চারপাশের পরিস্থিতির বাইরে বের করার আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছিলেন। আর সেই উচ্চাশার পথ বেয়ে হয়ে উঠেছেন জননেতা। আজ তিনি দেশজুড়ে সকলের প্রধানমন্ত্রী।
১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টম্বর জন্ম। নরেন্দ্র মোদী তাই সোমবার ৬৮ বছরে পা রাখলেন। তিনি যখন গুজরাটের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল ৫১ বছর। আর দেশের যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তখন তাঁর বয়স ৬৩ বছর। দেশের প্রধানমন্ত্রীত্বের আসনে বসার আগে দীর্ঘ দেড় দশক গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীত্বের পদ সামলিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী।
ভাড়নগরে এক গুজরাটি পরিবারে জন্ম নরেন্দ্র মোদীর। ভাড়নগর রেল স্টেশনে ছোট থেকেই বাবা'র টি-স্টলে কাজ করতেন। পরে নিজেই রেল স্টেশনে একটা চায়ের দোকান খুলেছিলেন। ৮ বছর বয়সে আরএসএস-এর ভাবধারার সংস্পর্শে আসেন। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেই দেশভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। স্বামী বিবেকানন্দের দর্শনে মনে-প্রাণে বিশ্বাসী ছিলেন। শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে স্বামীজির হিন্দু ধর্ম নিয়ে জোরদার বক্তৃতা তাঁকে আকর্ষিত করত। এমনকী তাঁর নরেন নামও রাখা হয়েছিল স্বামীজির ছোটবেলার নামে। রামকৃষ্ণ মিশনের সন্যাসী হবেন বলে বেলুড় মঠেও চলে আসেন নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু, সন্যাসী হওয়ার পথ যে সহজ নয় তা বুঝেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। একাধিক ধর্মীয় স্থান দর্শনের পর ১৯৬৯ সালে ফের গুজরাটে ফিরে যান তিনি। কিন্তু, ভাড়নগরে না ফিরে তিনি এবার পাকাপাকিভাবে থাকা শুরু করেন আহমেদাবাদে। ১৯৭১ সালে এরএসএস পূর্ণসময়ের প্রচারক হয়ে যান। ১৯৮৫ সালে আরএসএস-এর হাত ধরে বিজেপি-তে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে শুরু করেন। ২০০১ সালের আগে পর্যন্ত বিজেপি-র একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদ সমালান তিনি। ২০০১ সালে হন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী।
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হয়েই নরেন্দ্র মোদী তৈরি করেন এক সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা। যাকে ভিত্তি করে তৈরি করেন 'ব্র্যান্ড গুজরাট'। যার সাফল্য তাঁকে নিয়ে এসে ফেলে জাতীয় রাজনীতির আঙিনায়।
মুখ্য়মন্ত্রীত্বের পদ ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী পদের অভিষেক প্রক্রিয়ায় মোদী ৩টি বিষয়ের উপরে প্রবল নজর দেন। এগুলি হল দুর্নীতিহীন সরকার, নীতি-নির্ধারণের দ্রুত প্রয়োগ এবং বাজারমুখী সংস্কার। ২০১৪ সালের দেশের সাধারণ নির্বাচনে এই বিষয়গুলি-ই ছিল মোদীর প্রচারের মূল আধার। যা স্বাভাবিকভাবেই আস্থাশীল করেছিল দেশকে। আর সেই জন্য ৩০ বছর পর বিজেপি-কে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা দিয়ে কেন্দ্রের ক্ষমতায় নিয়ে আসে দেশবাসী। নরেন্দ্র মোদী হন তাঁর প্রথম প্রধানমন্ত্রী। যার মেয়াদ শেষ হবে ২০১৯-এ।
দুর্নীতিহীন সরকার, নীতি-নির্ধারণের দ্রুত প্রয়োগ এবং বাজারমুখী সংস্কার-এর হাত ধরে নরেন্দ্র মোদীর হাত ধরে গত ৫ বছরে রূপায়িত হয়েছে একাধিক প্রকল্প। যার মধ্যে রয়েছে বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও থেকে শুরু করে মেক ইন ইন্ডিয়া, স্বচ্ছ ভারত অভিযান, নোটবাতিল, জিএসটি, জন-ধন যোজনা, স্মার্ট সিটি মিশন, আয়ুষ্মান ভারত-এর মতো ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প।
১। বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও-
২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি এই প্রকল্প চালু হয়। মহিলাদের নানা বিধৌ উন্নয়নে উৎসাহিত করতে এই প্রকল্পের অধিনে আনা হয় একাধিক পরিকল্পনা। প্রথমে ১০০টি জেলা যেখানে কন্যা সন্তান জন্মের হার কম সেখানে এই প্রকল্প চালু করা হয়। এখন দেশজুড়ে বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও প্রকল্প বিশাল সাফল্যের মুখ দেখেছে। এই প্রকল্প চালু হওয়ার পর মেয়েদের স্কুল ছুটের সংখ্যা অনেকটাই কমেছে। পিতা-মাতাদের বোঝানো সম্ভব হয়েছে পুত্র সন্তানের মতোই কন্য়া সন্তানও সমস্ত অধিকার পাওয়ার যোগ্য। নাবালিকা মেয়েদের বিয়ের সংখ্যাও কমছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রকল্প এখন বিশ্বজুড়ে বন্দিত হচ্ছে।
২। মেক ইন ইন্ডিয়া-
প্রধানমন্ত্রী পদে আসিন হওয়ার পরই ভারত ব্র্যান্ডকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। তিনি বলেছিলেন, একদিন ভারত বিশ্বের সেরা বিজনেস হাব হবে। আর এর জন্য দেশের মধ্যেই ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট খুলতে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী এবং দেশিয় উৎপাদনকারীদের উৎসাহ জোগাতে এই প্রকল্পের সাহায্য নেন মোদী। যার জন্য ২৫টি ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের ছিটকানিটাও খুলে দেন। তবে মহাকাশ গবেষণায় ৭৪%, প্রতিরক্ষায় শর্তসাপেক্ষে ৪৯ % এবং সংবাদমাধ্যমে ২৬% বিদেশী বিনিয়োগই বজায় থাকে। জাপান ও ভারত মেক-ইন-ইন্ডিয়া স্পেশাল ফিনান্স ফেসিলিটি নামে একটি ফান্ডও তৈরি করে এই প্রকল্পে অধীনে।
৩। স্বচ্ছ ভারত অভিযান-
জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে সামনে রেখে এই অভিযানের জন্ম দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর এই প্রকল্প চালু হয়। দেশজুড়ে চলা এই সাফাই অভিযানে কে অংশ নেননি? স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়েরা থেকে শুরু করে ফিল্ম পার্সোনালিটি, বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতা, বিশিষ্ট গুণীজন, বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ, বিজনেস টাইকুন, ছোট-বড় শিল্পপতিদের দলও। আজ স্বচ্ছ ভারত দেশজুড়ে অন্যতম এক জনপ্রিয় প্রকল্প।
৪। নোটবাতিল-
দেশের শহর থেকে গ্রাম- কে একধাক্কায় ডিজিটালমুখী করেছিল এই প্রকল্প। কালো টাকার কারবারিদের শিক্ষা দিতে রাতারাতি নোটবাতিল কর্মসূচি প্রয়োগ করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। সেইসঙ্গে সূচনা করেন ডিজিটাল লেনদেনের। পুরোপুরি ডিজিটাল লেনদেনের জন্য ভারত তৈরি নয় বলে যে ভাবনাটা উন্নত দেশগুলির মনের মধ্যে ঘুরে বেড়াত, তারা দেখেছিলেন কী পরিমাণ দ্রুততার সঙ্গে ভারতবাসীদের একটা বিশাল অংশ ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
৫। জিএসটি-
এক দেশ এক কর ব্যববস্থার ভাবনা থেকে এই উদ্যোগ। নরেন্দ্র মোদীর আমলে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। এর ফলে একটি জিনিসের উপরে একাধিক কর দেওয়ার নিয়ম উঠে যায়। বিশেষ করে কেন্দ্র ও রাজ্য দ্বারা চাপানো অপ্রত্যক্ষ কর দেওয়ার রীতিও বন্ধ হয়ে যায় জিএসটি-তে। এতে প্রবলভাবে উপকৃত হন প্রতিটি দেশবাসী।
৬। জন ধন যোজনা-
এই প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি ঘরে জিরো ব্যালান্সে ব্যাঙ্ক অ্য়াকাউন্ট খুলে দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়। জন ধন যোজনায় খোলা ব্য়াঙ্ক অ্যাকাউন্টে গরিব মানুষরা চিটফান্ডের মতো প্রতারকদের হাত থেকেও রেহাই পান।
৭। স্মার্ট সিটি মিশন-
দেশজুড়ে অত্য়াধুনিক প্রযুক্তি ও পরিবেশের মেলবন্ধন ঘটাতে এবং মনুষ্য সমাজকে উন্নত জীবনের স্বাদ দিতে এই প্রকল্পের শুরু । ৫০০টি শহরকে এই প্রকল্পের আওতায় রাখা হয়েছে। প্রথম অবস্থায় ৯৮টি শহরকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। স্মার্ট সিটি মিশনের জন্য ইতিমধ্যেই ৯৮০ বিলিয়ন অর্থ এই প্রকল্পে সরবারহ করা হয়েছে।
৮। আয়ুষ্মান ভারত-
এই প্রকল্পের আওতায় বিমা সুরক্ষা পেতে চলেছেন ১০ কোটি পরিবারের ৫০ কোটি মানুষ। এবারের স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে এই প্রকল্পের ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এটা বিশ্বের সর্ববৃহৎ সরকারি স্বাস্থ্য প্রকল্প হতে চলেছে। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এই বিমার সুবিধা পাওয়া যাবে। আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারগুলিকে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হচ্ছে। এর জন্য ইতিমধ্যেই যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ডেটাবেস তৈরির কাজও শুরু হয়েছে।
[আরও পড়ুন: গৌরী লঙ্কেশ, কালবুর্গি ও ধবলকরের খুনিরা একই সংগঠনের, জমা পড়ল তদন্ত রিপোর্ট]
নরেন্দ্র মোদী-র 'পিরামিড' উন্নয়নের দিশায় ভারত ফের বিশ্বের বৃহৎ বিকাশশীল অর্থনীতির তকমা পেয়েছে। একাধিক ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন ভারতের অর্থনীতির সম্ভাবনাকে কুর্ণিশ জানিয়েছে। এমনকী, এই মুহূর্ডে জিডিপি-র অগ্রগতি সকলের নজর কেড়েছে। কমেছে মূদ্রাস্ফীতির হার। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে চলতে গেলে বহু কাঁটাই পার হতে হয়, নরেন্দ্র মোদী সেটা মানেন। আর সেই কারণে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সংকট মোকাবিলাতেও একাধিক পদক্ষেপ নিয়ে চলেছেন। তাঁর বিশ্বাস দেশ তাঁর পাশে আছে।
[আরও পড়ুন:মোদীর একসময়ের নির্বাচনী 'স্ট্র্যাটেজিস্ট' প্রশান্ত কিশোর ভিড়লেন নীতীশের দলে]