কয়েকশো বিলিয়ন ডলার সম্পতির মালিক হয়েও কেন বিশ্বসেরা ধনী তালিকায় নাম নেই রতন টাটার?
কয়েকশো বিলিয়ন ডলার সম্পতির মালিক হয়েও কেন বিশ্বসেরা ধনী তালিকায় নাম নেই রতন টাটার?
এত সম্পত্তির মালিক হয়েও দেশের অন্যান্য বেশ কিছু ব্যক্তিদের পাশাপাশি বিশ্বের ধনীতমদের ব্যক্তিদের তালিকায় কেন নাম থাকেনা আপনার? একদা সাংবাদিকের এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, "আপনি যাঁদের কথা বলছেন তাঁরা হলেন দেশের গণ্যমান্য 'ব্যবসায়ী', আর আমি মানুষটা হলাম নিতান্তই একজন উদ্যোগপতি।" এই সামান্য একটি কথার মাধ্যমেই তিনি স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে একজন ব্যবসায়ী সব সময় তাঁর নিজস্ব লাভ লোকসানের হিসাব নিকাশ করতেই ব্যস্ত থাকেন। তাঁর অধীনস্থ কর্মচারীরা আদৌ কতটা লাভ করল তা নিয়ে অবশ্য খুব একটা মাথা ব্যাথা থাকেনা ব্যাবসায়ীদের। আর তাই তো দেশের সেরা ব্যবসায়ীর বিলাশবহুল বহুতল বাসস্থান তৈরি হয় দেশের সবথেকে বড় বস্তি এলাকার ঠিক পাশেই, আর সমাজে আর্থিক উচ্চ-নীচ ভেদাভেদের সাক্ষী হয়ে বুকের উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে দর্প। আর একজন উদ্যোগপতির ছত্র ছায়ায় বেড়ে ওঠে লাখ লাখ মানুষের আশা, পূর্ণতা পায় স্বপ্ন এবং বেঁচে থাকে মানবিকতা। তাঁর কথার এরকমই ব্যখ্যা করে থাকেন বিশেষজ্ঞরা। আর যাঁর কথা হচ্ছে তাঁর পরিচয় দেওয়ার জন্য যে কোনও বিশেষণ কম পড়ে, কারণ সেই অমূল্য রত্নের নাম রতন টাটা।
কী বলছে ফোর্বস তালিকা?
বিশ্বজোড়া ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে কার কত সম্পত্তি, কে কত ধনী, সেই হিসেব-নিকেশ করে যে সংস্থা সেরা ধনীদের নিয়ে তালিকাবদ্ধ করে থাকে সেই সংস্থার নাম ফোর্বস। আর ফোর্বসের তালিকা অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির নাম হল টেসলা এবং বর্তমানে টুইটারের মালিক ইলন মাস্ক। এই মুহূর্তে তাঁর মোট সম্পত্তির মূল্য ২৬৮ বিলিয়ন বা ২১ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার। আর সেই তালিকায় সেরাদের শীর্ষে নাম আছে ভারতের গৌতম আদানি ও মুকেশ আম্বানিরও। কিন্তু সেখানে নাম খুঁজে পাওয়া যায় না রতন টাটার।
রতন টাটার সম্পত্তি কত?
কিন্তু এখন কথা হচ্ছে রতন টাটার নাম কেন থাকেনা ফোর্বসের সেরা ধনীদের তালিকায়? তাহলে কি রতন টাটার সম্পত্তির পরিমাণ আদানী, রিলায়েন্স বা সেরামের থেকে এতটাই কম? এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য যে কারও চোখ কপালে তুলতে পারে নিমেষেই। কারণ গত ৬০ বছর ধরে ভারতে আলপিন থেকে এরোপ্লেন, সবকিছুতেই একটাই নাম শোনা যায় আর তা হল 'টাটা এন্ড সন্স'। এই মুহূর্তে টাটা গোষ্ঠী পরিচালনা করছে ৯৬টি কম্পানি। সেখানে ৩০টি প্রতিষ্ঠান 'পাবলিকলি লিস্টেড' হিসেবে অবস্থান করছে। এ তালিকায় আছে টাটা স্টিল, টাটা মটরস, টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস। টাটা পাওয়ারসহ বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান। হিসেব মত দেখতে গেলে টাটাদের মোট আয়ের পরিমাণ ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা, তাও মাত্র এক মাসে! আর যেখানে অন্যান্য ধনী কম্পানীর মাসিক আয় হিসেব করলে ১ লাখ কোটি টাকাও মাসিক হিসেবে উঠবে না। আর এই সামান্য হিসেব থেকেই স্পষ্ট যে কত টাকার সম্পত্তি রয়েছে 'টাটা অ্যান্ড সন্স' এর কোষাগারে।
তবু কেন সেরা ধনী নন রতন টাটা?
সবথেকে বড় প্রশ্ন এখন এখানেই, যে এত বিপুল অঙ্কের টাকাধারী কোম্পানির চেয়ারপার্সন হয়েও কেন ফোর্বসের সেরা ধনীদের তালিকায় নাম থাকেনা রতন টাটার? আর এটাই হল তাঁর দেওয়া ব্যবসায়ী বনাম উদ্যগপতি তুলনার উত্তর। অবাক করা বিষয় এই যে, টাটা গ্রুপের লাভের একটি বড় অংশ সরাসরি চলে যায় বিভিন্ন রকম জনহিতকর কাজে। বিষয়টা সামান্য বিষদে বোঝা যাক। টাটা সন্সের ইক্যুইটির ৬৬ শতাংশ টাটা ট্রাস্টের হাতে ন্যাস্ত রয়েছে। টাটা অ্যান্ড সন্সের লভ্যাংশ সরাসরি ট্রাস্টের খাতে জমা হয়, আর সেখানথেকেই সকল কর্মচারীদের বেতন, বোনাস সহ লাখ লাখ মানুষের সেবায় খরচ হয়, যার মধ্যে রয়েছে ফ্রি তে লেখাপড়া করানো থেকে বিনামূল্যে ক্যানসারের চিকিৎসা করা। আর সবথেকে বড় কথা হল মানবকল্যাণের জন্য টাটা গ্রুপের এই বিপুল অনুদান কেবল ভারতেই সীমাবদ্ধ নয়, তা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাতেও যায়।
টাটার অনুদানের অঙ্ক
টাটা অ্যান্ড সন্সের বিভিন্ন খাতে মানবকল্যাণে অনুদানের পরিমানটাও নেহাত কম নয়, বরং সেই অঙ্কটা তাক লাগানোর মতই। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে ৫০ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে টাটা গোষ্ঠী, যা কোনও আন্তর্জাতিক ডোনারের কাছ থেকে পাওয়া সর্বোচ্চ অর্থ। হোম পিউরিফিকেশন সিস্টেমের জন্য টাটা ব্যয় করেছে ১০০০ কোটি টাকা। ক্যানসার চিকিৎসার জন্য প্রতি বছর টাটা গোষ্ঠীর বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ ১০০০ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, টাটা গোষ্ঠী কর্মীদের আধুনিক পেনশন সিস্টেম, চিকিৎসা সেবা, মাতৃত্বকালীন ছুটি আর আরও অনেক সুবিধা প্রদান করে বিনামূল্য। আর যে টাকার পরিমাণ প্রতি বছর বৃদ্ধি পায়। আর বাকি সকল অনুদানের অঙ্ক হিসেবের খাতার বাইরে।
উন্নয়নের জন্য টাটার উদ্যোগ
দ্য এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট, দ্য জেআরডি টাটা ইকোটেকনলজি , ন্যাশনাল সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্টস, টাটা সেন্টার ফর টেকনলজি অ্যান্ড ডিজাইন অ্যাট বম্বে আইআইটি, টাটা সেন্টার ফর টেকনলজি অ্যান্ড ডিজাইন অ্যাট ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনলজি, টাটা ক্রিকেট একাডেমি, টাটা ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনিং সেন্টার, টাটা ফুটবল একাডেমি, টাটা মেমোরিয়াল ক্যানসার হসপিটাল, এগুলি হল টাটা গোষ্ঠীর অসামান্য অবদানের সামান্য একটি তালিকা, আর যাতে নয়া সংযোজন আসামে ১৭টি নতুন ক্যানসার হাসপাতাল ও মেডিকেল হাব গঠন। আর এর থেকেই স্পষ্ট যে রতন টাটার নাম বিশ্বের সেরা ধনীর তালিকায় না থাকলেও তাঁর স্থান স্বয়ং ঈশ্বরের সিংহাসনে, এমনটাই মনে করেন বিশ্ববাসী।