গল্প অসমাপ্ত রেখেই পাড়ি জমালেন চাঁদনি, বিদায়কালে তৈরি করলেন এক মিথ
স্বপ্নের নায়িকার জন্য এই টানটা এতটাই প্রগাঢ় ছিল যে অনেকে আবেগের বাধ রাখতে পারেননি। বুধবার লোখান্ডওয়ালার সেলিব্রেশন স্পোর্টস কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে ভিলে পার্লে শ্মশান সবখানেই ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো
রাজবধূর সাজ তাঁর। দামি বেনারসির ঘোমটায় যেন ঘুমন্ত এক নববধূ। গলায় হার। বিদায়কালে এমনই সাজে সজ্জিত হলেন শ্রীদেবী। রবিবার ভোররাতে যখন তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়েছিল তখন থেকে অগুণিত শ্রীদেবী অনুরাগী উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছিলেন। এঁদের সকলেরই একটা জিনিস কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল আর দেখা হল না প্রিয় নায়িকার সেই চাঁদপানা মুখটা। যে মুখের দিকে তাকিয়ে কত জন ছোট থেকে মনে মনে তাঁর মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখত।
স্বপ্নের নায়িকার জন্য এই টানটা এতটাই প্রগাঢ় ছিল যে অনেকে আবেগের বাধ রাখতে পারেননি। বুধবার লোখান্ডওয়ালার সেলিব্রেশন স্পোর্টস কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে ভিলে পার্লে শ্মশান- এই সব স্থানে এমনকিছু মানুষ এসেছিলেন যাঁদের কাছে শ্রীদেবী এক স্বপ্ন। যে স্বপ্নের সঙ্গে তাঁরা ছোট থেকে বড় হয়েছেন। যে স্বপ্নের সঙ্গে নিয়ত তাঁদের বাস। কিন্তু, সেই স্বপ্নের নায়িকার আর সমস্ত অস্তিত্ব বুধবারের মুছে যাবে!মানতে পারেননি। রাজস্থানের এক গ্রাম থেকে একদল মহিলা এসেছিলেন। রাতেই ট্রেনে চেপেছিলেন তাঁরা। চিরঘুমে শায়িত শ্রীদেবীর নশ্বর দেহে তাঁরা শ্রদ্ধাঞ্জলিও অপর্ণ করেন। চোখে-মুখে এক পরম তৃপ্তি নিয়ে কোরাসে তাঁরা গেয়েও ফেলেন শ্রীদেবীর একের পর এক হিট গান। এখানেই শেষ নয় নাগপুরের এক মহিলা ট্রেন লেট করায় দেরিতে পৌঁছেছিলেন লোখান্ডওয়ালার সেলিব্রেশন স্পোর্টস ক্লাবে। সময় পেরিয়ে যাওয়ায় শ্রীদেবীর নশ্বর দেহের দর্শন পাননি। ডুকরে সেখানেই কেঁদে ওঠেন। সিনেমায় শ্রীদেবীকে দেখে নাকি বোন মেনেছিলেন তিনি। বারাণসীর এক যুবক, মুম্বই কেমন শহর তা জানেন না। বাণিজ্য নগরের পরিচিতি তাঁর কাছে নাকি শুধুই শ্রীদেবীর জন্য। লোখান্ডওয়ালা পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। তাই জিজ্ঞেস করে করে হাজির হয়েছিলেন ভিলে পার্লে শ্মশানে। পুলিশের ব্যারিকেড আর লাখো মানুষের ভিড়ে বেশিদূর এগোতে পারেননি। চোখের সামনেই দেখেন শ্রীদেবীর বিশাল ছবি টাঙানো শকটটাকে বেরিয়ে যেতে।
আসলে যে অভিনয় দক্ষতা, রূপের জাদু দিয়ে শ্রীদেবী তাঁকে ঘিরে মায়াবী জগত তৈরি করেছিলেন- তা বাইরে থেকে দেখতে বড়ই ভালো লাগে। কিন্তু সেই মায়াবী জগতের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা শ্রীদেবী জানতেন এর পিছন দিকটা কতটা অন্ধকারের, কতটা নিঃসঙ্গতার। ব্যক্তিগত জীবন থেকে পেশাগত জীবন সবসময়ই একটু ভালবাসার তিতিক্ষায় নিজেকে নিংড়ে দিয়েছিলেন। মাত্র ৪ বছর বয়সেই সিনেমায় অভিনয়। সেই বয়সে কাজে নামা যতটা না প্রতিভা প্রদর্শনের ছিল, তার থেকে বেশি ছিল সংসার চালানোর দায়ভার। বাবা আইনজীবী। কিন্তু, শ্রীদেবী কোনওদিনই স্কুলে যাননি। একটা সময় বলেছিলেন, 'আমি সেই অভাগা যে কোনও দিনই স্কুলে যেতে পারিনি, তবে সেই অভাব আমি অন্য়ভাবে মেটানোর চেষ্টা করি।'
ছোট থেকে বাবা-মা-র জন্য টাকা তৈরির মেশিন তিনি। সেখানে যখনই স্বার্থের সংঘাত লেগেছে তখনই ফোঁস করে ওঠেছেন শ্রীদেবীর মা। গ্ল্য়ামার-রানির দুয়োরানির অবস্থা। নিজের উপার্জনের উপর নিজেরই নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এমনকী, নিজের মায়ের পেটের বোনও ছাড়েননি। তিনি আবার সম্পত্তির জন্য মামলা করে দিয়েছিলেন। সবকিছুই মুখ বুঝে সহ্য করতেন। শুধুই একটা চেষ্টা- সবকিছু ঠিক করতে হবে। জীবন তাঁর উপর করাল অভিঘাত নিয়ে হামলে পড়েছে কিন্তু হার মানেননি। পজিটিভিটি- এই একটা শব্দেই বারবার চেষ্টা করে গিয়েছেন জীবনটাকে সুন্দর করার। এমনই জীবনে চলার পথে হাত ধরেছিলেন এক বাঙালি নায়ক। আজও দাবি করা হয় মন্দিরে বিয়েও হয়েছিল তাঁদের। কিন্তু, বিধি বাম। সেই বাঙালি নায়কের বউ ছুটেছিলেন আত্মঘাতী হতে। ব্যাস, আর যান কোথায় শ্রীদেবী। বিবাহিত পুরুষের সংসার ভাঙার জন্য লোকে অভিশাপের পর অভিশাপ দিতে থাকে। সেই দুয়োরানির অবস্থা। সে সময় নাকি বলিউডে যে সব পুরুষ শ্রীদেবীর সঙ্গে কাজ করতেন তাঁদের বউ-রা নাকি কালো টিকা দিয়ে স্বামীকে কাজে পাঠাতেন- অনেকটা 'বুড়ি নজর বালে তেরা মু কালা'-র মতো।
শ্রীদেবীর এমন এক দুনিয়ায় বনি কাপুরের আবির্ভাবটা আকস্মিক ছিল না। ফিল্মি পরিবারের ছেলে বনি। সিনেমা পরিচালনা করতে গিয়ে জীবনে প্রচুর ওঠা-নামা দেখেছিলেন। শ্রীদেবীর সঙ্গে অনেক কাজ করেছিলেন। মিস্টার ইন্ডিয়া, রূপ কি রানি চোরো কা রাজা-র প্রযোজক ছিলেন তিনি। শ্রীদেবীর এই নিঃসঙ্গতার সন্ধান পেয়েছিলেন বনি। তাঁকে মানসিকভাবে শক্তি জোগাতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন এক সম্পর্কের চোরাবালিতে। পরিণতিতে শ্রীদেবী ও বনির বিয়ে। গোপনে নয় এক্কেবারে সকলকে জানিয়েই। কারণ, বাঙালি নায়কের সঙ্গে গোপন বিয়ের আতঙ্ক তখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে শ্রীদেবীকে।
স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে বর্তমান তবু শ্রীদেবীকে বিয়ে করতে পিছপা হননি বনি। বিনিময়ে শ্রীদেবীর কপালে আবার সেই দুয়োরানির মতো ধিক্কার। এবার তো আরও ভয়ঙ্কর-শাশুড়ি শ্রীদেবীর পেটেই ঘুষি মেরে বসেছিলেন। শ্রীদেবী তখন কয়েক মাসের সন্তানসম্ভবা। এমনকী, বনির প্রথম স্ত্রী ক্যানসারে আক্রান্ত মোনার মৃত্যুর জন্যও শ্রীদেবীকে দায় নিতে হয়েছিল। বনির ছেলে অর্জুন কাপুর এবং মেয়ে কোনওদিনই শ্রীদেবীকে মেনে নেননি। যে দুয়োরানির কপাল থেকে পালিয়ে যেতে চাইছিলেন শ্রীদেবী, জীবনের আবর্তে সেই পরিস্থিতিতেই তিনি পর্যবাসিত হন। কম গজ্ঞনা সহ্য করতে হয়নি। বলিউডে মিথ তৈরি করা, পুরুষশাসিত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথম 'সুপারস্টার' অভিনেত্রীর তকমা পেয়েও তাঁর মনে শান্তি ছিল না। সারাক্ষণ ভাবতেন কেউ তাঁকে আদপে সম্মান করে না। তবে, তাঁর একটাই শান্তি- স্বামী বনি। যেন বুক দিয়ে শ্রীদেবীকে রক্ষা করে যেতেন তিনি। বনি কাপুরের এই আচরণ যেন ছিল শ্রীদেবীর রক্ষাকবচ। যত বয়স হচ্ছিল ততই এই রক্ষাকবচকে সারাক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকতে চাইছিলেন। স্বামীকে একটা মুহূর্তের জন্য চোখের আড়ালে যেতে দিতে রাজি ছিলেন না। এই একটা নির্ভরতাই ছিল শ্রীদেবীর শক্তি। বিশেষ করে শ্বশুরবাড়ির চৌহদ্দিতে বনি কাছছাড়া হওয়া মানে যেন একটা আতঙ্ক তাড়া করত তাঁকে। এক বিপন্নভাব খেলা করত মনের মধ্যে।
এই বিপন্নতার করাল গ্রাসেই কি হারিয়ে গেলেন শ্রীদেবী? ঝাঁ-চকচকে এক জীবনের পিছনে থাকা এই আসল জীবন-যুদ্ধের কাহিনি যা হয়তো বেস্ট-সেলার হতে পারত সেই গল্পকে অসমাপ্ত রেখেই বিদায় নিলেন চাঁদনি। তবে মরে গিয়ে মিলিয়ে দিলেন বনি কাপুর ও অর্জুন কাপুরকে। সৎ ছেলে অর্জুনকে বুঝিয়ে দিলেন দাদা হিসাবে মা-হারা বোনেদের প্রতি তাঁর কর্ত্যবের কথা। দুয়োরানির কপালের এক সমাপতন। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের কাদম্বরির মতো। যেন মরে গিয়ে শ্রীদেবী বোঝালেন তাঁর অন্তরের হাহাকারকে।