করোনা থেকে সুশান্ত সিং, যেসব ইস্যুকে হাতিয়ার করে বিহার নির্বাচনের ঘুঁটি সাজাচ্ছেন নীতীশ-তেজস্বীরা
বেজেছে নির্বাচনী নির্ঘণ্ট, বিহার নির্বচনী লড়াইয়ের হাতিয়ারে শান দেওয়া শুরু করে দিয়েছে দলগুলি। করোনা পরিস্থিতির মাঝেই বিহার বিধানসভা ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করল নির্বাচন কমিশন। তিন দফায় ভোট হবে বিহারে। ২৮ অক্টোবর, ৩ ও ৭ নভেম্বর হবে ভোটগ্রহণ। গণনা হবে ১০ নভেম্বর। এই আবহে কোন কোন ফ্যাক্টরগুলির উপর নির্ভর করে রাজনৈতিক দলগুলি নিজেদের ঘুঁটি সাজাবে, দেখে নেওয়া যাক একনজরে।
করোনা আবহে ভোটার সংখ্যা নিয়ে আসঙ্কা
বিহারের ২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দেখা গিয়েছিল যে ৫৬.৮ শতাংশ ভোটার নির্বাচনে নিজেদের মতামত প্রকাশ করেছিলেন। এর একটা মূল কারণ ছিল বিপুল সংখ্যায় মহিলাদের ভোটদানে অংশগ্রহণ করা। তবে বর্তমান পরিস্থিতি করোনার আবহে সেই ভোটার সংখ্যা বজায় রাখা এক বড় চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া বিহারের ১৮টি জেলা বন্যা কবলিত। এই পরিস্থিতিতে সেখানেও ভোটাররা কতটা মতপ্রকাশ করতে কেন্দ্রে আসবে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে। এর উপর নির্ভর করে থাকবে অনেক কিছু। যে দল করোনা আবহের মাঝেও নিজের সমর্থককে ভোট কেন্দ্রে পৌঁছে দেবে, জয় তারই হবে।
ডিজিটাল লড়াই
এই নির্বাচন ভারতে এক নয়া ট্রেন্ড সৃষ্টি করেছে। করোনার আবহে সম্ভবত বিহারই প্রথম রাজ্যে হবে, যেখানে বিধানসভা নির্বাচন আয়োজিত হতে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে বিহারে বহু আগেই ডিজিটাল প্রচার চালু করে দেয় বিজেপি। সেই জুন মাসেই বিহারের ৭০টি বিধানসভা কেন্দ্রে ভার্চুয়াল ব়্যালি ও জনসংবাদ করে ফেলে বিজেপি। ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে বিজেপি ক্যাডাররা ও সাধারণ জনগণের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বিরোধীরা সেভাবে প্রচার শুরু করতে পারেনি বিহারে। তবে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রচারের ময়দানে এগিয়ে গিয়েছে বিজেপি।
সুশান্ত সিং রাজপুতের মামলা
বিহারের ২৪৩টি আসনের নির্বাচনের ক্ষেত্রে বড় অ্যাজেন্ডা হতে চলেছে প্রয়াত অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মামলা। ইতিমধ্যেই বিহার নির্বাচনের ময়দান গরম করে সুশান্ত সিং রাজপুতের ছবি সহ ফ্লেক্স লাগিয়েছে বিজেপি। তাতে লেখা - 'আমরা ভুলিনি, আর ভুলতেও দেব না।' পাশেই পদ্মফুলের ছবি। বিহার বিজেপির সেই 'জাস্টিস ফর সুশান্ত' অ্যাজেন্ডা কাজে লাগাতে মহারাষ্ট্র থেকে দেবেন্দ্র ফড়নবিশকে পর্যবেক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছে বিহারে।
পরিযায়ী শ্রমিক ফ্যাক্টর
এবারের নির্বাচনে আরও একটি বড় ফ্যাক্টর হতে চলেছে পরিযায়ী শ্রমিক। করোনা আবহে গত কয়েকমাসে রাজ্যে ফিরেছেন ৩০ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক। সাধারণত নির্বাচনের জন্যে এই শ্রমিকরা বাড়ি ফিরত না, তবে পরিস্থিতির জন্য বাধ্য হয়ে তারা নির্বাচনের সময়ে রাজ্যে থাকবেন। এর জেরে এক বড় বদল দেখা যেতে পারে ভোটের রেজাল্টে। প্রসঙ্গত, এর আগে পরিযায়ীদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে বিরোধীদের রোষের মুখে পড়তে হয়েছিল নীতীশ কুমারকে। শুধু তাই নয় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যখন কোটা থেকে বিহারের আটকে পড়া ছাত্রদের রাজ্যে ফেরানোর জন্য সাহায্য দেওয়ার কথা বলেছিলেন, তখন তা গ্রহণ না করে ছাত্রদের রাজ্যে ফেরাতে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন নীতীশ।
কর্মসংস্থান এবং বেকারত্ব
চাকরি বা কর্মসংস্থান চিরকালই বিহারের জন্য একটি মাথা ব্যথার কারণ ছিল। এর জেরেই এত সংখ্যক পরিযায়ীরা অন্য রাজ্যে কাজের সন্ধানে চলে যেতেন। তাই স্বাভাবিকভাবে নির্বাচনের সময় কর্মসংস্থান একটি বড় ফ্যাক্টর হিসাবে দেখা দেয়। এবং এই নির্বাচনেও নীতীশ এবং বিজেপির বিরুদ্ধে বেকারত্বকে ইস্যু করে আক্রমণ শানাচ্ছেন বিরোধীরা। প্রসঙ্গত, চলতি বছরে বিহারে বেকারত্বের হার ৪৬.৬ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে, যা নীতীশ কুমারের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলার জন্য যথেষ্ট।
জাত ভিত্তিক রাজনীতি
ধর্মের ভিত্তিতে রাজনীতি বা জাত-পাতের নিরিখে রাজনীতি খাতায় কলমে 'উচিত' না হলেও ভারতের রাজনীতিতে এটা সব থেকে বড় ফ্যক্টর। হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলির মধ্যে বিহারে এই ইস্যুটি আরও বড় হয়ে দেখা দেয়। দলিত রাজনীতি বিহারে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি থেকেও বড় ফ্যাক্টর। তাই উত্তরপ্রদেশের মতো এখানে বিজেপির জন্য নিজেদের ভোট কেন্দ্রীভূত করাটা অত সহজ নয়। মূলত বিজেপিকে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দল হিসাবে দেখা হয়। সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই জিতেন রাম মাঝিকে এনডিএতে নিয়েছে। তবে এই ক্ষেত্রে আরজেডি-কংগ্রেসদের পাল্লা ভারী বলে মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।
ধর্মের নিরিখে ভোট টানা
এদিকে হিন্দু ভোট এক করতে গিয়ে রামমন্দির ইস্যুকে যেভাবে বিজেপি কাজে লাগিয়েছে তাতে নীতীশ কুমারের দলের থেকে মুসলিম ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নিলে আশ্চর্য হয়ার কিছু নেই। শুধু তাই নয়, সিএএ-এনআরসি নিয়েও নীতীশের দল সংখ্যালঘু ভোটারদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। সেখানে বিরোধীদের পাল্লা ভারী হওয়ার কথা থাকলেও সেখানে নয়া প্লেয়ার হিসাবে উঠে এসেছে ওয়েইসির দল এআইএমআইএম। বিহারে প্রায় ৮০টি এমন আসন রয়েছে যেখানে সংখ্যালঘুরা বড় ফ্যাক্টর। এই ক্ষেত্রে ওয়েইসির সাফল্যের উপর নির্ভর করবে এনডিএ-র সাফল্য।
কৃষি বিল ইস্যু
কৃষি বিল গোটা দেশেই আন্দোলন গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বিরোধী জোটের। তবে বিহারে এই বিলের বিরোধিতা করতে দেখা যায়নি কৃষকদের। মনে করা হচ্ছে এনডিএ-র এই বিল সাধারণ মানুষের কতটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, তা প্রমাণিত হবে বিহার নির্বাচনে। বিল নিয়ে বিজেপির দাবি কী মানতে চলেছেন কৃষি নির্ভর একটি রাজ্যের সাধারণ ভোটাররা, নাকি বিরোধীদের সুরে সুর মিলিয়ে তাদের মনেও এই বিলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি
বিহারে ২০০৫ সালে নীতীশ কুমার যেবার প্রথমবার লালু প্রসাদকে হারিয়ে গদিতে বসেছিলেন, সেবার সবথেকে বড় নির্বাচনী ফ্যাক্টর ছিল রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। এরপর ১৫ বছরে গঙ্গা দিয়ে গড়িয়েছে অনেক জল। এর মাঝেই এক সময়ের চির প্রতিদ্বন্দ্বী আরডেডির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন নীতীশ। পরে ফের মোদী বিরোধিতা ছেড়ে বিজেপির সঙ্গ নিতে বাধ্য হয়েছিলেন নীতীশ। তবে আইনশৃঙ্খলার ইস্যুটি এখন রয়ে গিয়েছে। পরিস্থিতি আগের থেকে ভালো কি খারাপ, তার বিচার না করে বিরোধীদের কাছে এটা এখটি বড় হাতিয়ার।
লাদাখের ড্রাই পিচে যেভাবে মোদী-শাহ জুটিকে ভরসা যোগাচ্ছেন 'অপরিহার্য' রাজনাথ সিং!