স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছু স্বল্পপরিচিত নায়ক, ইতিহাস এঁদের প্রায় ভুলতেই বসেছে
দীর্ঘ সংগ্রামের পর ভারত ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক নায়কই আজ ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যেতে বসেছেন। সেরকম কয়েকজন নায়ককে স্মরণ করা হল।
অ্যামাজন বা ফ্লিপকার্টে অর্ডার দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা মেলেনি। তা অর্জন করতে হয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেই সংগ্রামের বহু নায়ককেই মনে রাখেনি ইতিহাস। যেরকম বিশ্বের ইতিহাস থেকেও হারিয়ে গিয়েছেন বহু নায়ক-নায়িকা। তাতে অবশ্য তাঁদের কিছু এসে যায়নি। কারণ ইতিহাসের পাতায় নাম তোলা নয়, তাঁদের এক ও একমাত্র লক্ষ্য ছিল ভারতরকে ইংরেজ কবল থেকে মুক্ত করা। আরও এক স্বাধীনতা দিবসের আগে স্মরণ করা হল এরকমই বিস্মৃতপ্রায় কিছু ব্যক্তিত্বকে।
মাতঙ্গিনী হাজরা
মহাত্মা গান্ধীর ডাকে ভারত ছাড় আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। মেদিনীপুরে তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একটি মিছিল চলাকালীন ব্রিটিশ পুলিশের গুলি এসে লাগে তাঁর দেহে। তবু তিনি চলা থামাননি। হাতে তেরঙ্গা, মুখে বন্দেমাতরম স্লোগান নিয়ে শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও তিনি সেইদিন এগিয়ে গিয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন নিয়ে।
বেগম হজরত মহল
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন বেগম হজরত মহল। আওয়াধের নবাবকে ইংরেজরা নির্বাসিত করলে তিনি আওয়াধের ক্ষমতা হাতে তুলে নেন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়াধবাসী ইংরেজ সাসিত লখনউ শহর অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। পরে অবশ্য তাঁকে পিছু হঠতে হয়। শেষ পর্যন্ত বেগম হজরত আশ্রয় নিতে বাধ্য হন নেপালে। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
সেনাপতি বাপাত
স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম স্বাধীন ভারতের পতাকা তোলার মর্যাদা পেয়েছিলেন এই গান্ধীবাদী নেতা। মুলসি সত্যাগ্রহের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁকে সেনাপতি বলে ডাকা হত। ইংরেজ সরকার তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা ও ভাঙচুর চালানর অভিযোগ আনে। এই অভিযোগ ওঠার পর তিনি নিজেই আত্মসমর্পন করেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে। কারণ সত্যাগ্রহী হিসেবে হিংসার পথ নেওয়া তাঁর উচিত হয়নি বলে মনে করেছিলেন সেনাপতি বাপাত। দীর্ঘদিন জেলে কাটাতে হয় তাঁকে।
অরুণা আসাফ আলি
মহাত্মা গান্ধীর সহযোদ্ধা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। কিন্তু সেভাবে কোনওদিনই প্রচারে ছিলেন না। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনের সময় বম্বের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানে বারতের জাতীয় কংগ্রেসের পতাকা তুলেছিলেন এই বীরাঙ্গনা।
পত্তি শ্রীরামুলু
গান্ধীর একনিষ্ঠ সমর্থক ও ভক্ত বলা যায় তাঁকে। গান্ধীর মানবতার আদর্শকে সামনে রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। দেশ ও মানবতার প্রতি তাঁর এই নিষ্ঠা ও কর্তব্যবোধ দেকে মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং গান্ধী। একবার শ্রীরামুলু সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, 'আমার যদি শুধুমাত্র শ্রীরামুলুর মতো আর ১১ জন সমর্থক থাকত, তবে এক বছরেই স্বাদীনতা অর্জন করতে পারতাম।'
ভিকাজি কামা
ভারতের অনেক শহরেই কামার নামে সড়ক বা ভবন রয়েছে। তাই তাঁর নামটি অনেকেই জানেন, কিন্তু যেটা জানা নেই তা হল তিনি কে, এবং তিনি কি করেছিলেন। স্বাধীনতার লড়াই শুধু ইংরেজ ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে নয়, কামা বুঝেছিলেন প্রকৃত স্বাধীন হতে গেলে দূর করতে হবে লিঙ্গ বৈষম্যও। তাই স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার লড়াইও তিনি চালিয়ে গিয়েছেন সারা জীবন ধরে। এমনকী মৃত্যুর পর তাঁর যাবতীয় সঞ্চয় তিনি দান করা যান মেয়েদের জন্য তৈরি এক অনাথ আশ্রমে। ১৯০৭ সালে জার্মানির স্টুটগার্টে ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কনফারেন্সে তিনি স্বাধীন ভারতের পতাকাও উত্তোলন করেছিলেন।
তারা রানী শ্রীবাস্তব
স্বামীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সিওয়ান থানার সামনে এক ব্রিটিশরাজ বিরোধী মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন তারা রানী শ্রীবাস্তব। ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে বিদ্ধ হন তাঁর স্বামী। কিন্তু তাতে দমে যাননি তারা রাণী। স্বামীর ক্ষতে ব্যান্ডেজ বেঁধে বাকিদের সঙ্গে এগিয়ে যান মিছিলে। মিছিল থেকে ফিরে দেখেছিলেন স্বামীর মৃত্য়ুর হয়েছে। কিন্তু সেই মৃত্যু তাঁকে স্বাধীনতার জন্য আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তোলে। শেষ পর্যন্ত সংগ্রামের পথেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। শেষ অবধি তাঁর হাতে উঁচু করে ধরা ছিল স্বাধীন ভারতের তেরঙ্গা।
কানাইয়ালাল মানিকলাল মুন্সি
কানাইয়ালাল মানিকলাল মুন্সি বেশি পরিচিত ছিলেন কূলপতি নামে। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের অন্যতম এই সেনানির হাতেই গড়ে উঠেছিল ভারতীয় বিদ্যাভবন। আন্দোলন করতে গিয়ে জীবনে বহুবার গ্রেফতার হয়েছেন কূলপতি। কিন্তু তাও আন্দোলনের পথে থেকে তাঁকে সরাতে পারেনি ব্রিটিশ সরকার। দেল থেকে বেরিয়ে আবার নেমে পড়েছেন স্বাধীনতার আন্দোলনে।
পীর আলি খান
ভারতের
স্বাধীনতা
সংগ্রামের
একেবারে
উষাকালের
বিদ্রোহীদর
একজন
ছিলেন
পীর
আলি
খান।
২৮৫৭
সালের
মহাবিদ্রোহে
যোগ
দিয়েছিলেন
খান।
সেই
বিদ্রোহের
পর
যে
১৪
জন
ভারতীয়কে
মৃত্যুদণ্ড
দেওয়া
হয়েছিল
তাঁদের
একজন
পীর
আলি
খান।
কিন্তু
আজ
তাঁর
নাম
ইতিহাস
থেকে
প্রায়
হারিয়েই
গিয়েছে।
কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়
ভারতের আইনসভায় স্থান পেতে প্রথম যে মহিলা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি হলেন কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায়। আবার ব্রিটিশ সরকারের হাতে গ্রেফতার হওয়া প্রথম ভারতীয় মহিলাও তিনিই। ভারতের সমাজ সংস্কারের তাঁর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভারতীয় মহিলাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে তিনি থিয়েটার, হ্যান্ডলুম, হ্যান্ডিক্র্যাফ্টকে হাতিয়ার করেছিলেন।
গরিমেল্লা সত্যনারায়ণ
প্রায় একার হাতে অন্ধ্রের বাসিন্দাদের স্বাধীনতার লড়াইতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন গরিমেল্লা সত্যনারায়ণ। তাঁর লেখা অসংখ্য দেশাত্মবোধক কবিতা গান অন্ধ্রবাসীকে তাতিয়ে তুলেছিল ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে।
তিরুপুর কুমারণ
দেশ বন্ধু ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিরুপুর কুমারণ। ১৯৩২ সালের ১১ জানুয়ারি এক মিছিলে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে ব্রিটিশ পুলিশ। ভারতের জাতীয় পতাকাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু কুমারণ সেই পতাকা হাতেই মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। এমনকী মৃত্যুর পরও তাঁর হাতে শক্ত করে ধরা ছিল সেই পতাকা।
রাজকুমারী গুপ্ত
তিনি ও তাঁর স্বামী দুজনেই মহাত্মা গান্ধী ও চন্দ্রশেখর আজাদের অনুগামী ছিলেন। কাকরির ট্রেন লুন্ঠনের ঘটনায় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বিপ্লবীদের হাতে অস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তাঁর উপর। সে কাজে তিনি সফলও হন। আগ্নেয়াস্ত্রগুলি তিনি জামাকাপড়ের নিচে লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। পুলিশের সন্দেহমুক্ত হতে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ৩ বছরের পুত্রকেও। পরে অবশ্য ধরাও পড়ে যান। দুর্ভাগ্যের জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাঁকে অস্বীকার করা হয় তাঁর শ্বশুর বাড়ি থেকে।
ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজ বাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিলেন লক্ষ্মী সেহগল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সেনার হয়ে লড়াই করার অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। সুভাষচন্দ্র বসু মহিলা সেনাদেরও নিয়েগ করছেন শুনে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন লক্ষ্মী। তাঁকে মহিলাদের নিয়ে 'ঝাঁসির রানী রেজিমেন্ট' গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন নেতাজী। সেই বাহিনীর ক্যাপ্টেন করা হয় তাঁকে।
বীরসা মুন্ডা
মাত্র ২৫ বছর বয়সে মৃত্যু হয় বীরসা মুন্ডার। কিন্তু এই স্বল্পজীবনেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গুরুত্বপূর্ণ বীমিকা নিয়েছিলেন এই আদিবাসী নেতা। তাঁর নেতৃত্বেই ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ। যা ১৯ শতকের শেষভাগে বর্তান বিহার-ঝাড়খণ্ড এলাকার সমস্ত আদিবাসী জনজাতিগুলিকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল।