স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই অযোধ্যায় দানা বেঁধেছিল রাম জন্মভূমি–বাবরি মসজিদ বিতর্ক
স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই অযোধ্যায় দানা বেঁধেছিল রাম জন্মভূমি–বাবরি মসজিদ বিতর্ক
ভারত স্বাধীন হওয়ার ৭০ বছর এবং ব্রিটিশ শাসনের ৯০ বছর পর অবশেষে এ বছরের ৯ নভেম্বর শনিবার বাবরি মসজিদ–রাম জন্মভূমির জমি বিতর্ক মামলার অবসান হল। দশকের পর দশক ধরে দেশের রাজনীতির গতিমুখ নির্ধারণ করেছে এই মামলা। দেশের ইতিহাসে সম্ভবত এটাই দীর্ঘদিন ধরে চলা বিতর্ক, যেটি চরম পরিণতি পেল শনিবার।
এই মামলা দেখেছে অনেক উত্থান–পতন, হিংসাত্মক ঘটনা, রক্ত, রাজনৈতিক তরজা, সাম্প্রদায়িকতার বিভেদ। কিছুই বাদ যায়নি। কিন্তু শনিবার সেই সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে ঐতিহাসিক রায় শুনিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আসলে এই কয়েক বছরে দেশের আইনও বেশ পরিণত হয়েছে। তাই সবদিক বজায় রেখেই এই মামলায় রায় দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। তবে এই মামলার শুরুটা কিভাবে আর কেনই বা হল তা দেখে নেওয়া যাক।
১৮৫৭ সালে শুরু এই মামলার। এই বছরেই শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ রাজ থেকে দেশকে স্বাধীন করার প্রথম লড়াই। যদিও এই লড়াইয়ের পাশাপাশি খুবই নিঃশব্দে আগুনের এক ছোট্ট ফুলকির মত বিতর্ক দানা বাঁধছিল লখনউ থেকে ১৩০ কিমি দূরে ফৈজাবাদ জেলায়। এই জেলাতেই অযোধ্যার মন্দির শহর। ১৫২৮ সালে অযোধ্যার এই জমিতেই বাবরি মসজিদ নির্মিত হয়। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির দাবি যে মন্দির ধ্বংস করেই এখানে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। তৎকালীন বাবরি মসজিদের দায়িত্বে থাকা মৌলবী মুহাম্মদ আসগর ফৈজাবাদের ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন দিয়ে জানান যে মসজিদ প্রাঙ্গনের পশ্চিম দিকটি হনুমান গরহি জোর করে ছিনিয়ে নিয়েছ। অযোধ্যায় বৈষ্ণব বৈরাগি বলে পরিচিত হনুমান গরহি এখানে তাঁর গোটা ধর্মীয় জীবন কাটিয়েছেন। মৌলবীর অভিযোগের পরই এই জায়গা নিয়ে আইনি বিতর্ক শুরু হয়। যদিও যে জমিতে মসজিদ ছিল, সেই জমি নিয়ে বহু বছর ধরেই বিতর্ক চলে আসছে। সরকারিভাবে জমিটিকে 'বিতর্কিত জমি’ বলে চিহ্নিত করা হয়। ১৮৫৭ সালে আবেদনের পর প্রথম ব্রিটিশ সরকার এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে ১৮৫৯ সালে। তাদের মাথাতেও ধর্মীয় সংঘর্ষের কথা ছিল। প্রশাসন মন্দির–মসজিদের মাঝে একটি দেওয়াল তুলে দেয়। যাতে উভয় ধর্মই নিজ নিজ ধর্মাচার করতে পারে। হিন্দুদের জন্য প্রবেশের পথ করা হল পশ্চিম দিকে এবং মুসলিমরা ঢুকবে উত্তর দিক দিয়ে।
১৮৬০ থেকে ১৮৮৪ সালের মধ্যে মুসলিমরা ফের একই আবেদন করে জানায় যে কিছু স্থানীয় সাধু–সন্ন্যাসী জোর করে মসজিদে ঢুকে পড়ে এবং জমির ওপর অবৈধ দখল করে নেয়। ১৮৬০ সালে করা আবেদনের পর আবার তা করা হয় ১৮৭৭, ১৮৮৩ ও ১৮৮৪–তে। এরপর সব আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়। ১৮৮৫ সালে হিন্দুদের পক্ষ থেকে এ বছরই প্রথম আইনতভাবে প্রতিনিধিত্ব করেন। মহন্ত রঘুবর দাস বিতর্কিত জমিটিকে আইনি উপাধি দেওয়ার জন্য এবং পশ্চিম দিকের প্রাঙ্গন বা 'চবুত্র’তে মন্দির নির্মাণ করার আবেদন করেন। তিনি তাঁর আবেদনে দাবি করেন যে তিনি হলেন ভগবান রামের জন্মস্থানের মহন্ত এবং এই 'চবুত্র’তেই রাম জন্মেছিলেন। সুতরাং প্রথম আবেদনকারীর আবেদন অনুযায়ী 'চবুত্র’কেই রামজন্নমভূমি হিসাবে দাবি করা হয়েছিল। যেখানে মসজিদ ছিল সেই স্থানকে নয়। ১৮৮৬ সালে রঘুবর দাসের আবেদন বাতিল করে দেওয়া হয়। যদিও তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হতে শুরু করে দেয়। দেশের শাসকরা তখন থেকেই এই জমি নিয়ে হিন্দু–মুসলিম বিতর্ক দেখতে শুরু করে। ১৮৭০ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত এই বিতর্ক চলতেই থাকে। তৎকালীন সরকারি নথিতেও এই বিতর্কের কথা উল্লেখ রয়েছে। এমনকী মসজিদের প্রবেশপথে পাথরের ওপর খোদাই করে লিখে দেওয়া হয় যে '১ নম্বর রাম জন্মভূমি’।
দেশ স্বাধীন হওয়ার দু’বছর পর অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের ২২–২৩ ডিসেম্বরে রাম–লক্ষ্মণের মূর্তি বসিয়ে দেওয়া হয় বাবরি মসজিদের ভেতর। এমনকী লোক জড়ো করে মসজিদের ভেতরই কীর্তন শুরু করে দেওয়া হয়। ওই বছরের ২৯ ডিসেম্বর ফৈজাবাদ জেলার বিচারক ঘোষণা করেন যে বাবরি মসজিদ বিতর্কিত সম্পত্তি এবং ওখানে স্থিতীশীল অবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। মসজিদে মুসলিমদের ঢোকার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় এবং মূল ফটকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। ভগবান দর্শনের জন্য হিন্দুদের পাশের গেট দিয়ে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় এবং পুজোর জন্য চারজন পুরোহিতকে নিয়োগ করা হয়। ১৯৫০ সালের ৬ জানুয়ারি হিন্দু মহাসভার সদস্য গোপাল সিং বিশারদ দেওয়ানি মামলা দায়ের করেন। তিনি কোনও বাধা ছাড়াই ওই মসজিদে রাখা ভগবানের পুজো করতে চান এবং ভগবান সরিয়ে দেওয়ার ওপর স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারির জন্য আদালতকে বলেন। এই আবেদনের ন’বছর পর অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে নির্মোহী আখড়া ওই জমির ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ চেয়ে আবেদন করে এবং জানায় যে ওখানে মন্দির ছিল, মসজিদ নয়। ১৯৬১ সালের ১৮ ডিসেম্বর সুন্নি সেন্ট্রাল বোর্ডের পক্ষ থেকে আবেদন করে দাবি জানানো হয় যে বাবরি মসজিদ তাদের দিয়ে দেওয়া হোক। ১৯৮৪ সালে রাম মন্দির নির্মাণের জন্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠন কমিটি গঠন করে। এর তিন বছর পরে জেলা আদালত মসজিদের দরজা খুলে দেওয়ার নির্দেশ দেয় এবং বিতর্কিত কাঠামোর ভেতরে হিন্দুদের আরাধনার অনুমতি দেয়। ১৯৮৯ সালে 'রামলল্লা’কেই এই মামলার প্রধান মামলাকারী করা হয়। দেওকী নন্দন আগরওয়াল রামলল্লার বন্ধু বলে নিজেকে পরিচয় দেন এবং রামলল্লা বিরাজমানের হয়ে তিনি মামলা করেন। ওই বছরই গঠিত হয় বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি।
১৯৯০ সালে তত্কালীন বিজেপি সভাপতি লালকৃষ্ণ আডবাণী রাম মন্দির নির্মাণের সমর্থন আদায়ে গোটা দেশে রথযাত্রায় বের করেন। এর দু’বছর পরই অর্থাৎ ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর হাজার হাজার হিন্দু কর সেবক বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে। নিরুপায় নিরাপত্তারক্ষীদের সামনেই হিন্দু সংগঠনের কর্মীরা মসজিদ ভেঙে দেয়। গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। ওইদিন দু’টি এফআইআর করা হয়। মসজিদ ধ্বংস করার জন্য লক্ষাধিক কর সেবকের নামে অভিযোগ দায়ের হয়। দ্বিতীয় অভিযোগ এলকে আডবাণী, এমএম জোশী, উমা ভারতী, অশোক সিংঘল, গিরিজা কিশোর, ভিএইচ ডালমিয়া, বিনয় কাটিয়ার এবং সাধ্বী রিতম্ভরার বিরুদ্ধে করা হয়। এই আটজন মসজিদ ধ্বংসের আগে প্ররোচনামূলক ও উত্তেজিতময় ভাষণ করেন। রাম জন্মভূমি পুলিশ থানায় এই অভিযোগ দায়ের করা হয়।
২০০২ সালের এপ্রিলে এলাহাবাদ হাইকোর্টে অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে কার অধিকার, সেই নিয়ে শুনানি শুরু হয়। ওই বছরের ১ আগস্ট ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বিতর্কিত জমি খনন করে কাঠামো উদ্ধার করে। ৩০ ডিসেম্বর ফের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ওই জমিতে খনন কাজ চালিয়ে কিছু পুরনো কাঠামো খুঁজে পান। যার রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এলাহাবাদ হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চ রায়দান করে। সেখানে এই জমি তিন ভাগে ভাগ করে নির্মোহী আখড়া, রাম লল্লা ও সুন্নি সেন্ট্রাল ওয়াকফ বোর্ডকে দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় হিন্দু ও মুসলিম দুই পক্ষই।
২০১১ সালে হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এর পরের ছয় বছর সুপ্রিম কোর্টে এই মামলাটি একরকম ঝুলেই ছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই মামলার বিচার চেয়েও কোনও ফল হয়নি। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য বিচারপতি দীপক মিশ্র এবং এরপর রঞ্জন গগৈ প্রথম এই মামলাটি নিয়ে পুনরায় দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ২০১৮ সালে এই মামলার শুনানি শুরু হওয়ার আগেই বিচারপতি দীপক মিশ্র অবসর নেন। ওই বছর অক্টোবরে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব নিয়ে রঞ্জন গগৈ এই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এ বছরের জানুয়ারি থেকে প্রধান বিচারপতি সহ পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ ক্রমাগত এই মামলার শুনানি শুরু করে দেন। গত ৬ আগস্ট প্রতিদিনের ভিত্তিতে এই মামলার শুনানি শুরু হয়। ৪০ দিনের টানা শুনানির পর ১৬ অক্টোবর তা সম্পূর্ণ হয়। ১৭ নভেম্বর এই মামলার রায় ঘোষণা হওয়ার কথা থাকলেও শনিবারই অযোধ্যার ভবিষ্যত নির্ধারণ করে সুপ্রিম কোর্ট।
অযোধ্যা নিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে ত্রুটি কোথায়, বলল সুপ্রিম কোর্ট
রাম-রহিমের জয় নয়, এই জয় ভারত-ভক্তির! অযোধ্যা মামলার রায় ব্যাখ্যা মোদীর