'দেশবাসীকে যা দিয়েছি তার থেকে বেশি পেয়েছি', আবেগমথিত টুইটে প্রতিক্রিয়া ভারতরত্ন প্রণবের
আজ সত্যি বাক্যহারা প্রণব মুখোপাধ্যায়। আবেগে বাকরুদ্ধ হওয়ার মতো বহু ঘটনাই তাঁর জীবনে ঘটেছে। কিন্তু, সেই সব স্মৃতি-ঘটনা আজ কি সত্যি পিছনে পড়ে থাকল?
আজ সত্যি বাক্যহারা প্রণব মুখোপাধ্যায়। আবেগে বাকরুদ্ধ হওয়ার মতো বহু ঘটনাই তাঁর জীবনে ঘটেছে। কিন্তু, সেই সব স্মৃতি-ঘটনা আজ কি সত্যি পিছনে পড়ে থাকল? এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্যই সবচেয়ে ভালোভাবে প্রণব মুখোপাধ্যায়ই দিতে পারেন। কারণ, অনুভূতি, আবেগ, স্মৃতি এসবই তো একটা মানুষের ব্যক্তিগত। তবে, দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি তথা প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি কতটা আবেগপ্রবণ তা তাঁর টুইটেই ধরা পড়েছে।
ভারতরত্ন সম্মান প্রদানের তালিকাটা প্রকাশ হওয়ার কিছু পরেই টুইটারে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, থুড়ি ভারতরত্ন প্রণব মুখোপাধ্যায়। এই টুইটে তিনি লিখেছেন, 'ভারতবাসীর প্রতি গভীর নম্রতা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমি অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে ভাররত্ন সম্মান গ্রহণ করছি। আমি সবসময়েই বলি এবং আবার বলছি যে আমি দেশবাসীকে যতটা না দিতে পেরেছি তার থেকে বেশি পেয়েছি।'
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আগে আর তিন জন এই বঙ্গভূমি থেকে ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। এঁরা হলেন মাদার টেরেজা, সত্যজিৎ রায় ও অমর্ত্য সেন। প্রণব মুখোপাধ্যায় এই তালিকায় চতুর্থ এবং বাঙালি হিসাবে তিনি তৃতীয় জন যিনি দেশের এই সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত হলেন।
কীর্ণাহারে মতো এক বর্ধিষ্ণু গ্রামের মুখোপাধ্যায়ের পরিবারের ছেলেকে নিয়ে এমনিতেই গর্বের শেষ নেই বাঙালির। ভারতীয় রাজনীতির অত্যন্ত উঁচু স্থানে কয়েক দশক ধরে এক স্তম্ভের মতো কাজ করে গিয়েছেন। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের কার্যকাল শেষ হওয়ার আগেই দেশের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি বনেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তবে, রাইসিনা হিলসের প্রাসাদোপম অট্টালিকা তাঁর 'সিমপ্লিসিটি'-কে কখনও কেড়ে নিতে পারেনি। রাষ্ট্রপতির পদ অলঙ্কার করলেও তিনি সকলেরই কাছে আজও প্রিয় প্রণবদা। এই সম্ভাষণই তাঁর সবচেয়ে প্রিয়।
Former President Dr Pranab Mukherjee: It is with a deep sense of humility & gratitude to people of India that I accept this great honour #BharatRatna bestowed upon me. I've always said & I repeat, that I've got more from the people of our great country than I have given to them. pic.twitter.com/E7QSM9r3mC
— ANI (@ANI) January 25, 2019
১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর জন্ম। পিতা কমাদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের এক সক্রিয় সৈনিক। ফলে ছোট থেকেই বাড়ির মধ্যে জাতীয় সচেতনতার মধ্যেই বেড়ে ওঠেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্য়ায়। বীরভূমের এক প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও থাকলেও মেধার জোরে বড় শহরে নিজের একটা জায়গা করে নিতে অসুবিধা হয়নি। দেশ-রাজনীতি-কংগ্রেস এসবই তো ছোট থেকে তাঁর রক্তে ছিল। ফলে, প্রণব মুখোপাধ্যায়কে বড় হয়ে নতুন করে রাজনীতির পাঠটা আর নিতে হয়নি।
ইন্দিরা গান্ধীর ডাকে পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ছেড়ে ঢুকে পড়েছিলেন দিল্লির রাজনীতির আঙিনায়। ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বস্ত সঙ্গীদের মধ্যে একজন। এমনকী, রাজীব গান্ধীও একটা সময় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক দূরদর্শিতাকে বুঝতে পেরে নিজের ভুল শোধরান এবং এই বাঙালিকে ফের কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ পদে ফিরিয়ে আনেন। এরপর যত সময় গিয়েছে প্রণব মুখোপাধ্যায় জাতীয় রাজনীতিতে নিজের ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতাকে যেমন প্রতিষ্ঠিত করেছেন তেমনি কংগ্রেসের অন্যতম নির্ভরযোগ্য স্তম্ভ হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছেন। মনমোহন সিং-এর প্রধানমন্ত্রীত্ব হোক বা অটল বিহারি বাজপেয়ি সরকারের স্বর্ণযুগকে ২০০৪ সালের নির্বাচনে পর্যদুস্ত করানো হোক- প্রণব মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কৌশল চাণ্যকের নীতির মতোই ক্ষুরধার।
২০০৮ সালে আর্থিক মন্দায় যখন বেসামাল মার্কিন অর্থনীতি এবং যার প্রভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলি প্রভাবিত তখনও পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি। আর্থিক মন্দার আঁচকে সেভাবেই ভারতীয় অর্থনীতিতে পড়তেই দেননি। একের পর এক কৌশলে দেশ ও দেশবাসীকে অক্সিজেন জুগিয়ে গিয়েছেন তিনি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এনডিএ জোট থেকে বের করে এনে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারে ঢোকানো থেকে শুরু করে রাজ্যে বামেদের বিরুদ্ধে তৃণমূলের জোট সবেতেই চাণক্যের ভূমিকায় দেখা গিয়েছে তাঁকে। ৮২ বছরের প্রণব মুখোপাধ্যায় স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে বিশেষ করে দিল্লির বুকে রাজনীতির পাশা-খেলায় অংশ নিয়ে যে উচ্চতায় পৌঁছেছেন তা অন্য কোনও বাঙালি রাজনীতিক পারেননি। কংগ্রেস করেন বলে যে অন্য কোনও দলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব রয়েছে এমনটা কখনও শোনা যায়নি। রাজনৈতিক দর্শন এবং সৌজন্যের রাজনীতির ভারসাম্যটাকে ঠিকঠাক করে চলাটা যেন তাঁর কাছে খুবই সহজ বিষয়। সন্দেহ নেই আজ দেশের বুকে যে কয় জন রাজনীতিবিদ দলমত নির্বিশেষে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার ক্ষমতা রাখেন তাঁদের তালিকায় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নামটা এক নম্বরেই থাকবে। জাতীয় রাজনীতির এমন এক বর্ণময় চরিত্রকে তাই ভারতরত্ন সম্মান প্রদান করে কুর্ণিশ জানাল দেশ।