রাজনীতি: ১৯৭৫-এর নভেম্বরে সুইসাইড স্কোয়াড বানিয়ে ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে কেন জিম্মি করতে চেয়েছিল জাসদ
উনিশশো পঁচাত্তর সালের ২৬শে নভেম্বর সকাল নয়টা।
ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন ধানমন্ডিতে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে এসে গাড়ি থেকে নামেন।
বর্তমানে ধানমন্ডি দুই নম্বর সড়কের যে বাড়িটিতে ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রয়েছে সে বাড়িটিতে তখন ছিল ভারতীয় দূতাবাস।
হাইকমিশনার মি. সেন গাড়ি থেকে নামামাত্রই একদল যুবক অস্ত্র উঁচিয়ে তাকে বলে, "মি. সেন আপনি আমাদের হাতে জিম্মি, ওপরে চলুন।"
ঘটনার আকস্মিকতায় ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন তখন বাকরুদ্ধ।
তিনি এতোটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন যে হেঁটে অগ্রসর হতে পারছিলেন না।
অস্ত্রধারীরা তাকে টেনে-হিঁচড়ে ওপর তলায় তুলতে থাকে।
এমন সময় দূতাবাসের ভেতরে থাকা নিরাপত্তারক্ষীরা গুলি চালালে অস্ত্রধারীদের চারজন নিহত এবং হাইকমিশনার সমর সেন গুরুতর আহত হন।
হাইকমিশনার সমর সেনকে জিম্মি করার চেষ্টা করেছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের একদল তরুণ।
জাসদের সামরিক শাখা গণবাহিনীর তৎকালীন ঢাকা অঞ্চলের প্রধান আনোয়ার হোসেনের পরিকল্পনায় মি. সেনকে জিম্মি করার চেষ্টা হয়।
জাসদের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত কর্নেল আবু তাহেরের ছোট ভাই ছিলেন আনোয়ার হোসেন।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেয়ার পর ২০১৪ সাল পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন।
হাইকমিশনার সমর সেনকে জিম্মি করার সে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে অধ্যাপক হোসেন।
তাঁর লেখা একটি বইতে এ বিষয়টি উঠে এসেছে। দুই হাজার বারো সালে প্রকাশিত বইটির শিরোনাম 'মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের'।
- পাঁচ দশক পরও ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কেন 'লাভ-হেট' সম্পর্ক
- সামরিক শাসক হওয়ার পরের সপ্তাহজুড়ে কী করেছিলেন জিয়া?
হাইকমিশনার সমর সেনকে যারা জিম্মি করতে গিয়েছিলেন তারা জানতেন না যে দূতাবাসের নিচতলায় ভারতীয় সশস্ত্র রক্ষীরা অবস্থান করছিল।
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন লিখেছেন, "দোতলায় যাবার সিঁড়ির অর্ধেক উঠতেই বাড়ির নিচ তলার একটি কক্ষ থেকে হঠাৎ ১০-১২ জনের সশস্ত্র ভারতীয় রক্ষী বেরিয়ে আসে। এদের দেখে গণবাহিনীর সদস্যরা বিস্মিত হয়। নিরাপত্তারক্ষীদের দেখা সত্ত্বেও গণবাহিনীর সদস্যরা ভেবেছিলেন, তারা গুলি চালাতে পারবে না। কারণ তাতে সমর সেনও গুলিবিদ্ধ হবে।"
"বাস্তবে কিন্তু স্কোয়াডের সদস্যদের ওপর নির্দেশ ছিল যে, কোন অবস্থাতেই জিম্মিকে হত্যা করা যাবে না। কারণ জিম্মি মারা গেলে তো পুরো অভিযানের লক্ষ্যই ব্যর্থ।"
ভারতীয় রক্ষীদের গুলিতে ছয়জন জিম্মিকারীর মধ্যে চারজন নিহত হয়। বাকি দুজন মারাত্মকভাবে আহত হয়। এই গোলাগুলিতে পড়ে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন।
সুইসাইড স্কোয়াড
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন লিখেছেন, ১৯৭৫ সালের ২৪শে নভেম্বর রাতেই সিদ্ধান্ত হয় যে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেনকে জিম্মি করা হবে। সেজন্য একটি সুইসাইড স্কোয়াড গঠন করা হয়।
এই দলে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের দুই ভাই ছিলেন। এদের একজন ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল ও আরেকজন সাখাওয়াত হোসেন। মি. বেলাল বর্তমানে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য। অন্যদিকে সমর সেনকে জিম্মি করতে গিয়ে সাখাওয়াত হোসেন নিরাপত্তা রক্ষীদের গুলিতে নিহত হন।
পঁচিশে নভেম্বর সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্যরা ভারতীয় দূতাবাসে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করে আসে।
এই ঘটনার পর তৎকালীন ঢাকাস্থ দূতাবাসগুলো বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে।
ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার ২৬শে নভেম্বর ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ওয়াশিংটনে একটি তারবার্তা পাঠান।
উইকিলিকস যে হাজার-হাজার তারবার্তা প্রকাশ করেছে তার মধ্যে এটিও রয়েছে।
সে তারবার্তায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, "দর্শনার্থীর ছদ্মবেশ ধারণ করে ছয় তরুণ পকেট থেকে রিভলভার বের করে তার (সমর সেন) দিকে এগিয়ে যায়। এ সময় দায়িত্বরত নিরাপত্তারক্ষীরা ছুটে আসে এবং গুলিবিনিময় হয়। হামলাকারীরা রিসেপশেনের দিকে এগিয়ে যায়। নিরাপত্তারক্ষীরা স্টেনগান দিয়ে গুলি করলে চারজন মারা যায় এবং দুইজন আহত হয়।"
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের তারবার্তায় বলা হয়েছে, অপহরণকারীদের কাছ থেকে চারটি রিভলভার উদ্ধার করা হয় এবং তাদের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।
গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর বই 'জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি' সে ঘটনার বর্ণনা করেছেন।
মি. আহমদের বর্ণনায়, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় যাবার পথে অপেক্ষমাণ নিরাপত্তারক্ষীরা ব্রাশ-ফায়ার করে। এ সময় অস্ত্রধারীদের মধ্যে চারজন নিহত হয়। এ সময় হাইকমিশনার সমর সেনের কাঁধে গুলি লাগে।
মি. আহমেদের বর্ণনায়, "রেকি করার সময় কজন নিরাপত্তারক্ষী ঠিক কোন কোন জায়গায় ডিউটি করেন, তা তাঁরা জেনে গিয়েছিল। কিন্তু তাঁরা জানতেন না, একদল ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষী দোতলায় পাহারায় থাকেন।"
ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে জিম্মি করার সেই ঘটনা বিশ্বের নামকরা সংবাদমাধ্যমে খবর হয়েছিল।
তখন নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এতে তার কাঁধে গুলি লেগে তিনি আহত হয়েছেন। অস্ত্রোপচারের পর তার শারীরিক অবস্থা এখন সন্তোষজনক।
সমর সেনের নিরাপত্তারক্ষীরা পাল্টা গুলি চালালে চারজন আক্রমণকারী নিহত এবং বাকি দুইজন আহত হয়।
আক্রমণকারীরা বয়সে তরুণ এবং বেসামরিক পোশাক পরা অবস্থায় ছিল বলে নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিবেশী বাংলাদেশে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভারতপন্থী শেখ মুজিবুর রহমান সরকারকে উৎখাত করার পর গত তিনমাস যাবৎ দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির মধ্যেই এই ঘটনা ঘটলো।
সমর সেন আহত হবার পর ভারত সরকার সে দেশ থেকে চিকিৎসকদের একটি দল পাঠানো হয়েছিল।
হাইকমিশনার সমর সেনকে অপহরণ চেষ্টার এক সপ্তাহ আগেই দূতাবাস চত্বর থেকে একটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়।
কেন জিম্মি করার চেষ্টা?
সমর সেনকে জিম্মি চেষ্টার মাত্র তিন মাস আগে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যদের সাথে হত্যা করা হয়েছে। এর পর থেকে সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই চলমান ছিল।
অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থানের জের ধরে সামরিক বাহিনীতে তখন চরম বিশৃঙ্খল এক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।
বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকলে পর্দার পেছন থেকে সবকিছু পরিচালনা করছেন সেনাবাহিনীর নতুন প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।
উনিশশো পঁচাত্তর সালের ৭ই নভেম্বর এক পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ।
https://www.youtube.com/watch?v=MUaihSvqzf0
কিন্তু জিয়াউর রহমান মুক্ত হবার পর জাসদের চাহিদা অনুযায়ী কাজ না করে উল্টো জাসদের নেতাদের আটক করেন।
পঁচাত্তরের ২৪ শে নভেম্বর কর্নেল তাহেরকে গ্রেফতার করার পর রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করার সিদ্ধান্ত নেয় জাসদের এই অংশটি।
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন তাঁর বইতে লিখেছেন, "অভিযানে যাবার আগে একটি লিখিত বক্তব্য তৈরি করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী সমর সেনকে জিম্মি করে সে বক্তব্য রেডিও-টিভিতে প্রচারের জন্য সরকারকে বাধ্য করা হবে।"
জাসদের দাবি ছিল, কর্নেল তাহেরসহ জাসদ নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দেয়া এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার গ্রেফতারকৃত সদস্যদের মুক্ত করা।
অধ্যাপক হোসেনের বর্ণনা ছিল এরকম, "বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতসহ কয়েকটি দেশের দূতাবাস সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেবার দাবিও ছিল ওই লিখিত বক্তব্যে। সেখানে একইসঙ্গে ভারতের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়, সমর সেনের জিম্মি হবার অজুহাতে বাংলাদেশে যদি ভারতীয় হস্তক্ষেপ ঘটে তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে হত্যা করা হবে। "
সমর সেন সুস্থ হয়ে উঠলে তার সাথে দেখা করতে যান ঢাকার নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টার। সমর সেনের সাথে বৈঠকের পর একটি গোপন তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন মি. বোস্টার।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিখেছেন, অপহরণ তত্ত্বের বিষয়টি সমর সেন বিশ্বাস করেন না। কারণ কোন বুদ্ধিমান অপহরণকারী ভারতীয় হাইকমিশনের কম্পাউন্ড থেকে তাকে অপহরণ জন্য পরিকল্পনা করবে না।
তাছাড়া অস্ত্রধারীরা যে তাকে হত্যা করতে চায়নি সে বিষয়ে সমর সেন নিশ্চিত।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তিনি বলেন, আক্রমণকারীরা চাইলে তাকে হত্যা করতে পারতো। কিন্তু তারা সেটা করেনি।
ভারতীয় দূত টার্গেট কেন?
নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য ঢাকাস্থ তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করার বিষয়টি ভাবা হয়েছিল।
কিন্তু পরবর্তীতে সে সিদ্ধান্ত বদল করে ভারতীয় হাইকমিশনারকে জিম্মি করার সিদ্ধান্ত হয়।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, "প্রথমে মতিঝিলে আদমজী কোর্টে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস রেকি করা হয়। পরে সিদ্ধান্ত বদল করে ধানমন্ডির দুই নম্বর সড়কে ভারতীয় হাইকমিশন রেকি করা হয়।"
মার্কিন কিংবা অন্য যে কোন পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি না করার পেছনে একটি রাজনৈতিক কারণ ছিল।
জিম্মিকারীরা ভেবেছিল, পশ্চিমা কোন রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করা হলে সেটিকে হয়তো অনেকে ভারতের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখবে।
ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করার মাধ্যমে জাসদের সেই অংশটি দেখাতে চেয়েছিল যে ভারতের সাথে জাসদের কোন সম্পর্ক নেই।
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন তার বইতে বিষয়টিকে বর্ণনা করেছেন এভাবে - "প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী জাসদকে ভারতীয় এজেন্ট হিসেবে চিত্রিত করেছিল। ওই অবস্থায় কোন পশ্চিমা দূতকে জিম্মি করলে সে অপবাদ আরো পাকাপোক্ত এবং এটিও ভারতীয় ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত হবে। এছাড়া সমর সেনকে জিম্মি করার মধ্য দিয়ে জাসদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কহীনতার বিষয়টি স্পষ্ট করা যাবে বলেও মনে করা হয়েছিল।"
সমর সেনের পরিচয়
ব্রিটিশ শাসনামলে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সমর সেনের জন্ম। উনিশশ সত্তরের দশকে তিনি ছিলেন ভারতের একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক। মি. সেন যখন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য যোগ দেন তখন তার বয়স ছিল ৬১ বছর।
উনিশশো চুয়াত্তর সালে বাংলাদেশে যোগ দেবার দুই বছর আগেই চাকরি থেকে সমর সেনের অবসরে যাবার কথা ছিল। কিন্তু সরকারের অনুরোধে তিনি কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
ওই বছর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে হাইকমিশনার হিসেবে যোগ দেবার আগে মি. সেন পাঁচ বছর জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন।
সমর সেনের মতো একজন সিনিয়র কূটনীতিককে বাংলাদেশে পাঠিয়ে ভারত দেখিয়েছিল যে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ তাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতীয় আক্রমণের আশংকা
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর থেকে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক শীতল হয়ে যায়।
সমর সেনের উপর আক্রমণের ঘটনায় খুব স্বাভাবিকভাবেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে ভারত। ভারতের তরফ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ভারতবিরোধী প্রচারণার অংশ হিসেবে এ কাজ করেছে।
পঁচাত্তর সালের ৮ই ডিসেম্বর টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, সমর সেনের উপর আক্রমণের পর থেকে ঢাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশের সীমান্ত লঙ্ঘন করেছে। যদিও দিল্লী সেটি অস্বীকার করেছে।
টাইম ম্যাগাজিনের নিবন্ধে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের নতুন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ভারতের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পাকিস্তান এবং চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চালিয়ে নিতে আগ্রহী।
ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক কতটা তিক্ততায় মোড় নিয়েছে সেটি বোঝা যায় ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইন্ডিয়া টুডে ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক নিবন্ধে।
সে নিবন্ধে বলা হয়েছে, এক সপ্তাহ আগে ভারতীয় হাইকমিশন প্রাঙ্গণে একটি গ্রেনেড পাওয়া যাওয়ার ঘটনায় বোঝা যাচ্ছিল, যে কোন সময় আবার আক্রমণ হতে পারে। ভারত সরকার এ বিষয়টি বাংলাদেশকে অবহিত করেছিল বলে ইন্ডিয়া টুডে'র নিবন্ধে বলা হয়।
সে নিবন্ধে বলা হয়, "মি. সেনের জীবনের উপর হামলা প্রমাণ করে, ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি হয়তো নিয়ন্ত্রণে নেই, নতুবা ভারত সরকারের সতর্কবার্তা বাংলাদেশ সরকার আমলে নেয়নি।"
বাংলাদেশে সরকার কে পরিচালনা করছে? এমন প্রশ্ন তোলা হয়েছে ইন্ডিয়া টুডে'র সে প্রতিবেদনে।
শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই অনেকের মনে সন্দেহ তৈরি হয়েছিল যে ভারত যে কোন সময় বাংলাদেশে আক্রমণ করতে পারে।
তখন ঢাকা এবং দিল্লীতে নিযুক্ত মার্কিন কূটনীতিকরাও আশংকা করেছিলেন যে ভারতীয় সৈন্যরা হয়তো বাংলাদেশে ঢুকে পড়বে। উইকিলিকসে প্রকাশিত মার্কিন তারবার্তায় এ ধরণের আশংকা দেখা যায়।
হাইকমিশনার সমর সেনের উপর আক্রমণের পর সম্ভাব্য ভারতীয় আক্রমণ নিয়ে বিচলিত হয়ে উঠেন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান।
দুই হাজার সতের সালের ডিসেম্বর মাসে ইন্ডিয়ান ডিফেন্স রিভিউ সাময়িকীতে সাংবাদিক ও লেখক বি. জেড খসরু একটি নিবন্ধ লিখেছেন।
সে নিবন্ধে মি. খসরু লিখেছেন, সমর সেনের উপর যেদিন আক্রমণ করা হয় সেদিন রাতেই বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব তবারক হোসেন ঢাকার নিযুক্ত মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের সাথে বৈঠক করেন।
মি. খসরুর বর্ণনায়, বাংলাদেশে সম্ভাব্য ভারতীয় আক্রমণ ঠেকানোর জন্য সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান মার্কিন সহায়তা কামনা করেন। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকানোর জন্য দিল্লির উপর চাপ প্রয়োগ করতে আমেরিকার সহায়তা চান সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান।
উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সামাল দিতে ভূমিকা রেখেছিলেন আহত হাইকমিশনার সমর সেন।
তাকে চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সামরিক হেলিকপ্টার পাঠানো হলেও মি. সেন যাননি।
তিনি বাংলাদেশে থেকেই চিকিৎসা নিয়েছেন।
ফলে ভারতীয় হেলিকপ্টারটি ঢাকায় অবতরণ না করেই ফিরে যায়।
উনিশশো ছিয়াত্তর সালের নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন মি. সেন।
তিনি ২০১৪ সালে একশ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।