এক দেশ, এক নির্বাচন : ইন্দিরা গান্ধীর ঠিক উল্টো পথে হাঁটছেন নরেন্দ্র মোদী, কারণটি রাজনৈতিক
দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর নরেন্দ্র মোদী 'এক দেশ, এক নির্বাচন' ইস্যুতে সরব হয়েছেন। এই নিয়ে তিনি একটি সর্বদলীয় বৈঠক ডাকলেও সেখানে কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, বিএসপি, এসপি, আপ সহ বেশ কয়েকটি দলের নেতৃত্ব অনুপস্থিত ছিল। একই সময়ে দেশে লোকসভা এবং রাজ্যস্তরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্যে বর্তমান শাসকদল সচেষ্ট হলেও কংগ্রেস সহ বেশ কিছু আঞ্চলিক দল তাতে নিমরাজি।

ইন্দিরা বাহাত্তরের নির্বাচন একাত্তরে করেছিলেন
ঘটনাটি যেন ইতিহাসের চাকার পিছু ঘোরা। স্বাধীনতার পরে দেশে প্রথম চারটি নির্বাচনে কেন্দ্রে এবং রাজ্যে ভোটগ্রহণ একই সময়ে হয়। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এই ধারা থাকলেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ সালের লোকসভা নির্বাচন এক বছর এগিয়ে নিয়ে আসেন। সেই সময়ে জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের মধ্যেই ক্ষমতার লড়াই তুমুল আকার ধারণ করেছে। জওহরলাল-কন্যা ইন্দিরাকে প্রথমে কংগ্রেসের অভিজ্ঞ নেতৃত্ব 'বোবা পুতুল' মনে করলেও তিনি ক্রমেই বুঝিয়ে দেন যে রাজনৈতিক মহাকাঙ্খা তাঁরও রয়েছে। আর সেই নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু হলে কমবয়সী নেতাদের ইন্দিরা তাঁর পাশেই পান। অন্যদিকে, মোরারজি দেশাই সহ অন্যান্য অভিজ্ঞ নেতারা ইন্দিরার বিরুদ্ধে যান। ইন্দিরা তখন মাত্র বছর খানেক হয়েছে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ষাটের দশকের শেষের দিকে ব্যাঙ্কের জাতীয়করণ এবং দেশীয় রাজা-রাজড়াদের জন্যে ধার্য বেতন তুলে দেওয়ার পরে ইন্দিরার বিরুদ্ধে আরও খড়গহস্ত হয় তাঁর বিরোধীরা। এদিকে ১৯৬৭ সালে কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকারে থাকলেও দেশের নানা রাজ্যে তাদের পরাজয় ঘটে।

কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের নির্বাচনকে আলাদা করে দেন ইন্দিরা
এই সময়ে মাথায় বুদ্ধি খেলে যায় ধুরন্ধর নেত্রী ইন্দিরার। তিনি ঠিক করেন মানুষের কাছে নতুন করে জনাদেশ আনতে যাবেন তিনি, কিন্তু তার আগে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে রাজ্য রাজনীতির যোগসূত্রটিকে ছিন্ন করে দেবেন। এর কারণ আর কিছুই নয়, '৬৭ সালের নির্বাচনের ফলের প্রভাব যাতে তাঁর নতুন কংগ্রেস দলকে ছুঁতে না পারে।
১৯৬৯ সালে কংগ্রেস ভেঙে দু'টুকরো হওয়ার পরে ইন্দিরার যে দলটি (কংগ্রেস-আর) আসে, তাকে শক্তপোক্ত জমি দেওয়ার জন্যে এই পদক্ষেপটি জরুরি ছিল। জাতীয় ও রাজ্যের নির্বাচন আলাদা করে ফেললে দু'টি নির্বাচনের ইস্যুকেও আলাদা করে ফেলা যায় এবং সেক্ষেত্রে লাভবান হতেন ইন্দিরাই। সিদ্ধান্তটিতে ঝুঁকি ছিল না তা নয় কিন্তু ইন্দিরার মতো ব্যক্তিত্ব পিছপা হননি। এবং নির্বাচনের আগে 'গরিবি হটাও' স্লোগান তুলে তিনি বাজিমাত করেন।
১৯৭১ সালে এগিয়ে নিয়ে আসেন পরবর্তী নির্বাচন এবং সে বছরেরই শেষের দিকে বাংলাদেশ যুদ্ধে পাকিস্তানকে দু'টুকরো করে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে নেন অনেকটাই। সাতাত্তর সালে ইন্দিরার পতন হয় ঠিকই কিন্তু তদ্দিনে তিনি ভারতের প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে নিজের নাম লিখিয়ে নিয়েছেন; ক্ষমতায় ফেরেন ১৯৮০তেই।

নিজের ও দলের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায়ন দৃঢ় করতেই এই ব্যবস্থা
ষাটের শেষ এবং সত্তরের প্রথম দিকে ইন্দিরা গান্ধী নিজের দলের ভিত্তি পোক্ত করতে জাতীয় ও রাজ্যের নির্বাচন আলাদা করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। জাতীয় স্তরে ক্ষমতা দখলের মুষ্ঠি যাতে আলগা না হয়, তার জন্যে তিনি কেন্দ্রীয় নির্বাচনকে আলাদা করে দিয়েছিলেন যাতে মানুষ দেশের সরকার নির্বাচন করার সময়ে তাঁর ব্যাক্তিত্বকে ভোট দেয়; আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রভাবিত না হয়। রাজ্যস্তরে তখন কংগ্রেসের পতন শুরু হয়ে গিয়েছে; তৃণমূলস্তরের সংগঠন দুর্বল হতে শুরু করেছে। সেখানে নিজের কুর্সিকে ধরে রাখতে ইন্দিরা দিয়েছিলেন এক মোক্ষম চাল।

মোদীর লক্ষ্য ঠিক উল্টো; নিজেকে বিধানসভা নির্বাচনেও প্রাসঙ্গিক করা
মোদীর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি উল্টো। বিজেপির লক্ষ্য এখন সারা দেশে নিজের উপস্থিতি দৃঢ় করা। এল সময়ে শুধু গো-বলয়ের দল বলা হলেও বিজেপি এখন সারা দেশ জুড়ে এক বড় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। যেসব রাজ্যে তারা এককালে পাত্তা পেত না, সেখানেও তাদেরকে এখন বড় শক্তি হিসেবে দেখা যাচ্ছে। আর এই পরিস্থিতিতে, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অবশ্যই চাইবে যে কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের নির্বাচনগুলিকে জুড়ে দেওয়া হোক যাতে মোদী ফ্যাক্টর বিধানসভা নির্বাচনগুলিতেও পদ্মবাহিনীকে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি, খরচে রাশ টানার ব্যাপার তো রয়েছেই। কিন্তু আসল কারণ হচ্ছে ওই রাজনীতি।
কংগ্রেস আজকে এই বিষয়ে মোদীর বিরোধিতা করলেও এক কালে তাদের প্রয়াত নেত্রী ইন্দিরাই এই ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। আর অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলির বিরোধিতাও অস্বাভাবিক নয় কারণ লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন এক সময়ে হলে তাদের পক্ষেও মোদী ফ্যাক্টরের মোকাবিলা করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।