বিজেপি না সপা? উত্তরপ্রদেশে আসন্ন নির্বাচনের চাবিকাঠি ওবিসি ভোটারদের হাতে
বিজেপি না সপা? উত্তরপ্রদেশে আসন্ন নির্বাচনের চাবিকাঠি ওবিসি ভোটারদের হাতে
নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তায় ভর করে বিগত নির্বাচনগুলিতে সাফল্য পেয়ে এসেছে বিজেপি। উত্তরপ্রদেশে অ-যাদব ওবিসি ও অ-জাতব দলিত ভোটকে এক করে এবং ঐতিহ্যবাহী উচ্চ-বর্ণের ভোটব্যাঙ্ক ধরে রেখে মুসলিম ভোট বিভাজন করে গতবার শেষ হাসি হেসেছিল বিজেপি। এবার কোনদিকে মোড় নিতে চলেছে উত্তরপ্রদেশের ভাগ্য।
উত্তরপ্রদেশে জয় নিয়ে প্রশ্নের মুখে বিজেপি
২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি ৪০ শতাংশের বেশি ভোট নিয়ে। সপা-কংগ্রেস-বসপার জোটকে পর্যুদস্ত করে ৩১২টি আসন তারা দখল করেছিল উত্তরপ্রদেশে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কোনও দল এমন সাফল্য অর্জন করতে পারেনি দেশের বৃহত্তম রাজ্যে। কিন্তু বিরাট সাফল্য নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরও এবার উত্তরপ্রদেশে জয় নিয়ে প্রশ্নের মুখে বিজেপি।
সমাজবাদী পার্টি একাই সরকার গঠন করবে
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টি-বহুজন সমাজ পার্টি ৩৮ শতাংশ ভোট পেলেও বিজেপির ভোট শতাংশ পৌঁছে গিয়েছিল ৫০ শতাংশে। উত্তরপ্রদেশে ২০২২-এর নির্বাচনে সমাজবাদী পার্টি বা সপা এবং বিএসপি আলাদাভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। তারপরও সমাজবাদী পার্টি একাই সরকার গঠন করবে বলে দাবি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবের।
৩০০-র বেশি আসন দখল করে ক্ষমতায়!
বিজেপি এবং বিএসপি উভয় দল থেকেই অ-যাদব ওবিসি নেতারা সমাজবাদী পার্টির দিকে ঢলতে শুরু করেছে। ফলে সমাজবাদীর সম্ভাবনাও জোরদার হয়েছে। বিজেপি নেতারা দাবি করেন, দলত্যাগী নেতারা আর অ-যাদব ওবিসিদের প্রতিনিধি নন। ওবিসিরা নরেন্দ্র মোদীর অধীনে বিজেপির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে রয়ে গেছে। অন্যদিকে সমাজবাদী পার্টি নেতারা দাবি করেন, এবার ভোটদান যদি সঠিকভাবে পড়ে তবে তারা ৩০০-র বেশি আসন দখল করে ক্ষমতায় আসবে।
উত্তরপ্রদেশে জাতপাত আর বর্ণের পাটিগণিত
উত্তরপ্রদেশে জাতপাত আর বর্ণের পাটিগণিতের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। উত্তরপ্রদেশে ২৫ থেকে ২৭ শতাংশ সাধারণ জাতিভউক্ত ভোটার রয়েছে। তার মধ্যে ১০ শতাংশ ব্রাহ্মণ, ৭ শতাংশ ঠাকুর। ৩৯-৪০ শতাংশ ওবিসি, ৭-৯ শতাংশ যাদব এবং ৪ শতাংশ নিষাদ গোষ্ঠীর ভোট। এছাড়া প্রায় ২০ শতাংশ তফশিলি জাতি ও উপজাতি, তার মধ্যে ১০ শতাংশ জাতবও রয়েছেন। বাকি ১৬ থেকে ১৯ শতাংশ মুসলিম ভোটার। প্রতিটি বর্ণের জন্য কোন নির্দিষ্ট শতাংশ জানা নেই, কারণ সেখানে কোন জাতিগতশুমারি হয়নি।
উত্তরপ্রদেশে ভোট-গোষ্ঠী ও ভোট বিভাজন
উত্তরপ্রদেশে পাঁচটি প্রধান ভোট-গোষ্ঠী রয়েছে। উচ্চ বর্ণ, মুসলিম, অ-যাদব ওবিসি, যাদব এবং জাতব। অতীতে উত্তরপ্রদেশে সরকার গঠন করা হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ ভোট নিয়ে। দুটি পূর্ণ গোষ্ঠীর ভোট এবং অ-যাদব ওবিসিদের ভোটে থাবা বসিয়ে ২০১২ সালে সপা জয়ী হয়ছি। আর মুসলিম-যাদব সমন্বয় ঘটিয়ে বিএসপি ২০০৭ সালে তা করে দেখিয়েছিল।
ইউপিতে যে অঙ্কে পরিবর্তন হয়েছে ২০১৭ সালে
২০১৪ থেকে নরেন্দ্র মোদী মুখে ভর করে বিজেপি ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনে অ-যাদব ওবিসি এবং অ-জাতভ দলিতকে একত্রিত করে সাফল্য পেয়েছিল। যাদব এবং জাতবরা মুসলমানরা এসপি এবং বিএসপি শাসনের সমস্ত সুবিধা ভোগ করেছে। অ-যাদব ওবিসিরা সমাজবাদী শাসনে যাদবদের অনাচারে অসন্তুষ্ট ছিল। তার ফলে তারা সরে গিয়েছিল সমাজবাদী পার্টির দিক থেকে।
চার মুখকে প্রজেক্ট করে ২০১৭ সালে বাজিমাত
বিজেপি ঠাকুর সম্প্রদায়ের রাজনাথ সিং, ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কলরাজ মিশ্র, মৌর্য ও অ-যাদব ওবিসি সম্প্রদায়ের কেশব মৌর্য এবং লোধ ও অ-যাদব ওবিসি সম্প্রদায়ের উমা ভারতী- এই চার মুখকে প্রজেক্ট করে ২০১৭ সালে বাজিমাত করেছিল। বিএসপি-র ব্রাহ্মণ মুখ ব্রজেশ পাঠককে রীতা বহুগুনা জোশীর সঙ্গে দলে অন্তর্ভুক্ত করেছিল বিজেপি। স্বামী প্রসাদ মৌর্য বিএসপি থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। আপনা দলের কুর্মি মুখ অনুপ্রিয়া প্যাটেলকে অ-যাদব ওবিসি মুখ হিসাবে মন্ত্রী পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
বিজেপি নিপুণ হাতে অঙ্ক কষেই সাফল্য পেয়েছিল
যাদবদের পরে মৌর্যদের ৬-৭ শতাংশ এবং কুর্মিদের ৫ শতাংশ উত্তরপ্রদেশ সবথেকে বড় অ-যাদব ওবিসি ভোট ব্যাঙ্ক। লোধ সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ৩ শতাংশকে নিজেদের দিকে টানতে কল্যাণ সিংয়ের নাতিকে ইউপি-র মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়া হয়েছিল। বিজেপি ৬০ শতাংশের এর বেশি ভোট ব্যাঙ্ককে লক্ষ্যমাত্রা করেছি। তা ছিল -১০ শতাংশ ব্রাহ্মণ ভোট, ১২ শতাংশ ঠাকুর এবং বৈশ্য ভোটার, ৩৩ শতাংশ অ-যাদব ওবিসি ভোট এবং ৭-১০ শতাংশ অ-জাতব দলিত ভোট। এর ফলে ২০১৭ সালে ৪০ শতাংশ ভোট পেতে সক্ষম হয়েছিল বিজেপি। কারণ বিজেপি প্রায় সাড়ে তিনটি বড় গ্রুপের ভোট পেয়েছিল।
২০১৯ সালে যে সূত্রে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট বিজেপির
আর মুসলিম ভোটগুলি এসপি-কংগ্রেস জোট এবং বিএসপির মধ্যে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। মুসলিমরা পশ্চিম ইউপিতে জোটের পক্ষে ভোট দিয়েছে। সেখানে তারা মোট ভোটারের ২৯ শতাংশ। ইউপি বা উত্তর প্রদেশের অন্যান্য অংশের মুসলমানরা বিএসপিকে ভোট দিয়েছে। জাঠ অর্থাৎ ওবিসিদের ২ শতাংশের কিছুটা বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। ২০১৯ সালে বিজেপি এই সূত্র ধরে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট নিয়ে বিরোধীদের কোণঠাসা করে ছাড়ে।
অঙ্কে পরিবর্তন হতে শুরু করেছে ২০২১ সাল থেকে
কিন্তু এখন সেই অঙ্কে পরিবর্তন হয়েছে। এসপি বা সমাজবাদী পার্টি বলছে ২০২১ সালে পরিস্থিতি বদলে গেছে। কারণ বিজেপি 'ঠাকুর' সম্প্রদায়ের যোগী আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রী করেছে। এই সিদ্ধান্ত ব্রাহ্মণদের পাশাপাশি অ-যাদব ওবিসিদের ক্ষুব্ধ করেছে। ফলে বিজেপির সেই জাত-ব্যাঙ্ক ভেঙে গেছে। এটি তারা এখন এসপি-র দিকে ঝুঁকেছে। ফলে বিজেপির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ওই সম্প্রদায়ের নেতারা। ইতিমধ্যে তিনজন ওবিসি মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং তারা সমাজবাদী পার্টির দিকে ঝুঁকেছেন।
যে দলই এবার ৩৫ শতাংশ ভোট পাবে, তার জয়
এসপি আরও বলেছে, নির্বাচন এখন দ্বিমুখী, বিএসপি এবং কংগ্রেস সাইড হয়ে গিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের মানুষ বিজেপি-বিরোধী ভোট বিশেষ করে মুসলিম ভোট, কোনও বিভাজন ছাড়াই এসপি-তে আসবে। রাজ্যের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞমহলের ধারণা যে দলই এবার ৩৫ শতাংশ ভোট পাবে, তারাই সরকার গঠন করতে পারবে। বিজেপি অবশ্য বজায় রেখেছে যে অ-যাদব ওবিসি ভোটাররা তাদের সঙ্গেই থাকবে এবং সেই সম্প্রদায়ের কিছু নেতার পরিত্যাগ ভোটারদের প্রভাবিত করবে না।
বিজেপি ৪০ শতাংশ ভোটের নীচে নামবে না, বিশ্বাস
বিজেপি ছেড়ে যাওয়া তিনজন মন্ত্রীই গত নির্বাচনে বিএসপি থেকে এসেছিলেন এবং তারা বিজেপির সঙ্গে আগে ছিলেন না। বিজেপি বিশ্বাস করে নরেন্দ্র মোদী এবং যোগী আদিত্যনাথ অত্যন্ত জনপ্রিয়। ফলে বিজেপি ৪০ শতাংশ ভোটের নীচে নামবে না এবং বিজেপি পুনরায় নতুন মেয়াদে সরকার গঠন করবে খুব সহজেই।