আলেকজান্ডার থেকে রবীন্দ্রনাথ, জড়িয়েছেন রক্ষা বন্ধনে - পুরাণ, ইতিহাস ও এই উৎসবের গুরুত্ব
ভাই-বোনের বন্ধনকে উদযাপন করতে রক্ষা বন্ধন বা রাখি উৎসব পালন করা হয়। কিন্তু ইতিহাসে এমন কিছু কিছু ঘটনা আছে, যখন একটি রাখি কোনও ব্যক্তি বা রাজ্যকে ধ্বংসের হাত থেকে সুরক্ষিত রেখেছে।
প্রতি বছরের মতো আগামী ২৬শে আগস্ট ভারতে পালিত হবে রক্ষা বন্ধন বা রাখি উৎসব। এই উৎসব পালন করা হয় ভাই ও বোনের পবিত্র বন্ধনকে উদযাপন করার জন্য। হিন্দু ধর্মমতে শ্রাবণ পুর্ণিমায় হয় এই উৎসব। এইদিন বোনেরা ভাইদের হাতে রাখি বেঁধে দেন। এর মাধ্যমে বোনেদের বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব নেন ভাইরা।
ঠিক কবে থেকে এই উৎসবের প্রচলন হয়েছিল তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এই প্রথা যে বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে তলে আসছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। হিন্দু ধর্মে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই পবিত্র সুতোর বন্ধনকে রক্ষা কবজ হিসেবে দেখা হয়। বিভিন্ন দেব দেবীর রক্ষাসূত্র হিসেবে বিভিন্ন মন্দিরে ভক্তদের হাতে পবিত্র সূতো বেঁধে দেওয়া হয়। আবার ব্রাহ্মণরা যে উপবীত ধারণ করেন, তাও রক্ষাসূত্র হিসেবেই দেখা হয়। এমনকী হিন্দু বিবাহে যে মঙ্গলসূত্র পরানোর প্রথা প্রচলিত আছে, তাও স্ত্রীকে রক্ষা করার জন্য স্বামীর অজ্ঞিকারের চিহ্ন।
রাখি বন্ধনের প্রথম নজিরটি পাওয়া যায় হিন্দু পুরাণে। দেবরাজ ইন্দ্রকে অসুর ও তাঁর শত্রুদের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখতে হাতে রাখি পরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে সেই রাখি কিভাবে ভাই-বোনের সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে তা জানা যায়নি। মূলতঃ হিন্দুদের উৎসব হলেও, এই উৎসব আজ সারা ভারতে, এমনকী ভারতের বাইরেও সব ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
ভারতের ইতিহাসে অবশ্য বিভিন্ন সময় রাখিকে ব্যবহার করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও। শোনা যায় খ্রীস্টপূর্ব ৩২৬ সনে হিদাসপাসের যুদ্ধের আগে গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোক্সানা পুরুকে রাখি পাঠিয়েছিলেন। অনুরোধ করেছিলেন যুদ্ধে পুরু যেন আলেকজান্ডারের কোনও ক্ষতি না করেন। সেই রাখির পবিত্রতাকে সম্মান জানিয়েছিলেন পুরু। যুদ্ধে তিনি আলেকজান্ডারকে আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখেন নিজেকে।
আহার হুমায়ুনের শাসনকালে চিতোরের রানী কর্ণাবতী হুমায়ুনকে রাখি পাঠিয়েছিলেন। সেই সময় বাহাদুর শাহের বাহিনী চিতোর আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিল। রাজ্যকে রক্ষা করতে রাখি পাঠিয়ে হুমায়ুনের সাহায্য চেয়েছিলেন চিতোরের রানী। শোনা যায়, হুমায়ুনও সেই রক্ষা বন্ধনকে সম্মান করেছিলেন। চিতোর রক্ষা করতে পাঠিয়ে দেন তাঁর বাহিনীকে।
আবার ১৯০৫ সালে প্রথমবার যখন বাংলা ভাগের চক্রান্ত করেছিল ইংরেজরা, দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা হয়েছিল হিন্দু, মুসলমানের মধ্যে কবি রবীন্দ্রনাথ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ধরে রাখতে আশ্রয় নিয়েছিলেন রাখি বন্ধনের। হিন্দু -মুসলমান পরস্পর পরস্পরের হাতে রাখি পরিয়ে নিজেদের সম্প্রীতি প্রকা করেছিলেন। ইংরেজদের চক্রান্তের মুখে অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাখি।
[আরও পড়ুন:ইদ-উল-আযহা ২০১৮, ভারতে কবে হবে উদযাপন জানাল জামা মসজিদ ]
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলেছে রাখির বাহ্যিক অনেক কিছুই। আজ আর কেবল রঙিন সুতো নয়, বিভিন্ন উপাদান দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয় রাখিকে। রাখি তৈরি একটি শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেছে। তার সঙ্গে বেড়েছে উপহার বিনিময়ের ঘটা। কিন্তু অন্তরঙ্গে এখনও রাখি সেই কক্ষা কবজের পবিত্রতা বহন করে। সেই পবিত্রতাকে স্মরণ করে আজকের বিক্ষুব্ধ সময়ে দেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ বন্ধেও রাখি রক্ষাকবজ হয়ে উঠবে এই আশা রাখছেন অনেকেই।