'খালের ধারে বসিয়ে গুলিটা করল, ৫ মিনিট পরে বুঝলাম বেঁচে', অসম গণহত্যায় অলৌকিক রক্ষা মহাদেবের
মহাদেব নমঃশুদ্র নামে বছর বাইশের এক তরুণ শুনিয়েছেন বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যার গণহত্যার সেই ভয়ঙ্কর কাহিনি।
কাজ থেকে ফিরে গ্রামের মেন রাস্তার পাশে একটি চা-এর দোকানে আড্ডা মারছিলেন সকলে। প্রত্য়েকেরই বয়স গড়ে ২২ থেকে ২৭-এর মধ্যে। চা-খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চলছিল লুডো খেলা। তিনসুকিয়ার ধলার বিছনিমুখ গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ মাঠে-ঘাটে কাজ করেন। বিশাল আর্থিক বলশালী লোকজন এই গ্রামে খুব একটা নেই। অসমের মধ্যে হলেও এই গ্রামের অধিকাংশই বাংলাভাষি। তাঁরা অসমিয়া সামান্য সামান্য বুঝতে পারলেও তা বলতে পারেন না।
মহাদেব নমঃশুদ্র নামে বছর বাইশের এক তরুণ শুনিয়েছেন বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যার গণহত্যার সেই ভয়ঙ্কর কাহিনি। কারণ গুলি যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট না হতো তাহলে মহাদেবের হালও তাঁর পাঁচ বন্ধুর মতো হত। বৃহস্পতিবারের সন্ধ্য়ার সেই মুহূর্তটা যেন এখনও চোখের সামনে ভাসছে মহাদেবের।
লুডো খেলার সময়ই চা-এর দোকানের বাইরে এসে থামে একটি মোটরবাইক। এরপরই মহাদেব, ধনঞ্জয়, সুবল-রা শুনতে পান তাঁদের নাম ধরে কারা যেন ডাকছে। দোকানের বাইরে আসতেই দেখতে পান মোটরবাইকে তিন জন বসে আছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে গ্রামেরই বিশ্বাস বাড়ির তিন ভাই শ্যামলাল, অনন্ত ও অবিনাশ। মহাদেব মোবাইল-এর টর্চ জ্বালিয়ে দেখার চেষ্টা করেছিলেন মোটরবাইকের আরোহীদের। মহাদেবরা দেখতে পান মোটরবাইকের আরোহীদের সঙ্গে সঙ্গে বিছনিমুখ গ্রামের বাইরে থাকা বস্তির কিছু ছেলেও রয়েছে। মোটরবাইকে থাকা আরোহীদের পরনে ছিল সেনার পোশাক। মুখ ছিল কালো কাপড়ে বাঁধা।
মোবাইলের আলো জ্বালতেই মোটরবাইকের এক আরোহী মারমুখী মেজাজে মোবাইলটা ছিনিয় নেয়। বাইকের আরোহীরা বলে কাজ আছে, গ্রামের সামনে রাস্তায় যেতে হবে। সেনার পোশাক পরা আরোহীদের দেখে মহাদেবরা ঠাহর করেছিলেন হয়তো এরা অসম রাইফেলস-এর জওয়ান। তারমধ্যে মহাদেবের মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার পর বাকিদেরও মোবাইল নিয়ে নেয়। শ্যামলাল, অনন্তরা কিছু বলছিল না। চুপ করেই ছিল।
বন্দুকধারী সেনা-উর্দি পরা ওই আগন্তুকরা এমন মারমুখী ছিল যে তাদের সঙ্গে থাকা বন্দুক দেখে ভয়ে ওরা যা বলে তা মানে মহাদেবরা। এই অবস্থায় মহাদেব-সহ ৬জনকে মোটরবাইকের তিন আরোহী টেনে নিয়ে আসে কিংবদন্তি গায়ক ভূপেন হাজারিকার নামাঙ্কিত ধলা-সাদিয়া সেতুর কাছে। সেখানে বস্তির ছেলেগুলোকে মারধর করে তাড়িয়ে দেয় মোটরবাইকে থাকা তিন জন।
[আরও পড়ুন: 'বাঙালি-র হিন্দু-মুসিলম কী, কবে জাগব আমরা', অসম গণহত্যায় গর্জে উঠলেন তপোধীর]
মহাদেব নমঃশুদ্র, শ্যামলাল বিশ্বাস, অনন্ত বিশ্বাস, অবিনাশ বিশ্বাস, ধনঞ্জয় নমঃশুদ্র ও সুবল দাস-দের ধলা-সাদিয়া সেতুর পাশে খালের ধারে অন্ধকারে বসিয়ে রাখে তিন বাইক আরোহী। অন্ধকারে সকলেই আতঙ্কে। মহাদেব জানিয়েছে, রাস্তার দিকে পিঠ ফিরিয়ে তাঁদেরকে খালের দিকে মুখ করিয়ে বসানো হয়েছিল। আতঙ্কে কেউ চিৎকারও করতে পারছিলেন না।
[আরও পড়ুন: মমতার 'ব্ল্যাক' প্রতিবাদ, অসমে পাঁচ বাঙালি নিধনে বিজেপি হটাও গর্জন বাংলায়]
আচমকাই বন্দুক থেকে গুলি চালানোর আওয়াজ শুনতে পান মহাদেব। দেখতে পান কিছুদূরে বসা একজনকে উল্টে পড়ে যেতে। গুলি চলার পর বন্দুকের ধোয়ায় চারিদিক ঢেকে গিয়েছিল। অন্ধকারের মধ্যে ধোঁয়াটা ভালো করে বুঝতে পারছিলেন তিনি। এরপর আর কোনও সুযোগ নয় একটানা কয়েকবার বন্দুক চলার আওয়াজ। জ্ঞান হারিয়ে সামনের শুকনো খালে গিয়ে পড়েন মহাদেব। মিনিট পাঁচেক পরে তাঁর সম্বিৎ ফেরে। আতঙ্কে মাটি থেকে উঠতে পারছিলেন না। এভাবেই অন্ধকারে পাঁচ মিনিট ধরে পড়েছিলেন। পাশে একজন তখন কাঁতরাচ্ছেন। মহাদেব এরপর সেই জখমকে কাঁধে তুলে নিয়ে খালের পাশে থাকা বস্তির দিকে দৌড় লাগান। চারপাশে তখন ওই বাইক আরোহীদের দেখা নেই। বস্তির একটি ঘরে এক জখম রেখে তাঁর মুখে জলও দেন। এর খানিক পরেই সেই জখম মারা যান। এদিকে, গুলির আওয়াজে ততক্ষণে ধালা-সাদিয়া ব্রিজের পাশে ছুটে এসেছেন বিছনিমুখ গ্রামের মানুষ। ঘটনাস্থল থেকে বাকি চারজনকে উদ্ধার করা হয়। এরমধ্যে দু'নের দেহে তখনও প্রাণ ছিল। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতেই রাস্তায় এরা মারা যান।
[আরও পড়ুন:অসমে বাঙালি গণহত্যা! প্রতিবাদে সরব মমতা, বিক্ষোভ কর্মসূচি নিয়ে রাস্তায় নামছে তৃণমূল]
মহাদেব পরে দেখেন তাঁর গায়ে যে জ্য়াকেট ছিল তা ফুঁড়ে গুলি বেরিয়ে গেলেও শরীরে বিন্দুমাত্র আঁচড় পড়েনি। ঘটনাস্থলে ৩০ থেকে ৩৫টি কার্তুজও পেয়েছে পুলিশ। কার্তুজগুলো একে ফর্টি সেভেন-এর বলেও জানিয়েছে তারা। মহাদেব জানিয়েছে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ বার ফায়ারিং হয়েছিল। এতবার ফায়ারিং-এ মাত্র একটা গুলি তাঁর জ্যাকেটে লেগেছিল। একে অলৌকিক রক্ষা ছাড়া আর কী বা বলা যায়।