এম করুণানিধি, ৫০ বছর ধরে ডিএমকের শীর্ষ নেতা
গত ৫০ বছর ধরে ডিএমকে প্রেসিডেন্ট পদে আছেন এম করুণানিধি । ডিএমকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে তাঁর সাফল্য অতুলনীয়।
সোমবারই চিকিৎসকরা জানিয়েছেন ডিএমকে প্রেসিডেন্ট এম করুণানিধির শারীরিক অবস্থা সঙ্কটজনক। আর সেই খবর আসতে না আসতেই হাসপাতালে ডিএমকে নেতা কর্মীদের ভিড় জমে গিয়েছে। গত ৫০ বছর ধরে ডিএমকের মাথার উপর ছাতার মতো রয়েছেন তিনি। সেই ছাতা হঠাত সরে যাওয়ার আশঙ্কায় এক অদ্ভুত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তাঁরা।
এমজিআর-এর বিদ্রোহ, জরুরী অবস্থা, ভাইকোর দলত্যাগ সব বিপদের আঁচ থেকেই ডিএমকে-কে নয়নের মণির মতোই সামলেছেন এই বর্ষীয়ান নেতা। একটানা এক ব্যক্তি নেতৃত্বে থাকায় বিভিন্ন সময়ে উঠেছে দলে গণতন্ত্র না থাকার প্রশ্ন। তাও কোন জাদু দক্ষতায় তিনি দলের অন্যান্য নেতাদের পিছনে ফেলে দিলেন, কিভাবে ডিএমকের নেতৃত্বে হয়ে উঠলেন অবিসংবাদী নেতা, দেখে নেওয়া যাক।
৫০ বছর ধরে ডিএমকে প্রেসিডেন্ট
চলতি বছরের ২৭ জুলাই তারিখেই একটানা পার্টির প্রেসিডেন্ট পদে ৫০ বছর সম্পূর্ণ করেছেন এই বর্ষীয়ান নেতা। প্রথমবার এই পদে তিনি আসীন হন ১৯৬৯ সালের ২৭ জুলাই। তার মাত্র ৫ মাস আগেই দলের প্রতিষ্ঠাতা সি এন আন্নাদুরাইয়ের মৃত্যুর পর দলের বিধানসভার নেতা তথা তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছিলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে একটানা ক্ষমতায় থাকা তাঁর হয়নি। কিন্তু দলের একছত্র ক্ষমতার রাশ থেকে গিয়েছে তাঁরই হাতে।
যেভাবে পেয়েছিলেন দলের সর্বোচ্চ ক্ষমতা
প্রতিষ্ঠার সময় কিন্তু ডিএমকে দলের কোনও প্রেসিডেন্ট পদ ছিল না। প্রতিষ্ঠাতা আন্নাদুরাই নিজে ছিলেন জেনারেল সেক্রেটারির পদে। দলত্যাগী নেতা ই.ভি. রামাস্বামীর জন্য রেখে দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট পদটি। ১৯৬০ সালে ডিএমকে প্রেসিডিয়াম চেয়ারম্যান বলে দলের একটি পদ ঘোষণা করে যে পদ পান প্রয়াত ই.ভি.কে সম্পথ। কিন্তু তিনিও দল ছাড়ার পর পদটি যায় দলের আরেক প্রয়াত নেতা ভি.আর. নেদুনচেঝিয়ানের হাতে। তাঁর উত্তরসুরি হন করুণানিধি তবে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তাঁকেও চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচয় দিত ডিএমকে। ক্রমে পদটি প্রেসিডেন্টে রূপান্তরিত হয়। সেই থেকে এখন অবধি এই ৯৫ বছর হয়সী নেতাই দলের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় রয়েছেন।
নেতৃত্বের পথে কাঁটা
একটানা ৫০ বছর দলের রাশ নিজের হাতে রাখলেও করুণানিধির পথটা কিন্তু কন্টকবিহীন ছিল না। ১৯৭০ সালে তিরুপরমকুন্দরমের ডিএমকে-র জেনারেল কাউন্সিলেই দলের নেতৃত্বে বদলের প্রচেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু ডিএমকে দলের ইতিহাস রচয়িতা কে. তিরুণভুক্কারাসু জানিয়েছেন শেষ অবধি তা দানা বাঁধেনি। তারপরেও বিভিন্ন সময় ডিএমকে-র অনেক নেতাই মতবিরোধের কারণে দল ছেড়েছেন, রয়ে গিয়েছেন করুণানিধি।
ডিএমকে-তে কি নেতার অভাব
ডিএমকে-র নেতৃত্বে একটানা ৫০ বছর ধরে থাকা একদিকে যেমন করুণানিধির সাফল্য তেমনই অপরদিককে একজনের হাতে নেতৃত্ব কুক্ষিগত থাকায় দলে গণতন্ত্রের অভাব হওয়ার সমালোচনাও রয়েছে। তবে ডিএমকে দলে কিন্তু সম্ভাবনাময় নেতার অভাব কখনই ঘটেনি বলে দাবি করেছেন কে. তিরুণভুক্কারাসু। তাঁর মতে, 'তাঁর মতোই ক্যারিশ্ম্যাটিক ও প্রতিভাবান নেতা ছিল, কিন্তু দল তাঁদের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত করেনি।
কোথায় অন্যদের থেকে আলাদা করুণানিধি
দলে তাঁর সমপর্যায়ের ক্যারিশ্ম্যাটিক ও প্রতিভাবান নেতা থাকলেও কয়েকটি বিষয়ে দক্ষতার জোরে বাকিদের পিছনে ফেলে দিয়েছিলেন করুণানিধি, জনতাকেও নিজের পক্ষে ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। রাজনৈতিক ঘটনাক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করা, জনমতকে নিজের পক্ষে টেনে আনা, দূরদৃষ্টি, চটজলদি রসবোধ, তামিল ভাষার উপর তাঁর অসামান্য দখল যা তাঁর ভাষণে ও বিভিন্ন লেখায় বারবার ধরা পড়েছে - এসব গুনই বাকিদের থেকে তাঁকে যোজন এগিয়ে দিয়েছে। তবে সবচেয়ে বিস্ময়ের তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি। শোনা যায় দলের প্রান্তিকতম কর্মীর নামও তাঁর মনে থাকত।
করুণানিধি ও রুজভেল্ট
দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই নেতা জানেন একটানা ক্ষমতায় থাকা নিয়ে তাঁর সমাোচনা হবে। তাই আগেভাগেই নিজের আত্মজীবনীতে তিনি নিজেকে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের সঙ্গে তুলনা করেন। রুজভেল্টই একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট যিনি ৪ দফা প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তাঁকে নিয়ে ব্যাঙ্গচিত্রও কম হয়নি। আত্মজীবনীতে এক জায়গায় তিনি লেখেন, 'এখানেও কিছু সংবাদপত্র মালিক, কারখানার মালিক, বড়লোক, অভিজাত একটি খারাপ শব্দ পেয়ে গিয়েছেন। তাঁদের মতে করুণানিধি একটি খারাপ শব্দ।'
ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট
তাঁর সবগুণকে সম্ভবত ছাপিয়ে গিয়েছে তাঁর ক্রাইসিস ম্য়ানেজমেন্টের দক্ষতা। অনেকেই মনে করেন, সব কিছু যখন তাঁর বিরুদ্ধে থাকে তখনই তাঁর সেরাটা বেরিয়ে আসে। একের পর এক নেতা দল ছাড়ায় বিপদে পড়েছে ডিএমকে। বিশেষ করে এমজি রামাচন্দ্রন যখন তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তারপরেও দলের ভাঙন রুখতে সফল হন তিনি। জরুরি অবস্থার সময়ও দলকে যোগ্য নেতৃ্ত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যান। আবার ভাইকোর দল ত্যাগের পরও দলকে ধরে রেখেছিলেন নিজের ক্যারিশ্মায়। আজ যখন তাঁর দেহ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করছে, দলের নেতা কর্মীরা আশা করছেন আবার সেরাটা বের করে আনবেন করুণানিধি। সুস্থ হয়ে আবারও দলকে যোগ্য নেতার মতো এগিয়ে নিয়ে যাবেন।