প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জীবনী: বীরভূমের মিরাটি থেকে রাষ্ট্রপতিভবন রাইসিনা হিলসে পা রাখার কাহিনি
১৩ সংখ্যাটিকে সাধারণত 'আনলাকি' হিসাবেই ধরে নেওয়া হয়। তবে এই ১৩ সংখ্যাটিকেই সৌভাগ্যের রাস্তা হিসাবে দেখতেন তিনি। দুর্ভাগ্যের মোড় ঘুরিয়ে তাকে সৌভাগ্যে পরিণত করার দক্ষতা সবার থাকে না। তবে কীর্ণাহারের এক ছাপোষা বাড়ির বঙ্গ সন্তানের তা ছিল। যিনি ভারতের সফল ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি। তিনি প্রণব মুখোপাধ্যায়।

চাণক্য
উল্টো স্রোতে ভাসার চরম দক্ষতা নিয়ে বহু সাধারণের মধ্য থেকে তিনি অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন। তাই সম্ভবত তাঁর ভাবনার গতিপ্রকৃতিও আশপাশের বহু সাধারণের চাইতে অনেকটাই আলাদা ছিল। আর সেকারণেই বাংলা তথা জাতীয় রাজনীতির 'চাণক্য' বলে তিনি বহুবছর পরিচিত ছিলেন। নিজের দল কংগ্রেস তাঁকে বহু সময়ই 'ডিজাস্টার ম্যানেজার' হিসাবে পেয়েছে। পাল্টাতে থাকা রাজনীতির পরতে পরতে কীভাবে দাপট ধরে রাখতে হয়, তা আগামীকে চিনিয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। আর সেকারণেই কংগ্রেসের হাইকমান্ডে বহু দুর্যোগে কখনও ডাক এসেছে 'প্রণবদার' জন্য, আবার দুর্গাপুজোর চণ্ডীপাঠের জন্যও বীরভূমের কীর্ণাহারের বাড়ি থেকে ডাক এসেছে আদরের 'পল্টু'র।

শুরুর কথা
বীরভূমের কীর্ণাহারের কাছই মিরিটি গ্রাম। গ্রামে মুখোপাধ্যায় বাড়ির পুজো অনেক পুরোন। বাড়ির সদস্য কামদাকিঙ্কর মুখপাধ্যায় বহু বছর স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য লড়েছেন। জেলবন্দি ছিলেন দশ বছর। সেই কামদাকিঙ্করের ছেলেই প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর যাঁর জন্ম।

সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজ.. শিক্ষক.. সাংবাদিকতা
সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস ও আইন শাস্ত্র ছিল তাঁর বিষয়। স্নাতোকোত্তর রশ করার পর তিনি বিদ্যাসাগর কলেজে অ্যাসিসটেন্স প্রফেসর ছিলেন। এক কালে সাংবাদিকতাতেও হাতেখড়ি হয় তাঁর। 'দেশের ডাক ' নামক সংবাদপত্রে তিনি কয়েক বছর কাজ করেন।

শিক্ষক 'প্রণব স্যার' থেকে রাজনীতির 'প্রণব দা'
রাজনৈতিক পরিবারে ছোট থেকে মানুষ প্রণব মুখোপাধ্যায় রাজনীতির পরতে পরতে নিজেকে সজাগ রেখেছেন। কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর আত্মীক যোগ পরিবার সূত্রে। ১৯৬৯ সালে তিনি প্রথমবার কংগ্রেসের প্রতিনিধি স্বরূপ রাজ্যসভায় যোগ দেন। এরপর ১৯৭৫ থেকে ৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি রাজ্য সভার সদস্য ছিলেন। ১৯৭৩ সালে কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়ন মন্ত্রী হিসাবে তিনি জাতীয় কংগ্রেসের দোর্দণ্ডপ্রতাপ পদার্পণ শুরু করেন।

অর্থমন্ত্রক
ইতিহাস, আইন আর রাষ্ট্রবিজ্ঞনের ছাত্র প্রণব মুখোপাধ্যায় বহু বছর দেশের অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেছেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল এই দায়িত্ব তাংকে বহু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছিল। সেই সময় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ৫ অর্থমন্ত্রীর তালিকায় ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

কংগ্রেসে চক্ষুশূল !
ইন্দিরার অকাল মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধী কংগ্রেসের মসনদে আসতেই ধীরে ধীরে হাত শিবিরের মূল স্রোত থেকে সরে যান প্রণব মুখোপাধ্যায়। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তাঁকে কতটা কুঁড়ে খেয়েছে তা বলাই বাহুল্য। রাষ্ট্রীয় সমাজবাদি কংগ্রেস নামে আলাদা দলও তিনি গঠন করেন। এরপর রাজনীতির অলিন্দে তাঁর সোচ্চার আত্মপ্রকাশ হয় পিভি নরসিমহা রাওয়ের হাত ধরে। প্রধানমন্ত্রী রাও পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানের পদে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে বসান। ফের মন্ত্রিসভাতেও তাঁকে ফিরিয়ে নেয় কংগ্রেস।

জঙ্গিপুর জয়
২০০৪ সালে জঙ্গিপুর আসন থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি রূপে প্রণব মুখোপাধ্যায় সংসদে পা রাখেন। সেই নির্বাচনে অধীর চৌধুরি ও প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জুটি কার্যত মাতিয়ে দেয় কংগ্রেস হাইকমান্ডকে। এরপর বিভিন্ন সময় দেশের প্রতিরক্ষা, অপ্থ, বিদেশ, জাহাজ, পরিবহন শিল্প সংক্রান্ত মন্ত্রকের মন্ত্রী হয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও বাঙালির গর্ব
বাঙালিকে যে গর্ব আগে কেউ দিতে পারেননি , তাই দিয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। দেশের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি হিসাবে প্রণব মুখোপাধ্যায় শপথ নিতেই তিনি প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হিসাবে বঙ্গ ইতিহাসেও জায়গা করে নেন। কীর্ণাহারের ছাপোষা বাঙালি ঘরের সন্তান প্রবেশ করেন রাষ্ট্রপতির রাজভবনে। যে সফরের পরতে পরতে রয়ে গিয়েছে লড়াইয়ের বহু দাগ।

প্রাপ্তির ঝুলি
দেশ বিদেশ থেকে বহু সম্মাননা প্রণব মুখোপাধ্যায় পেয়েছেন। সম্মানিত হয়েছেন পদ্মবিভূষণে। সম্মান পেয়েছেন ভারত রত্ন হিসাবে। দুই সন্তান শর্মিষ্ঠা ও অভিজিৎকে সঙ্গে নিয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায় ও স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের জীবন আগাগোরাই ছিল মিডিয়ার লেন্সে। তবে ২০০৭ সালে স্ত্রী বিয়োগের পর থেকে খানিকটা রাজনৈতিক ভাবধারায় বদল দেখা যায় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জীবনে।
প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়, মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর
{quiz_321}