ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য থেকে কর্তব্যনিষ্ঠায় অবিচল মিস্টার ডিপেন্ডেবল প্রণব
কংগ্রেসের জাতীয় রাজনীতিতে পদার্পণ করেই প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য। ইন্দিরা গান্ধীও তাঁকে সমীহ করতেন। বয়সে নবীন হলেও তাঁর পরামর্শ মেনে চলতেন ইন্দিরা এবং বকলসমে প্রণবকেই কংগ্রেসের সেকেন্ড ম্যান বলা হত। ইন্দিরার মৃত্যুর পর তাই তাঁকেই প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসার তোড়জোড় শুরু হয়েছিল।

প্রণবই বসতেন কুর্সিতে, রাজীবকে বসানো হয়েছিল
পরে অবশ্য শিকে ছেঁড়েনি বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস্য প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। বিদেশ থেকে উড়িয়ে নিয়ে এসে রাজীবকে বসানো হয়েছিল ইন্দিরার আসনে। রাজীব তারপর ইন্দিরার প্রিয়পাত্রকেই বাদ দিয়েছিলেন মন্ত্রিসভা থেকে। অভিমান ভরে সরে গিয়েছিলেন প্রণব। তবে রাজীব ভুল বুঝতে পারায় পরে তাঁদের মিলমিশ হয়ে গিয়েছিল।

কর্তব্যনিষ্ঠায় অবিচল থেকে মিস্টার ডিপেন্ডেবল
প্রণব তখন ভিন্ন দল গড়লেও রাজীবের ডাকে সাড়া দিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। তারপর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু দায়িত্ববোধের কীর্তিমান পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন। নরসিমা রাওয়ের মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে মনমোহন সিংয়ের মন্ত্রিসভা পর্যন্ত তিনি কর্তব্যনিষ্ঠায় অবিচল থেকে মিস্টার ডিপেন্ডেবল হয়ে উঠেছিলেন।

জাতীয় কংগ্রেসের ‘দ্য ওয়াল’ থেকে ক্রাইসিস ম্যানেজার
ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য হিসেবে তাঁর পরিচিতি দীর্ঘদিনের। এরই মধ্যে তাঁকে জাতীয় কংগ্রেসের ‘দ্য ওয়াল' বলা হত। ভারতীয় ক্রিকেটের দ্য ওয়াল রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গেও তাঁকে তুলনা করা হয়েছে কংগ্রেসে তাঁর ভূমিকা নিয়ে। সোনিয়া গান্ধীর আমলে তিনি প্রধান পরামর্শদাতার কাজ করতেন। আর রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নেওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি কংগ্রেসের ক্রাইসিস ম্যানেজার ছিলেন।

ইউপিএ'র রাহুল দ্রাবিড় ‘দ্য ওয়াল’ প্রণব
প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ইউপিএ সরকারের রাহুল দ্রাবিড় বা ‘দ্য ওয়াল' বলে কংগ্রেস নেতা সালমান খুরশিদ একবার বর্ণনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন দল ও সরকারের ‘ঐক্যমত্য নির্মাতা' বা ‘সঙ্কট সময়ের পরিচালক'। তিনি এক সময়ে ৯০ জন মন্ত্রীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং সরকারের সংসদীয় কৌশল তৈরি করেছিলেন।

সোনিয়া গান্ধীর সবথেকে বেশি ভরসার পাত্র
ইউপিএ এবং বিরোধী দলগুলির মধ্যে সমন্বয় স্থাপনের জন্য সোনিয়া গান্ধী তাঁকে সবথেকে বেশি ভরসা করতেন। রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার যে সকল গুরুত্বপূর্ণ কমিটি, যেমন- ইউপিএ-বাম সমন্বয় কমিটি, কংগ্রেস কোর গ্রুপ, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ইত্যাদির সঙ্গে তিনিই সমন্বয় সাধন করতেন।

কুর্সি অধরা থাকলেও দায়িত্ব অবিচল প্রণব
প্রণব মুখোপাধ্যায় সাত-সাতবার সংসদ সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি কংগ্রেসের সেবা করে গিয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি কংগ্রেস সংসদীয় দলের প্রধান হুইপ এবং বিভিন্ন ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি অধরাই রয়ে গিয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি অধরা, আক্ষেপ ছিল প্রণবের
তবে কি তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ আসেনি। এসেছিল প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর দোরগোড়ায় এসে তাঁকে ফিরে যেতে হয়েছে দু-দুবার। ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসা হয়নি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। প্রণব মুখোপাধ্যায় নিজেই তাঁর লেখা বইতে এই ব্যাপারে আক্ষেপও করেছিলেন।

দীর্ঘদিন সরকারে থাকার অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও পিছপা
তিনি লেখেন- সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী পদ প্রত্যাখ্যান করার পর তাঁরই প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসার কথা ছিল। কেননা তাঁর দীর্ঘদিন সরকারে থাকার অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু কোনও এক বিশেষ কারণে তাঁর প্রধানমন্ত্রী হয়ে ওঠা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন মনমোহন সিং। সেই মনমোহন আবার সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন প্রণববাবুকেই।

দু-দু’বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসেছিল প্রণবের, কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস