ঘূর্ণিঝড় তাউকটে থেকে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ- ভারতের উপকূলে একুশে ধেয়ে এসেছে ৫ সাইক্লোন
ঘূর্ণিঝড় তাউকটে থেকে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ- ভারতের উপকূলে একুশে ধেয়ে এসেছে ৫ সাইক্লোন
২০২০ সালের সুপার সাইক্লোন আম্ফানের মতো গতি আর তেজ নিয়ে কোনও ঝড় হয়তো ২০২১-এ বয়ে যায়নি। তা বলে বাংলা বা ভারতের উপকূলে ঘূর্ণিঝড়ের কমতি ছিল না একুশে। নয় নয় করে ২০২১-এও একাধিক সাইক্লোনের সম্মুখীন হয়েছে আমাদের দেশ। বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগর উপকূলে এবার কোন কোন ঝড়ে ত্রস্ত হয়েছে, তার দিকে ফিরে দেখা বছর শেষে আর একবার।
একুশে ক’টি সাইক্লোন বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে
২০২১ সালে মোট পাঁচটি ঝড় বয়ে গিয়েছে। এবার প্রথম ঘূর্ণিঝড় হিসেবে আছড়ে পড়েছিল তাউটে বা তাউকটে। তার পথ ধরে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস, ঘূর্ণিঝড় গুলাব, ঘূর্ণিঝড় শাহিন আর সবশেষে ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ বয়ে গিয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশীয় অঞ্চলের উপকূল দিয়ে। এ বছরের সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ এই ডিসেম্বরেই শঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছিল ওড়িশা থেকে বাংলার উপকূলে।
প্রথম যে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গিয়েছিল ২০২১ সালে
ভারতীয় মহাসাগর ক্রান্তীয় অঞ্চলে বা বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগরে ঘূর্ণিঝড়ের মরশুম শুরু হয় সাধারণত মার্চ মাসে। তবে এপ্রিল-মে মাসই ঘূর্ণিঝড়ের মোক্ষম সময়। ২০২১-এ এপ্রিলের শেষদিকে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অর্থাৎ বঙ্গোপাসাগর বা আরব সাগরে নিম্নচাপ অঞ্চল তৈরি হয়। এবং ঘূর্ণিঝড় বাসা বাঁধে। সেইমতোই এ বছরে প্রথম মে মাসে ঘূর্ণিঝড় তাউকটে বা ঘূর্ণিঝড় তাউটে ধেয়ে আসে গুজরাত উপকূল অভিমুখে।
ঘূর্ণিঝড় তাউকটের হানায় ত্রস্ত হয় পশ্চিম উপকূল
ঘূর্ণিঝড় তাউকটে আম্ফানের থেকেও বেশি বেগে আছড়ে পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছিল। সেইমতোই চটজলদি সমস্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয় পশ্চিম উপকূলে। প্রায় ১৭৫ কিমি গতিতে ধেয়ে আসা সাইক্লোনে প্রায় ৭৫টি গ্রাম বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তার আগে কেরল, কর্নাটক, গোয়া থেকে শুরু করে মহারাষ্ট্র এবং সবশেষে গুজরাট উপকূলে হানা দেয় তাউকটে। লন্ডভন্ড হয়ে যায় পশ্চিম উপকূল। বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রাণহানিও ঘটে।
বছরের দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড় ওড়িশায়, ভাসে বাংলাও
ঘূর্ণিঝড় তাউকটে যখন পশ্চিম উপকূলে হানা দিয়েছে, তখনই বঙ্গেোপসাগরে তৈরি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ইয়াস পূর্ব উপকূলের দিকে ধেয়ে আসতে শুরু করে। আম্ফানের স্মৃতি উসকে ইয়াস বাংলার উপকূল অভিমুখে বয়ে আসে। তবে শেষমেশ সরাসরি বাংলার উপকূলে হানা দেয়নি ইয়াস বাংলাকে ভাসিয়ে ওড়িশা উপকূলে আছড়ে পড়ে বছরের দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড়। বাংলার উপকূলকে ভাসিয়ে দেয় ইয়াসে উত্তাল সমুদ্র। এই ঝড়ের গতিবেগ আম্ফানের থেকে কম, কিন্তু অভিঘাত অনেক বেশি ছিল। প্রবল জলোচ্ছ্বাস হয় ইয়াসের জেরে।
২০২১-এ তৃতীয় ঘূর্ণিঝড়ের অভিমুখ ওড়িশা-অন্ধ্রে
বছরের তৃতীয় ঘূর্ণিঝড় হয়ে ওড়িশা এবং অন্ধ্রপ্রদেশ উপকূলে হানা দেয় গুলাব। ঝড়ের বেগ ঘন্টায় ৭০ থেকে ৮০ কিমি। সেপ্টেম্বরের শেষে হানা দেওয়া এই ঝড়ের শক্তি ছিল অনেক কম। ল্যান্ডফলের সময় ঘন্টায় ৯০ কিমি বেগে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় গুলাব। এই ঘূর্ণিঝড় প্রথমে পশ্চিম-উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হলেও পরবর্তী সময়ে তা পশ্চিম-দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে আরব সাগরের দিকে বয়ে যায়। শক্তি হারিয়ে আরব সাগরে অবস্থান করতে থাকে।
গুলাব পরিণত হয় শাহিনে, চতুর্থ ঘূর্ণিঝড় বছরের
গুলাব আরব সাগরে গিয়ে ফের শক্তি বাড়িয়ে ঘূর্ণিঝড় শাহিনের রূপ নেয়। নাম পরিবর্তন করে তা পাকিস্তানের দিকে ধেয়ে যেতে শুরু করে। তারপর তা আরও পশ্চিমে সরে ওমানে হানা দেয়। ওমান উপকূলকে বিধ্বস্ত করে তোলে পাকিস্তানি ঘূর্ণিঝড় শাহিন। বছরের চতুর্থ ঘূর্ণিঝড় ফের পশ্চিম উপকূলে হানা দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল তাউকটের স্মৃতি উসকে। শেষমেশ তা হানা দেয় ওমানে।
২০২১ মরশুমের শেষ ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ
ঘূর্ণিঝড়ের মরশুম প্রতি বছর মার্চ মাসে শুরু হওয়ার পর থেকে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের শেষ হয়ে যায়। এই সময়ের মধ্যে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম ঘটল। এবার ডিসেম্বরে ধেয়ে এল ঘূর্ণিঝড়। ভারতীয় উপকূল অভিমুখে হানা দিল ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদ। তা নিয়ে শীতের আগে হুলুস্থুল পড়ে যায়। বাংলা-ওড়িশার উপকূলবর্তী এলাকা শাসিয়ে উপকূলের পাশ দিয়ে বাংলাদেশের দিকে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় জাওয়ার। এর প্রভাবে ঝড় না হলেও দুর্যোগ চলে তিন দিন।
এবার পাঁচটি ঝড় নিয়ে মোট ৯টি নাম ব্যবহার হল
২০২০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ছিল ২০০৮ সালে তৈরি আট সারি তালিকার শেষ ঝড়। তারপর ২০২০ সালে প্রকাশিত ১৩ সারি তালিকার নাম ব্যবহার করে হচ্ছে। এই তালিকার ন'টি ঝড় ইতিমধ্যেই বয়ে গিয়েছে বঙ্গোপসাগর ও আরব সাগর দিয়ে। ২০২০ সালেও আম্ফান-সহ পাঁচটি ঝড় বয়ে যায়। অর্থার বাকি চারটি ঝড়ের নামকরণ হয় নতুন তালিকা থেকে। আর ২০২১ সালে বয়ে যাওয়া পাঁচটি ঝড় নিয়ে মোট ৯টি নাম ব্যবহার হল ২০২০-র তালিকা থেকে।
তালিকার প্রথম সারির চারটি ঝড় অপেক্ষায়
১৩ সারি নামের তালিকায় প্রথম সারির এখনও চারটি ঝড় রয়েছে। সম্প্রতি আবহবিদরা জানিয়েছেন, শীতের মরশুম শেষে গ্রীষ্মকাল এলেই অন্তত দু-তিনটি সাইক্লোন বাসা বাঁধবে বঙ্গোপসাগরের বুকে। এই সাইক্লোনগুলির সম্ভাব্য সময় মার্চ থেকে মে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। সেই ঝড়গুলির নামকরণ হবে প্রথম সারির বাকি তালিকা থেকে। এই তালিকায় বাকি চার নাম হল- অশনি, সিতরং, ম্যানডৌস ও মোচা।
ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের পর সম্ভাব্য যে ঝড় বয়ে যাবে
জাওয়াদের পর যে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাবে তার নাম হবে অশনি। এই নাম দিয়েছে শ্রীলঙ্কা। বাকি তিন নাম যথাক্রমে থাইল্যান্ড, আরব আমিরশাহী ও ইয়েমেনের। তারপর ফের শুরু হবে দ্বিতীয় সারির নামের ব্যবহার। প্রথমেই বাংলাদেশ তারপর একে একে ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মায়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, আরব আমিরশাহী ও ইয়েমেনের পালা।
২০২০-তে তৈরি তালিকার দ্বিতীয় সারিতে যাদের নাম
মোট ১৩টি দেশ যে তালিকা তৈরি করেছে, তার দ্বিতীয় সারিতে ১৩টি নাম স্থান পেয়েছে। সেই ১৩টি ঝড়ের নাম হল পর্যায়ক্রমে- বিপর্যয়, তেজ, হামুন, মিধিলি, মিচাউঙ্গ, রিমাল, আসনা, দানা, ফেঙ্গাল, শক্তি, মোনথা, সেনইয়ার ও দিতোয়া। প্রথম সারির চারটি নামাঙ্কিত ঝড় বয়ে গেলে এই দ্বিতীয় সারির নাম ব্যবহার হবে। আসন্ন ২০২২-এই নাম ব্যবহার শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহবিদরা।