জেলে বসেই ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের গল্প কি করে ফাঁদলেন কনম্যান সুকেশ জানুন
কনম্যান সুকেশ চন্দ্রশেখরের গল্প
২০০ কোটি টাকার দুর্নীতি মামলায় হাজতবাস করছে দেশের সবচেয়ে বড় কনম্যান সুকেশ চন্দ্রশেখর। নিজের এই কাণ্ডের সঙ্গে সে নাম জড়িয়েছে বলিউড অভিনেত্রী জ্যাকলিন ফার্নান্ডেজের নামও। ইডি এই আর্থিক তছরূপের মামলার তদন্তের দায়িত্বে রয়েছে। ইডি সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলের ভেতর বসেই সুকেশ ২০০ কোটি দুর্নীতি করেছিল।
ভুয়ো সরকারি অফিসার সেজে ফোন সুকেশের
জানা গিয়েছে, প্রাক্তন এক ধনকুবের যখন জেলে ছিলেন সেই সময় তাঁর স্ত্রী স্বামীর জামিন করানোর জন্য অর্থ লেনদেন নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতেন। তিনি ভেবেছিলেন যে তিনি যাঁর সঙ্গে কথা বলছেন তিনি আসলে দেশের স্বারাষ্ট্র সচিব সহ শীর্ষ সরকারিক আধিকারিকেরা। প্রাক্তন ধনকুবেরের স্ত্রীর সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দেখা করিয়ে দেবেন বলেও জানিয়েছিলেন ওই কর্মকর্তা তবে তা তখনই সম্ভব যখন ধনকুবেরের স্ত্রী তাঁকে সহযোগিতা করবেন। তিনি প্রতিশ্রুত ফলাফল ছাড়াই অর্থ প্রদানের বিষয়ে আলোচনা করেন এবং সরকারি কর্মকর্তা জানান যে তাঁর দেওয়া অর্থ 'পার্টি ফান্ডে' যাবে।
চ্যাট ও ফোন কলস রেকর্ড
ওই মহিলা যে একজন ছদ্মবেশী প্রতারকের সঙ্গে কথা বলেছিলেন এবং তাঁর থেকে কোটি টাকা প্রতারণা করে নেওয়া হয়েছে, তা বুঝতে বেশ কয়েকমাস সময় লেগে যায় ওই মহিলার। এরপর এ বছরের জুলাই মাসে তিনি এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টটোরেটকে গোটা ঘটনাটি সম্পর্কে জানান এবং মহিলা ওই ভুয়ো বষক্তির চ্যাট রেকর্ড করা শুরু করে দেন। এরপর সেই চ্যাটের রেকর্ড তুলে দেওয়া হয় ইডির হাতে এবং দুর্নীতি ও ২০০ কোটি টাকার আর্থিক প্রতারণা নিয়ে ওই মহিলা দিল্লি পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন।
কাহানি মে টুইস্ট
ভাববেন না এখানেই শেষ, টুইস্ট আরও বাকি আছে। যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য টুইস্ট হল যে ব্যক্তি ওই মহিলাকে ফোন করেছিল, সে আসলে জেলে রয়েছে। ওই ব্যক্তি কোনওভাবে একটি ফোন জোগাড় করে এবং এমন একটি সফ্টওয়্যার ব্যবহার করে যা তাকে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের ফোন নম্বর 'প্রতিলিপি' বা 'স্পুফ' করতে দেয়। মহিলার জমা করা সব রেকর্ডিংয়ের মধ্যে ৮৪টি রেকর্ডিং ইডি ইতিমধ্যেই দিল্লি আদালতে জমা দিয়ে দিয়েছে, যার মাধ্যমে সুকেশ চন্দ্রশেখরকে জব্দ করা যায়, যে ২০১৭ সাল থেকে জেলে রয়েছে। সুকেশের অপরাধ হাতেনাতে ধরতে এই স্টিং অপরেশনে যিনি সহায়তা করেছেন তিনি হলেন অদিতি সিং, যাঁর স্বামী শিবিন্দর সিং, যিনি তাঁর ভাই মলবিন্দর সিংয়ের সঙ্গে যৌথভাবে র্যানব্যাক্সি ফার্মা চালাতেন। আর্থিক তছরূপ মমলায় ২০১৯ সালে গ্রেফতার হন শিবিন্দর সিং।
একাই ২০০ কোটির প্রতারণা করে সুকেশ
সুকেশ চন্দ্রশেখরের বিরুদ্ধে কোনও সরকারি কর্মকর্তা কোনও অভিযোগ দায়ের করেননি। কারণ ২০০ কোটি টাকা থেকে কোনও টাকাই সরকারি কর্মকর্তার কাছে পৌঁছায়নি, এখানে কোনও ঘুষের কাণ্ড যুক্ত ছিল না। সুকেশ চন্দ্রশেখরের বিরুদ্ধে অদিতি সিং পুলিশ মামলা দায়ের করেন, অভিযোগ বলা হয় যে তাঁকে ২০০ কোটি টাকা দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ২০২০ সালের জুন মাস থেকে, অদিতি সিং, যাকে তিনি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ভেবেছিলেন তার সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করেছিলেন।
একাধিক সরকারি কর্মকর্তাদের নাম করে ফোন
অন্যদিকে ছদ্মবেশ ধরতে ওস্তাদ সুকেশ চন্দ্রশেখর এক-একবার ভিন্ন ভিন্ন সরকারি কর্মকর্তাদের নম দিয়ে অদিতি সিংকে ফোন করত। কখনও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের শীর্ষ আমলা অজয় ভল্লা কখনও বা দেশে ন্যায়বিচার সচিব অনুপ কুমার আবার কখনও বা জুনিয়র আইন মন্ত্রকের অফিসা অভিনব নাম দিয়ে অদিতি সিংকে ফোন করে অর্থ সংক্রান্ত আলোচনা করত। সুকেশ চন্দ্রশেখর এবং অদিতি সিংয়ের ফোন তাদের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন মামলার জন্য ট্যাপ করা হয়েছিল। তাঁদের এই কথোপকথন চলে ১১ মাসের বেশি সময় ধরে। তদন্তকারীদের মতে, অদিতি সিং পরবর্তী কথোপকথনগুলি রেকর্ড করেছিলেন। তাঁর বোন অরুন্ধুতি খান্নার ফোন কলও ট্যাপ করা হয়, যেখানে অর্থপ্রদানের জন্য তাঁর পরিবার কীভাবে তাঁদের সম্পত্তি ব্যবহার করছে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। ইডির কাছে সব রেকর্ডিং জমা দেওয়া হয়।
সুকেশকে নিয়ে সন্দেহ জাগে অদিতির বোনের
জানা গিয়েছে যে সুকেশ চন্দ্রশেখর, তার বিভিন্ন অবতারে, সুপ্রিম কোর্টে জামিন শুনানির কথা উল্লেখ করে এবং তাঁদের কাছে নগদ অর্থ দাবি করে। অদিতি সিং-এর বোন অরুন্ধুতী, আদালতের কার্যক্রমের এই সরাসরি পদ্ধতি উল্লেখ করে তাঁর অস্বস্তি প্রকাশ করেন। তিনি ছদ্মবেশী সুকেশকে ফোনে বলেছিলেন, 'এত চাপ দিলে ভাই আমি কাজ করতে পারব না। আমি আগেও এটা বলেছি। এগুলি হওয়ার আগেই বলেছি। এটা শুধু সমস্যা, ঝামলা, আরও বেশি ঝামেলার সৃষ্টি করছে। আর আমরা জানিও না যে আপনি টাকাগুলি কোথায় ব্যবহার করছেন। আমি কখনও এটা আপনাকে জিজ্ঞাসাও করিনি, আমি কাউকে বলিওনি। আমি জানতে চাইও না। কারণ আমরা এটা পার্টি ফান্ডের জন্য দিয়েছি। আমরা অনুদান দিয়েছি। আপনি সেই অনুদান কিসের জন্য ব্যবহার করছেন? আপনি এই টাকা নির্বাচনের কাজে অথবা গঙ্গা দূষণ রোধের কাজে বা গাছ লাগানোর কাজে ব্যবহার হবে তা আপনার ওপর নির্ভর করছে। আমরা জানি না তাই কিছু জিজ্ঞাসা করিনি।'
অদিতি সিংকে ভুয়ো প্রতিশ্রুতি
একটি কথোপকথনে শিবিন্দর সিং জেল থেকে অংশ নিয়েই তাঁর স্ত্রী ও আইন সচিবের মধ্যে বৈঠক করানোর কথা শোনা যায়। স্বরাষ্ট্র সচিব অজয় ভল্লা অদিতি সিংকে প্রতিশ্রুতি দেন এই বৈঠক করিয়ে দেওয়ার জন্য। ছদ্মবেশী সুকেশ সেই সমময় জানিয়েছিল যে তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ ব্যক্তিগতভাবে অদিতি সিংকে ফোন করার কথা বলেছিল। সুকেশ এও জানায় যে সরকারি কর্মকর্তারা অদিতি সিংয়ের স্বামীর জামিনের জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন তবে এটি সম্পূর্ণভাবে তাঁর সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। অদিতি সিং সেই সময় সব ধরনের সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন এবং আইন সচিবের সঙ্গে বৈঠক করতে চান। 'অজয় ভাল্লা' জানান যে তিনি সঠিক সময়ে এই বৈঠক করাবেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করানো হবে অদিতি সিংকে বলে প্রতিশ্রুতিও দেন।
অগাস্টে অভিযোগ দায়ের অদিতি সিংয়ের
এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী এ বছরের অগাস্টে দিল্লি পুলিশের কাছে অদিতি সিং সুকেশ চন্দ্রশেখরের বিরুদ্ধে তাঁর কাছ থেকে ৩০টি ইনস্টলমেন্টে ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযোগে, তিনি অনুপ কুমার (আইন সচিব) এবং আন্ডার সেক্রেটারি অভিনব এর কাছ থেকে কল পেয়েছেন বলে জানান এবং এই দু'জনকে একাধিক ধাপে টাকা দেওয়ার কথাও অভিযোগে বলা হয়। অদিতি সিং তাঁর অভিযোগে বলেন, 'এই ব্যক্তিরা আমাকে ভয় দেখাতে শুরু করে, হুমকি দেয়। তাই আমি ধীরে ধীরে আমার গয়না, জমানো অর্থ ও অন্যান্য সম্পত্তি বেচে তাঁদের ২০০ কোটি টাকা দিই। এমনকী এরপরও হুমকি থামে না। তাঁরা আমার বিদেশে পড়াশোনা করা সন্তানদেরও কেরিয়ারে ক্ষতি করবেন বলে জানান।' এরপরই তিনি ইইডির দ্বারস্থ হন।
কনম্যান সুকেশের টার্গেট কি শুধুই ছিল মহিলারা
সুকেশ চন্দ্রশেখরের একাধিক 'টার্গেট'দের মধ্যে অদিতি সিং ছিলেন একজন। সুকেশ চেন্নাইতে বিলাসবহু জীবন যাপন করতেন সমুদ্রের পাড়ে থাকা ৮২ লক্ষের বাংলোতে এবং ফেরারি, বেন্টলে ও রয়্যাল রয়েস সহ ২৩চি গাড়ির মালিক ছিলেন সুকেশ। নিজের প্রেমের জালে জড়িয়েছেন জ্যাকলিনকেও। জ্যাকলিন ইডির জেরার মুখে স্বীকার করেছেন যে সুকেশ তাঁকে দামি দামি উপহারে ভরিয়ে দিয়েছিল। তবে জ্যাকলিন কোনওভাবে তার সঙ্গে বেআইনি আর্থিক চুক্তির সঙ্গে যুক্ত ছিল না।