করোনা মহামারির সঙ্গে লড়াই করুন এই ১৫টি পদক্ষেপ মেনে
করোনা মহামারির সঙ্গে লড়াই করুন এই ১৫টি পদক্ষেপ মেনে
করোনা ভাইরাস ভয়ঙ্কর হলেও এটা ঠিকই খতম হবে। চিন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ান যেভাবে তারা ক্রমাগত এই সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই রোগের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য দেশের নেতাদের কাছ থেকে অর্থ ও সহযোগিতা চাইছে এবং দেশের নাগরিকদের কাছ থেকে বিশ্বাস ও সহয়োগিতা আশা করছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধ হতে পারে, যদিও এটি একটি ছোঁয়াচে রোগ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চিকিৎসক ডেভিড এল হেম্যান জানিয়েছেন যে করোনা ভাইরাস ক্রমবর্ধমানভাবে ছড়িয়ে পড়েচিল ডায়মন্ড প্রিন্সেস জাহাজে। যেখানে পরিবারের সদস্য, বন্ধু–বান্ধব ও সহকর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই জীবাণু কেন এভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তার সঠিক কোনও ধারণা দিতে পারেননি বিশেষজ্ঞরা। তবে এই সংক্রমণ রোগ থেকে বাঁচতে বেশ কিছুদিন অসামাজিক হয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন সকলে। বেশ কিছু নির্দেশ মেনে চললেই এই করোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করা সহজ হবে।
শহরগুলির মধ্যে সংক্রমক বন্ধ হোক
পরবর্তী পদক্ষেপ হিসাবে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে চূড়ান্তভাবে সোশ্যাল দুরত্ব বজায় রাখা হোক। মহামারি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে, যদি কোনও যাদুবিদ্যার দড়ি ছড়িয়ে দিয়ে এবং আমেরিকানদের ৬ ফুট দূরে বসিয়ে ১৪ দিনের জন্য স্থির করে রাখা সম্ভব হত তবে পুরো মহামারিটি থেমে যেত। কিন্তু বাস্তবে কোনও যাদুর দড়ি নেই। কিন্তু লকডাউন ও চূড়ান্ত দুরত্ব বজায় রাখার মাধ্যমে এই বিষয়টি করা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে ভ্রমণ ও মানুষের সংস্পর্শে আসা একবারেই কমিয়ে দিতে হবে।
শহরের ভিতরে সংক্রমণ বন্ধ হোক
শহরের ভেতর সংক্রমণ বন্ধ রাখাই সবচেয়ে কঠিন কাজ। একটি রেস্তোঁরা, একটি জিম, একটি হাসপাতাল, এমনকি একটি ট্যাক্সিতে খুব কাছের কারোর সঙ্গে বসে আছেন কিন্তু তার মধ্যে হয়ত কাশি-সর্দি রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন রোজ মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হতে দেরি হচ্ছে। যত দেরি হবে তত এই সংক্রমক রোগ বেড়ে যাবে। সব ধরনের কাজ এই সময় বন্ধ রেখে দেওয়া ভালো। যদিও চিকিৎসক, নার্স, অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা ও তার চালক, পুলিশ, দমকলবাহিনী তাদের কাজ থামাতে পারবে না। এমনকী ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, ডেলিভারি বয় ও ওষুধ দোকানের কর্মীদেরও তাঁদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
পরীক্ষার বিষয়টি সঠিকভাবে নির্ধারণ করুন
পরীক্ষা করা হোক সমন্বয়তা ও নিরাপদের সঙ্গে, জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গুরুতর অসুস্থ যাঁরা তাঁদের আগে পরীক্ষা হোক ও পরীক্ষকদের অবশ্যই সুরক্ষিত রাখতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরীক্ষার জন্য চিকিৎসকদের ডাকা হচ্ছে বা অনেকেই হাসপাতালের পার্কিং লটে অপেক্ষা করছেন পরীক্ষার জন্য। শুক্রবার নিউ ইয়র্কে খুব সীমিত সংখ্যার রোগীদের পরীক্ষা করানো হয় যাঁরা হাসপাতালের ভর্তি হবেন এমন।
সংক্রমক রোগীকে বিচ্ছিন্ন রাখা
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমক ব্যক্তিকে পরিবার থেকে আইসোলেট করে রাখা হয়েছে, যাতে কোনওভাবে এই রোগটি ছড়িয়ে না পড়ে। চিনে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ সংক্রমক হয়েছে পরিবার থেকে। তাই রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে যে সংক্রমক ব্যক্তিকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে শহরগুলিতে এমন সুযোগ-সুবিধা স্থাপন করা উচিত যেখানে হাল্কা ও মাঝারি অসুস্থরা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। উহানে ডর্মিটারি ও ফার্স্ট-এইড ক্লিনিকে তৈরি করা হয়েছে ‘অস্থায়ী হাসপাতাল'। খাট ও অক্সিজেন ট্যাঙ্কেরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু জায়গায় আইসোলেটেড ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। নিউ ইয়র্কে ইতিমধ্যেই জ্যাকোব কে জাভিটস কনভেনশন সেন্টারকে অস্থায়ী হাসপাতালে পরিণত করা হয়েছে।
জ্বর দেখা প্রয়োজন
চিন, তাইওয়ান এবং ভিয়েতনামে ২০০৩ সালে সার্স আক্রান্ত হয়েছিল এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্স তাই বর্তমানে যে কোনও রোগের প্রকোপের ক্ষেত্রেই জ্বর দেখাটা বাধ্যতামূলক। এশিয়ার অধিকংশ করোনা আক্রান্ত দেশের সবর্ত্র তাপমাত্রা পরীক্ষার বন্দোবস্ত করা হয়েছে এবং হাত ধোওয়ারও ব্যবস্থা কিছু কিছু জায়গায় দেখা যাচ্ছে।
সংস্পর্শে আসা সকলকে সনাক্ত করা
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে প্রত্যেক পজিটিভ আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের সনাক্ত করে তাদের পরীক্ষা করা জরুরি। মহামারি হওয়ার মুখে উহানে এক পজিটিভ ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ১৮ হাজার জনকে সনাক্ত করে পরীক্ষা করা হয়।
মাস্কের ব্যবহার
সার্জিক্যাল মাস্কগুলি স্বাস্থ্যকর ব্যক্তিদের রোগ থেকে রক্ষা করে, এ বিষয়ে খুব কম তথ্যই রয়েছে। যদিও এশিয়ার দেশগুলিতে এই মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়েছে। সব বিশেষজ্ঞরাই জানিয়েছেন যে সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরই মাস্ক পরা জরুরি। তবে যদি সবাই মাস্ক পরতে শুরু করে তবে অসুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এটা শুধুমাত্র প্রযোজ্য হবে না। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন যে আমেরিকানরা করমর্দন ও আলিঙ্গন করা থেকে দূরে থাকার কড়া নির্দেশ পালন করছে। অন্যদিকে ‘হু এলবো বাম্প' শুনতে মজার মনে হলেও তা সংক্রমণ থেকে প্রতিরোধ করার দারুণ উপায়।
গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা সংরক্ষণ
মহামারির সময় কিছু গুকুত্বপূর্ণ জিনিস নিজের কাছে রেখে দিন। খাবার, জল, বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম, গ্যাস, ফোন লাইন ও অন্য প্রয়োজনীয় জিনিস ঘরে রাখুন।
উচ্চ–পর্যায়ের সিদ্ধান্ত দ্রুত গ্রহন করুন
অনেক পশ্চিমা রাজনৈতিক নেতারা এমনভাবে আচরণ করছেন যেন তারা দড়ির উপরে রয়েছে। হু-এর কোভিড-১৯-এর বিশেষ দূত ডাঃ ডেভিড ন্যাবারো বলেন, ‘তবে উপায় নেই। এটার সঙ্গে লড়াই করার জন্য আমাদের অবশ্যই সব শক্তি লাগিয়ে দেওয়া উচিত।' তাই হু মনে করছে সরকারি যে কোনও সিদ্ধান্তই তৎপরতার সঙ্গে দ্রুত নেওয়া হোক।
ভেন্টিলেটর ও অক্সিজেন উৎপাদন
অনেক পরিমাণে এখন ভেন্টিলেটর ও অক্সিজেনের প্রয়োজন রয়েছে। তাই প্রত্যেকটি দেশেরই উচিত এই দু'টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের উৎপাদন বাড়িয়ে দেওয়া।
রেট্রোফিট হাসপাতাল
যুক্তরাষ্ট্রে হাসপাতালগুলি রোগীদের পরিচালনা করার জন্য বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে, যেমন ইলেক্ট্রিক সার্জারি বন্ধ করা এবং বিচ্ছিন্ন কক্ষ স্থাপন করা। এছাড়াও কিছু সেনা হাসপাতালেও বন্দোবস্ত করে রাখা হয়েছে। কিন্তু সবড় ধরনের সার্জারি এই সময় বন্ধ রাখা হয়েছে। একমাত্র খুব প্রয়োজন না ছাড়া। উহানে চিন সরকার দু'সপ্তাহের মধ্যে দু'টি নতুন হাসপাতাল গড়ে ফেলেছিল।
স্কুল বন্ধ রাখা
শনিবার পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী ৪৫ টি দেশের স্কুল বন্ধ করে রাখা হয়েছে। আরও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে জানা গিয়েছে। যদিও এটা এখনও নিশ্চিত নয় যে শিশুরাও করোনা ভাইরাস সংক্রমণ করছে। কারণ তারা অসুস্থ হলেই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে।
স্বেচ্ছা সেবক নিয়োগ
চিনের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে কারণ শত শত স্বেচ্ছা সেবকরা সরকারের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে এই মহামারির সময়ে কাজ করেছে। সরকার এটিকে ‘জনগণের যুদ্ধ' ঘোষণা করে এবং ‘ফাইট অন, উহান! ফাইট অন চিন!'-এর প্রচার করে। তাই স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হোক অনেক। যাঁরা দেশের দুঃসময়ে পাশে থাকতে পারে।
চিকিৎসাকে অগ্রাধিকার দেওয়া
করোনা ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যান। চিকিৎসা করান। রোগ চেপে রেখে তা নিজেরও যেমন ক্ষতি করছেন তেমনি অন্যকেও বিপদের দিকে ঠেলছেন। তাই চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী চলুন। এছাড়াও চিন, ইতালি ও ফ্রান্স তাদের হাসপাতালের মেডিক্যাল স্টোরে থাকা সব ধরনের ওষুধের প্রয়োগ করেছে রোগীর ওপর। ম্যালেরিয়া বিরোধী ওষুধ ক্লোরোকুইন এবং হাইড্রোক্সাইক্লোরোকুইন এবং অ্যান্টিভাইরাল রিমেডেসিভির, যার কোনও লাইসেন্সযুক্ত ব্যবহার নেই, এগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল।
প্রতিষেধক বের করা
এই সংক্রমকের চূড়ান্ত আশা হল প্রতিষেধক বের করা। যা সকলকে এই রোগের হাত থেকে সুরক্ষা দেবে। বেশ কিছু সরকার ও ওষুধ সংস্থা এই প্রতিষেধক বের করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। তবে প্রতিষেধক বের হওয়ার পরও কয়েকমাস চূড়ান্ত পরীক্ষার পরই তাতে সিলমোহর দেওয়া যাবে। ততদিন সাবধানে থাকার পরামর্শই দিচ্ছে বিশেষজ্ঞরা।