প্রবাসে বসেও বাংলায় পড়ে থাকে মন, এভাবেই পুজো কাটে দিপালিকা- ইন্দ্রাণীদের
যারা বাংলার বাইরে থাকেন, তারা কোথাও না কোথাও বাংলাকে এই দুর্গার পুজোর সময় বেশি করে মিস করেন। তাই যেখানেই বাঙালি যায় সেখানে কয়েকজন হলেই শুরু হয়ে যায় দুর্গাপুজো। তেমনভাবেই উত্তরপ্রদেশেও তাই হয়। এমনই হলেন দিপালিকা ব্যানার্জি এবং ইন্দ্রাণী সূত্রধররা।
দিপালিকা ব্যানার্জি বলেছেন, "আমি জন্ম থেকেই প্রবাসী। তিন পুরুষ বাস করছে প্রবাসে। উত্তরপ্রদেশের মক্ষস্থল কাশীতে জন্ম। একান্ন পীঠের এক পীঠস্থান ও বিশ্বনাথ-অন্নপূর্ণা মন্দিরের জন্য বিখ্যাত এই শহর। বাল্য ও কৈলাশের পার হয়েছে এই শহরে। ভোরবেলায় গঙ্গাস্নান ও কেদারনাথের মন্দির দর্শন। ব্রহ্ম-মুহূর্তে বেরিয়ে শুনতে পেতাম বিজয়নগর মহারাজের নহবতে সানাইয়ে ভারের রাগ-রাগিণী। আমাদের চলতি কথায় বেনারস' শুধু মন্দির ও উত্তরবাহিনী গঙ্গার জন্য বিখ্যাত নয়, এ শহর সুরেরও তীর্থক্ষেত্র। সুরে-তালে ঢেউ তালে গঙ্গার জল। এছাড়াও বিশেষ আকর্ষণ সারনাথ।"
তাঁর কথায়, "বৌদ্ধ সভ্যতার ইতিহাস বহন করে চলেছে এখানকার ধাম। কিশোরের অবস্থা যখন মধ্যগগনে তখন হঠাৎ ছবি বদলে গেল। বেনারসের মতন ছোট্ট সাদা-মাটা শহর থেকে গিয়ে পড়লাম কলকাতায়, যেটা আমাদের কাছে বিশাল ব্যাপার। ছোটবেলার সেই বেনারসের পরিবেশ আজও ভুলতে পারি না। আমাদের সময় সন্ধেবেলায় গঙ্গা আরতির প্রচলন ছিল না। দু'ধারে ফাঁকা নিঃস্তব্ধ রাস্তা ছিল দুর্গাবাড়ির ও সংকট মােচনের। সেই রাস্তা এখন জনবহুল। সেখানে হয়েছে 'তুলসী মানস মন্দির', মেলা হয় দুর্গাকুণ্ডুর পাশে। সবই আছে তবে হারিয়ে গিয়েছে সেই ভক্তি, সেই শুদ্ধ সুর। কলকাতার জীবনটা ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গেল। ভাষা বিভ্রাট কাটল। বাংলা ভাষা ভালাে করে শিখতেই হবে। মার কাছেই প্রধানত বাংলা ভাষার শিক্ষা। আমার মা বেনারসের মেয়ে হলেও বাংলা ভাষায় মায়ের ভাল জ্ঞান ছিল। প্রবাসী বাঙালি সবাই সবার পরম আত্মীয়, সুদিন-দুর্দিনের বন্ধু। অথচ কলকাতায় সে পরিবেশ নেই। কেউ বিশেষ কথাই বলে না। নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হতে বেশ সময় লাগল। ছুটি পড়তেই পালাও বেনারস। দেখতে দেখতে স্কুলের গণ্ডি পার হলাম। কলেজের জীবন আবার অন্য স্বাদের। পড়াশােনার সঙ্গে কিছু বাড়তি স্বাধীনতা। কলেজের দিনগুলোতে যেন চটপট পার হয়ে গেল।"
বিয়ের পর
কলকাতার
জীবনে
বেশ
অভ্যস্ত
হয়ে
গিয়েছি।
এ
বার
আবার
সেই
প্রবাসে
বাস।
বিয়ে
হয়
'কানপুরে'।
কানপুরে
এক
সময়ে
প্রায়
৮০
হাজার
বাঙালি
ছিল।
তার
কারণ
কী
জানেন?
চলে
এলাম
আবার
সেই
উত্তরপ্রদেশে।
এ
বারের
শহর
সিপাহী
বিদ্রোহের
অন্যতম
শহর।
অর্ডিন্যান্সের
হেড
অফিস
কলকাতায়।
এক
সময়ে
বাঙালি
ও
মরাঠিদের
শিক্ষিত
বলে
বেশ।
আয়ুধ
নির্মাণী
বা
অর্ডিন্যান্স
ফ্যাক্টরি
ও
কটন
মিল
টেনে
আনে
চাকুরিজীবী
বাঙালিকে।
নাম
ডাক
ছিল।
বাঙালি অর্ডিন্যান্সে চাকরি
সেই
সুবাদে
ইংরেজ
আমল
থেকেই
বহু
বাঙালি
অর্ডিন্যান্সে
চাকরি
পায়।
পূর্ব
বাংলার
বাঙালিরা
প্রথম
বাংলাদেশের
বাইরে
পা
বাড়ালেন।
এখানে
তাই
বিদেশি।
(বাংলাদেশি)
বাঙালির
সংখ্যা
বেশি।
বাংলাদেশ
থেকে
হাজার
কিলােমিটার
দূরে
বাংলাদেশের।
জিনিস
পাওয়াও
মুশকিল।
কিছু
বাঙালি
এলেন
ব্যবসার
উদ্দেশ্যে।
এবার
আর
এক
সমস্যা
পুজো,
বিয়ে,
উপনয়ন
ইত্যাদির
পুরােহিত
কোথায়
পাওয়া
যায়?
ফ্যাক্টরির
লােকেদের
মধ্যে
দু-একজন
অবসর
সময়ে
পুরােহিতের
অভাব
পূর্ণ
করলেন।
বাঙালি সমাজ
এই ভাবে গড়ে উঠল বাঙালি সমাজ। ক্রমশ গড়ে উঠল ক্লাব, যাত্রার দল, নাটকের দল। এ বার কিছু বয়স্ক মানুষ ভাবতে আরম্ভ করলেন অবসর নেওয়ার পর কোথায় যাবেন। বহু দিন ভিটে-মাটি ছাড়া। দীর্ঘ দিন প্রবাসে বাস করে জীবন যাপনও অন্য ধরনের হয়ে গিয়েছে। একটা প্রচলিত কথা আছে'যে খায় চিনি, তারে জোগায় চিন্তামণি"। ঠিক সেই রকমই চিনির জোগাড় হল। কানপুরে এলেন এক জন বাঙালি প্রশাসক শ্রী বসুমল্লিক। তাঁকে জানান হল অর্থাৎ আবেদনপত্র দেওয়া হল। আরমাপুর এস্টেটে তখন বাঙালির সংখ্যা বেশি। কাছাকাছি জমি পেলে ভালো।
বাঙালিরা খুশি
শহর
থেকে
দূরে
হলেও
পানকি
জমি
পেয়ে
বাঙালিরা
খুশি।
সত্তর
ভাগ
জমি
পেলেন
বাঙালিরা।
এই
পানকীর
প্রথম
পাকা
বাড়ি
তৈরি
হয়
১৯৯৮
সালে
এখন
যেখানে
আমার
বাস।
এই
জমি
চাষের
জমি
ছিল,
গ্রাম
ছিল
'সাহাপুর'
যার
চিহ্ন
আজ
আর
নেই।
আমি
এখানে
১৯৭৯
সালে
এসেছি।
বাড়ির
পূর্ব-উত্তর
কোণাকুণি
সােসাইটির
জমিতে
এখনও
চাষ
হয়।
পরে
কিষাণও
সেই
জমি
বেচে
দেয়।
এক
সময়
আমরা
ঠাট্টা
করে
বলতাম
'রিটায়ার্ড
আরমাপুর
কলোনি।
যেখানে
এত
বাঙালি
সেখানে
দুর্গাপূজা
হবে
না,
তা
হয়
নাকি?
১৯৮৫
সাল
থেকে
দুর্গাপূজাও
আরম্ভ
হল
এই
পানকিতে।
কানপুরের
আর
এক
নাম
ছিল।
বলা
হত
'ম্যাঞ্চেস্টার
অফ
ইন্ডিয়া।
কলকারখানার
শহর
হলেও
রুক্ষ
নয়।
কানপুরের
ম্যাসাকার
ঘাট,
সতী
চৌরাহ,
রানা
রাও
পার্ক
আজও
ব্রিটিশ
সন্ত্রাসবাদের
কাহিনি
বলে।
এখানকার গঙ্গা ও বেনারসের মতন উত্তরবাহিনী। যেখানে বাঙালি সেখানে কালীবাড়ি ও দুর্গাপুজো। কানপুরেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রায় একশো বছরের পুরনো 'শিবালয় কালীবাড়ি'। এখানে এখনও ভাগান্ন দিয়ে ষাড়শ উপাচারে মায়ের পূজা হয়। দূর সম্পর্কের আত্মীয়তার সুবাদে এক বার ভাগান্ন পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। ভাগের অন্ন অমৃত সমান।
দুর্গোৎসব জাতীয় উৎসব
এ বার বলি দুর্গাপূজার কথা। দুর্গোৎসব আমাদের জাতীয় উৎসব। তবে আজকাল বাঙালির একচ্ছত্র আধিপত্য আর নেই। কানপুরে পঞ্জাবি ও সর্দারজিদের অল্পবয়সি ছেলেরাও ৯৮ সাগ্নিক দুর্গাপূজা করে। সব পূজার আয়োজনে হয়তো আমাদের মতে হয় না, কিন্তু বাংলার সংস্কৃতিটা যে ওদের ভাল লাগে সেটাও আমাদের কম পাওনা নয়।
দুর্গাপূজার
আনন্দ
এখানে
অন্য
রকম।
পূজার
মণ্ডপ
ঘিরে
মেলাও
বসে।
পূজার
দিনগুলো
মণ্ডপেই
কেটে
যায়।
পূজার
জোগাড়
করতে
করতে
চলে
গল্প,
ঠাট্টা।
মঞ্চে
চলে
ছােটদের
নানারকম
প্রতিযোগিতা।
মহিলাদের
জন্যও
মহানবমীর
দিন
থাকে
প্রতিযোগিতার
ব্যবস্থা।
কোথাও
কোথাও
প্রসাদ
বিতরণ
করা
হয়
জনসাধারণের
জন্য,
কোথাও
আবার
মহানবমীর
দিনই
ভাগের
ব্যবস্থা।
রাতে
হয়
নানারকম
সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠান।
মহালয়ার
পর
প্রতিপদ
থেকে
আরম্ভ
হয়
'রামলীলা'।
অনেকটা
যাত্রার
মতাে
খােলা
মঞ্চে
হয়
'রামায়ণ
বা
রামলীলা।
সব
ধর্মের
মানুষ
এই
নাটকে
অংশ
নেন।
দশমীর
দিন
হয়
রাবণবধ।
একইসঙ্গে শেষ হয় দুর্গাপূজা ও রামলীলা। দুর্গাপুজো ধর্মীয় অনুষ্ঠান, যাকে ঘিরে 'আমরা বাঙালি ভাবখানা বজায় রেখেছে। আর এক অনুষ্ঠানও মনে করায় আমাদের সংস্কৃতি পয়লা বৈশাখ, নববর্ষ। নানা অনুষ্ঠান হয়। এ ছাড়াও কিছু উদ্যমী বাংলার ঐতিহ্যটাকে ধরে রাখতে চেষ্টা করেন। এই উদ্যমী বাঙালিদের অক্লান্ত পরিশ্রমের সুফল 'বাংলা মেলা'। কলকাতা থেকে শিল্পীরা আসেন। মেলার সঙ্গে দু'দিন ধরে অনুষ্ঠান চলতে থাকে। প্রায় এক হাজার বাঙালির সমাগম হয় এই মেলায়। এ ছাড়া মূক ও বধিরদের স্কুলের জন্য সাহায্য দান ও তাদের অনুষ্ঠান। সব মিলিয়ে বাঙালির বিরাট প্রাপ্তি। এ ছাড়া নানা রকম নাটক, নৃত্যনাট্য ইত্যাদি হয়।
তিনি বলছেন, ভাবতে ভাল লাগে আমরা বাংলাদেশ থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে থেকেও আমাদের ঐতিহ্যকে ভুলিনি। এখনও আমরা বাংলা বলি, বাংলায় ভাবি, বাংলায় গাই গান'। তবে এই বাঙালিয়ানা কত দিন বজায় থাকবে জানি না। কানপুর আজ মরা শহর। পুরনাে কারখানার দরজা বন্ধ, খােলেনি নতুন কারখানা। যে শহরে চাকরি নেই সে শহরে বাঙালি নেই। বাঙালির সংখ্যা তাই কমছে। মানুষের কাছে সময় কম, রুচি বদলে যাচ্ছে। নতুন সামাজিক ব্যবস্থায় নিজেদের কিছুটা বদলে নিয়ে আমরা বেঁচে আছি। কোন এক অদ্ভুত কারণে কানপুর ও তার পরিবেশ ও প্রতিবেশীদের ভালবেসে ফেলেছি। ভেঙে পড়া রাজপাটের সাক্ষী হয়ে এখানেই শেষ দিন পর্যন্ত কাটিয়ে যেতে চাই- অবশ্যই বাঙালি হয়ে।