গৌরী লঙ্কেশ খুনের তদন্তে ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে হিন্দুত্ব-যোগ, জেনে নিন ধৃত অভিযুক্তের স্ত্রীর বয়ান
হিন্দুত্ববাদি গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে গৌরী লঙ্কেশ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের সংযোগের পারিপার্শ্বিক প্রমাণ ক্রমে বাড়ছে।
২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বেঙ্গালুরুতে নিদের বাড়ির সামনেই খুন হন সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ। সনাতন সংস্থা বা তার শাখা সংগঠন হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি বরাবর এই খুনের সঙ্গে তাদের সংযোগ অস্বীকার করলেও তদন্তে যেসব পারিপার্শ্বিক প্রমাণ উঠে আসছে, তাতে আটক অভিযুক্তদের সঙ্গে এই সংগঠনগুলির ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এমনটাই দাবি তদন্তকারীদের। যদিও এখনই সরাসরি এই সংগঠনগুলির নাম তাঁরা বলছেন না, তবে তাঁদের দাবি, সব তথ্য প্রমাণই এই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির দিকেই ইঙ্গিত করছে।
গৌরী লঙ্কেশ খুনে এখন অবধি যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম মাদ্দুরের কে টি নবীন কুমার। এই খুনে যে গুলি ব্যবহার করা হয়েছিল, অভিযোগ তার জোগান দিয়েছিলেন এই নবীন কুমারই। সেই সঙ্গে ঘটনার কদিন আগে থেকে গৌরীর বাড়ি ও অফিসে নজরদারিও চালিয়েছিল সে। গত ২৮ মে তারিখে ৩৭ বছরের নবীনের নামে চার্জশিট পেশ করেছে কর্ণাটক পুলিশের স্পেশাল ইনভেস্টিগেটিং টিম। এর সঙ্গে নবীনের স্ত্রী সরকারী কর্মচারী রূপা সিএন-এর একটি বিবৃতিও জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে তাঁর স্বামীর সঙ্গে সনাতন সংস্থার সঙ্গে যোগ স্পষ্ট হয়েছে। এছাড়া গৌরী খুন হওয়ার দিন তার গতিবিধিও জানা গিয়েছে।
রূপা সিএন জানিয়েছেন, ঘটনার দুদিন আগে নবীন বাড়ি ছিল না। রূপাকে বলেছিল সে হুব্বালিতে এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরের দিনই সে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফেরে। সঙ্গে তার ব্যাগও ছিল না। রুপাকে সে জানিয়েছিল, ট্রেনে ভুল করে ব্যাগ ফেলে এসেছে। আরও বলে তার শরীর ভাল লাগছে না। এরপরই রূপাকে নিয়ে সেই রাতে ম্যাঙ্গালুরুর সনাতন আশ্রমে যায়। ওই রাতেই খুন হয়েছিলেন গৌরি।
সিটের দাবি, জোরালো অ্যালিবাই খাড়া করতেই নবীন, রূপাকে নিয়ে ম্যাঙ্গালুরু গিয়েছিল। তবে রূপা শুধু ঘটনার দিনের বিবরণই দেননি, সনাতন সংস্থার সঙ্গে নবীনের যে ভালই যোগাযোগ ছিল, তাও জানিয়েছেন। এমনকী সংস্থার এক কর্তাব্যক্তি তাদের বাড়িতে একদিন থেকেও ছিলেন বলে দাবি করেছেন রূপা। গত ২ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল নবীনকে। সেদিন থেকেই সনাতন সংস্থা নবীনের সঙ্গে তাদের যোগ মোছার চেষ্টা করেছে।
সংস্থার মুখপাত্র চেতন রাজন, নবীনের গ্রেপ্তারির পরেই জানিয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে নবীনের কোনও যোগ নেই। নবীনকে তাঁরা চেনেনই না। অথচ রূপার বিবৃতি ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক তথ্য-প্রমাণ অন্য কথাই বলছে। হিন্দু জনজাগৃতি সেনার মুখপাত্রও জানিয়েছেন নবীন কুমার তাদের বিভইন্ন অধিবেশন ও ধর্মসভায় উপস্থিত ছিল। শুধু তাই নয়, সাইবার ফরেন্সিক তদন্তে দেখা গিয়েছে ২০১৭-র ডিসেম্বরে হিন্দু যুব সেনা ও জাগৃতি সেনার এক যৌথ অনুষ্ঠানের খবর সনাতন সংস্থা তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছিল। অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা ধৃত নবীনই ছিলেন। কিন্তু তাঁর আটকের খবর চাউর হতেই তড়িঘড়ি সেই খবর সরিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি সোশাল মিডিয়ায় জনজাগৃতি সেনা ও সনাতন সংস্থার অন্তত পাঁচটি অনুষ্ঠানে নবীন কুমারকে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গিয়েছে।
নবীনের সঙ্গে এই ঘটনায় আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। হিন্দুত্ববাদী সংস্থাগুলি তাদের সঙ্গেও নিজেদের যোগ স্বীকার করেছে। তবে কর্ণাটক এসআইটি বলছে এই ঘটনার তদন্ত যেদিকে এগোচ্ছে তাতে ২০১৩ থেকে ২০১৫-র মধ্যে কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রে খুন হওয়া আরও তিন যুক্তিবাদী, প্রগতিশীল ব্যক্তির হত্যারহস্য উন্মোচিত হতে পারে। তাঁরা মনে করছেন সবকটি খুনই একসঙ্গে জড়িয়ে আছে। সবকটির তদন্তই ইঙ্গিত করছে, হিন্দু জাগৃতি মঞ্চ ও বৃহদার্থে সনাতন সংস্থার দিকে। এক তদন্তকারী অফিসার জানান, 'সবকটি ঘটনার ক্ষেত্রেই বারবার সনাতন সংস্থার নাম জড়াচ্ছে। এর তো নিশ্চয়ই একটা কারণ আছে। আর তো কোনো সংস্থার নাম উঠে আসছে না।'