যুদ্ধবিমানটা ভেঙে পড়তেই ছুটে এলে গুলি, চলল মারধর, মৃত্যুর থেকে ফিরে আসার এক সত্য কাহিনি
'একটা সময় মৃত্যুকেও যেন সহজ বলে মনে হচ্ছিল। আর পারছিলাম না। শেষমেশ ভাগ্যটা ভালো ছিল। কারণ থার্ড ডিগ্রি-র মারধর শুরু হওয়ার আগেই ছাড়া পেয়ে যাই।'
'একটা সময় মৃত্যুকেও যেন সহজ বলে মনে হচ্ছিল। আর পারছিলাম না। শেষমেশ ভাগ্যটা ভালো ছিল। কারণ থার্ড ডিগ্রি-র মারধর শুরু হওয়ার আগেই ছাড়া পেয়ে যাই।' বছর কয়েক আগে এই কথাগুলো বলেছিলেন ভারতীয় বায়ুসেনার ক্যাপ্টেন কে নচিকেতা। ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধের সময় যখন কে নচিকেতা যুদ্ধবন্দি হয়েছিলেন তখন তাঁর বয়স ছিল ২৬ বছর।
কার্গিল যুদ্ধে ১৭,০০০ ফুট উপরে পাহাড়ের মাথায় থাকা পাকিস্তান সেনাদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব বর্তেছিল নচিকেতার কাঁধে। মিগ ২৭ যুদ্ধবিমান নিয়ে অভিযানে নেমে পড়েছিলেন নচিকেতা। কিন্তু, টার্গেটে বোমা নিক্ষেপ করতেই নচিকেতার যুদ্ধিবিমানের ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া বের হতে শুরু করে। আগুন ছিটকে বেরিয়ে আসে এবং ইঞ্জিন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল।
ইঞ্জিন চালু করার চেষ্টা করতে থাকেন নচিকেতা। কিছু পরে মিগ ২৭-এর তুমানস্কি টার্বো ইঞ্জিন চালু হলেও জ্বলে ওঠে 'রেড লাইট'। এর মানে বিমান দ্রুত জ্বালানি ফুরিয়ে আসছে এবং তা ভেঙে পড়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। যুদ্ধবিমানটাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন নচিকেতা। কিন্তু, তা গোত্তা খেয়ে পাহাড়ের ভিতরে চলে যায়।
বিমান ভেঙে পড়ার মুহূর্তে নিজেকে ইজেক্ট করে নেন নচিকেতা। ইজেক্ট করার সময় একটা নেশার মতো ঘোর হয়। কিন্তু, আতঙ্কের পরিবেশ এতটাই মারাত্মক ছিল যে নচিকেতার চোখে সেদিন সেই ঘোরের নেশা ছিল না। তিনি যেখানে পড়েছিলেন তার চারপাশে সাদা হয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে নচিকেতা ঠাহর করেন সাদা জিনিসটা আসলে বরফ। তিনি বুঝতে পারেন যুদ্ধি বিমান নিয়ে তিনি বরফের উপরে পড়েছেন।
এই কথা ভাবতে না ভাবতেই নচিকেতা দেখতে পান তাঁকে লক্ষ্য করে ছুঁটে আসছে গুলি। কোনওভাবে বিমানের ধ্বংসাবশেষের পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়েন বায়ুসেনার পাইলট। এইখান থেকে নিজের সার্ভিস রিভলবার দিয়ে প্রতিপক্ষকে জবাব দিতে থাকেন। নচিকেতার কথায়- বিপরীতে যারা গুলি চালাচ্ছিল তারা আসলে পাক সেনা। ওদের কাছে ছিল একে ৫৬। ফলে নচিকেতার সার্ভিস রিলভলবার দিয়ে এর মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। কারণ রিভলবার দিয়ে সর্বোচ্চ তিনি ২৬ মিটার পর্যন্ত লক্ষ বস্তুতে আঘাত হানতে পারেন।
পাক সেনারা গুলি চালাতে চালাতে বন্ধ করে দিয়েছিল। এই সুযোগে রিভলবারের শেষ হয়ে যাওয়া ম্যাগজিন লোড করছিলেন। কিন্তু, এই পরিস্থিতিতে পাক সেনারা তাঁকে ধরে ফেলে। নচিকেতার কথায় আলোচনার কোনও সুযোগই ছিল না। তাঁকে বন্দুকের বাট দিয়ে নৃশংসভাবে মারা হয় বলে জানিয়েছিলেন নচিকেতা। একটা সময় মনে হয়েছিল আর হয়তো বাঁচবেন না। পাক সেনার যে সব জওয়ানরা মারধর করেছিল, তাঁদের সাক্ষাৎ যমদূত বলে মনে হচ্ছিল। রক্তাক্ত নচিকেতা বরফে গড়াগড়ি খাচ্ছিলেন। আচমকাই পাক সেনাবাহিনীর এক সিনিয়র অফিসার সেখানে এসে হাজির হন এবং তিনি নচিকেতা-কে উদ্ধার করেন।
এতে অত্যাচার কমেছিল তা নয়, তবে নচিকেতার মনে একটা জোর ছিল যে তাঁকে যে করেই হোক বাইরের দুনিয়ায় পৌঁছতেই হবে। পাক সেনারা তাঁর পেট থেকে কথা বের করার জন্য় প্রকাশ্যে মারধরও করে। এমনকী এই অবস্থায় তাঁকে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সামনেও হাজির করানো হয়েছিল।
নচিকেতার কথায় পাক সেনাবাহিনী মনে করেছিল তাঁকে মারধরে করে কাজে লাগার মতো কোনও তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু, তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন একজন এয়ারফোর্স পাইলটের জানার পরিধি অনেকটাই কম। তার পক্ষে সেনাবাহিনীর কোর প্ল্যানের আন্দাজ করাটা সহজ নয়।
আট দিন ধরে পাকিস্তানের হাতে বন্দি থাকার পর মুক্তির স্বাদ পান নচিকেতা। কারণ, অটল বিহারীবাজপেয়ী-সহ বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নচিকেতা-কে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের উপরে চাপ তৈরি করেছিলেন। আন্তর্জাতিক মহলও পাকিস্তানকে চাপ দিচ্ছিল। শেষপর্যন্ত নচিকেতা-কে রেডক্রশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন এবং প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁকে হিরো হিসাবে বরণ করেন।
এই
ঘটনার
পর
অবশ্য
নচিকেতা
আর
যুদ্ধবিমান
ওড়াতে
পারেননি।
কারণ,
ইজেক্ট-এর
সময়
তাঁর
পিঠে
গভীর
চোট
লেগেছিল।
ফলে,
তিনি
এরপর
বিমাবাহিনীর
পরিবহণ
বিমানের
পাইলট
হিসাবে
কাজ
করেন।
কিন্তু,
নচিকেতা
মনে
করেন
একজন
পাইলটের
জীবন
ককপিটেই।