করোনা রোগীদের সেবা সবার আগে, দূর থেকেই ছেলের শেষকৃত্য দেখলেন সন্তানহারা বাবা
করোনা ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন প্রথম সারির কর্মীরা। যাঁদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন চিকিৎসক–স্বাস্থ্য কর্মীরা। কিন্তু সবচেয়ে অসহায় বোধহয় এখন তাঁরাই। একে তো পরিবারের কাছে ফিরতে পারছেন না এমনকী তাঁদের বিপদেও পাশে থাকতে পারছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাঁদেরকে শতকোটি কৃতজ্ঞতা জানালেও তা কম হবে। তেমনই এক করোনা যোদ্ধা যখন রোগীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন, তখন তাঁর তিন বছর বয়সী পুত্র সন্তান অন্য হাসপাতালে জীবন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিল। যদিও এই লড়াইয়ে হেরে যায় শিশুটি।
দূর থেকেই ছেলের শেষকৃত্য দেখেন বাবা
ছেলেকে শেষবারের মতো দেখতেও পারলেন না লখনউয়ের লোকবন্ধু হাসপাতালের ২৭ বছরের ওয়ার্ড বয় মণিশ কুমার। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নিয়মানুসারে তিনি ছেলের শেষকৃত্যে উপস্থিত থাকতে পারেননি এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দুরত্ব বজায় রেখে দূর থেকেই ছেলের শেষকৃত্য দেখেন বাবা।
করোনা রোগীদের ছেড়ে ছেলের কাছে যাননি মণিশ
শুক্রবার রাতে দ্বিতীয় স্তরের সরকারি কোভিড-১৯ হাসপাতালে রোগীদের সেবা করছিলেন তিনি। আচমকাই তাঁর কাছে ছেলে হর্ষিতের বিষয়ে বাড়ি থেকে ফোন আসে এবং বলা হয় যে তার শ্বাসকষ্ট ও পেটে ব্যাথা শুরু হয়েছে। মণিশ বলেন, ‘আমি যখন ফোনটা পাই, আমি ভেবে পাই না কি করব কারণ হাসপাতাল ছেড়ে আমি দ্রুত যেতে পারব না। আমার পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে কিং জর্জ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরিবারের সদস্যরা ছেলের ছবি আমায় হোয়াটস অ্যাপে পাঠায়। ওইদিন রাত ২টোর সময় আমাদের সকলকে পেছনে ফেলে হর্ষিত আমাদের ছেড়ে চলে যায়।' তিনি অশ্রুভেজা কন্ঠে বলেন, ‘আমি আমার ছেলেকে দেখতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমি এরপর সিদ্ধান্ত নিই যে আমার সহকর্মীদের এ বিষয়ে কিছুই জানাবো না কারণ আমি চাইনি আমার রোগীদের তাঁদের ঘাড়ে ফেলে দিতে। কিন্তু আমার ঘন ঘন ফোন এবং আমার পরিস্থিতি দেখে সহকর্মীরা বুঝতে পারেন যে কিছু একটা হয়েছে এবং আমায় যাওয়ার জন্য বলে।'
সন্তানকে শেষ দেখা দেখতে পারলেন না স্বাস্থ্যকর্মী
মণিশ প্রয়োজনীয় সব আগাম সতর্কতা নেওয়ার পরই তিনি কেজিএমইউ পৌঁছান যেখানে তাঁর ছেলের নিথর দেহ শোয়ানো ছিল। যদিও মণিশ হাসপাতালের ভেতর ঢোকেননি এবং ছেলেকে বাইরে আনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। যদিও তিনি জানতেন যে তিনি তাঁর ছেলেকে আর কোনওদিনও জীবিত দেখতে পারবেন না। মণিশ বলেন, ‘আমি আমার ছেলের দেহ দূর থেকে দেখছিলাম, আমার পরিবারের সদস্যরা তাঁকে নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিল এবং আমি তাঁদের অনুসরণ করছিলাম বাইকে। আমি শেষবারের মতো আমার ছেলেকে আলিঙ্গন করতে চাইছিলাম, তাকে জড়িয়ে ধরতে চাইছিলাম, বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে ও আর নেই।'
ছেলের দেহ ছোঁয়নি সন্তানহারা বাবা
একজন কর্তব্যরত বাবার পাশাপাশি একজন দায়িত্বশীল স্বাস্থ্যকর্মী হিসাবে নিজের পরিবারকে করোনা ভাইরাস থেকে মুক্ত করতে তিনি বাড়ির ভেতরে পা রাখেননি। মণিশ বলেন, ‘আমি বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিনি এবং গেটের কাছে বারান্দাতে বসেছিলাম। পরেরদিন আমার ছেলের দেহ সমাধিস্থ করে আমার পরিবারের লোকজন এবং আমার সিনিয়রদের চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী আমি ছেলেকে স্পর্শ করিনি সংক্রমণের কারণে।' তিনি জানান, সমাধির জায়গায় বহু মানুষ জমায়েত ছিল, ছেলের দেহ স্পর্শ করলে অন্যদের বিপদে ফেলা হতো। মণিশের কাছে এখন তাঁর ছেলের স্মৃতি হিসাবে তাঁর ফোনে শুধু ছবি ও ভিডিও রয়েছে।
খুব তাড়াতাড়ি ডিউটিতে ফিরবেন মণিশ
মণিশ জানিয়েছেন তিনি খুব দ্রুত ডিউটিতে যোগ দেবেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমি আমার স্ত্রীকে সান্তনা দেওয়ার জন্য তাঁর পাশে রয়েছি, তবে নিরাপদ দুরত্বে। আমি বাড়িতে ঢুকিনি, বারান্দায় রয়েছি। আমি দু'দিনের মধ্যে আমার কাজ শুরু করব। রোগীরা আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি তাদের সেবা করার মধ্য দিয়েই সান্তনা পাব।'
মঙ্গলবার পর্যন্ত লখনউতে ২৪২ জন করোনা ভাইরাস কেস পাওয়া গিয়েছে। যার মধ্যে ১৬১ জনের চিকিৎসা চলছে ও সুস্থ হয়ে উঠেছে এবং মৃত্যু হয়েছে একজনের।