নীতীশ, বিজেপির বিহার দ্বন্দ্ব: একই বিছানায় শুই কিন্তু কেউ কাউকে বিশ্বাস করি না
বিহারের রাজনীতি আজকাল বেশ বিনোদনের পর্যায়ে পড়েছে আর এর কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে যায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশকুমারের দিকেই।
বিহারের রাজনীতি আজকাল বেশ বিনোদনের পর্যায়ে পৌঁছেছে আর এর কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে যায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশকুমারের দিকেই। দু'হাজার ঊনিশের লোকসভা নির্বাচনে বিরাট জয়লাভ করার পরে বিজেপি ক্ষমতায় আসে ফের। এবং এই পর্বে সরকার গড়তে গিয়ে তারা জোটসঙ্গী নীতীশের সংযুক্ত জনতা দল বা জেডিইউ-কে মাত্র একটি ক্যাবিনেট পদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ক্ষুব্ধ হন তিনি। এবারের নির্বাচনে জেডিইউ বিহার থেকে ১৬টি আসন পেয়েছে, যা ২০১৪-র থেকে ১৪টি বেশি। আর তাই রাজ্য থেকে এনডিএ-এর অন্য জোটসঙ্গী লোক জনশক্তি পার্টি ছ'টি আসন জিতলে তাদেরও একটি পদ দেওয়ার ফলে জেডিইউর অসন্তোষ আরও বেড়েছে। নীতীশকুমারের দলের আশা ছিল অন্তত দু'টি ক্যাবিনেট পদ পাওয়ার।
কেন্দ্র সরকারে দলের প্রতীকী প্রতিনিধিত্ব প্রয়োজন নেই বলে একটি ক্যাবিনেট পদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জেডিইউ এবং নয়াদিল্লির বদলা নীতীশ নেন পাটনাতে। এই মাসের শুরুতে বিহারের মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করেন মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু বর্ধিত মন্ত্রিসভায় কোনও বিজেপির প্রতিনিধিত্ব থাকে না, এমনকি গেরুয়া দল সরকারে নীতীশের জোটসঙ্গী হওয়া সত্বেও। পাশাপাশি, এটাও দেখা গিয়েছে যে এবারের ইফতার পার্টিতে এনডিএ-র বিভিন্ন জোটসঙ্গীরা একে অপরের ছায়া মাড়াননি। উল্টে বিহারের বিজেপি নেতা গিরিরাজ সিং, যিনি আবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও বটে, নীতীশ এবং অন্যান্য নেতাকে ইফতারে যাওয়া নিয়ে কটাক্ষ করেন। নীতীশ সহ জেডিইউর অন্য নেতারা তাতে পাল্টা দেন গিরিরাজকে।
সব মিলিয়ে ২০২০-র বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিহারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
একা ক্ষমতায় আসার মরিয়া চেষ্টা নীতীশ এবং বিজেপি দুই-এরই
আসলে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল বেরোনোর পর এবং পরবর্তী বিহার বিধানসভা নির্বাচনের আগে নীতীশ এবং বিজেপি দুই পক্ষই নিজেদের ঘর গুছিয়ে নিতে চাইছেন। একাই কেন্দ্রকে জয় করার পরে বিজেপি এখন পাটনার মসনদকে পাখির চোখ করছে, ঠিক যেমনটি তারা করেছিল মহারাষ্ট্রের তখ্তকেও। সেখানেও স্থানীয় শক্তি শিবসেনার সঙ্গে জোট থাকলেও বিজেপি নিরন্তর চেষ্টা করেছে সেনাকে হারিয়ে ক্ষমতায় নিজে আসার যা ২০১৪ সালে সফলও হয়। নীতীশকে বিজেপির প্রয়োজন ছিল যৌথভাবে সরকারে থাকার জন্যে কিন্তু এখন বিজেপির আকাঙ্খা বিহারের ক্ষমতায় একা আসার।
বিজেপি নীতীশের কাছে অগতির গতি
অন্যদিকে, বেশ কয়েকবার বিজেপির সঙ্গে হাত মেলালেও নীতীশ খুব ভালো করেই জানেন যে তেলে জলে মিশ খায় না। ২০১৫তে নীতীশ ও লালুপ্রসাদের মহাজোট বিজেপিকে হারালেও সেই জোট দু'বছরও টেকেনি। লালুর রাষ্ট্রীয় জনতা দলের অতিসক্রিয়তায় বিরক্ত হয়ে জোটের পাট উঠিয়ে দিয়ে ফের বিজেপির হাত ধরেন। নিন্দুকেরা নীতীশের এই আসা-যাওয়া নিয়ে সমালোচনা করলেও যতক্ষণ না জেডিইউ নিজে বিহার বিধানসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে, ততক্ষণ চিরতা গেলার মতো নীতীশকে কোনও না কোনও দুশমনের সঙ্গে হাত মেলাতেই হবে। সতেরো সালে তিনি অপেক্ষাকৃত কম 'শয়তান'-এর সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গড়লেও ২০২০তে তাঁর লক্ষ্য একার ক্ষমতায় সরকার গড়া যাতে এই অস্থিরতা বন্ধ করা যায়। মতাদর্শগতভাবেও জেডিইউ বিজেপির সঙ্গে সামঞ্জস্য খুঁজে পেতে ব্যর্থ এবং লোকসভা নির্বাচনের আগে স্রেফ ভোটের কথা ভেবে মুখে কুলুপ এঁটে ছিল তারা। কিন্তু রাজ্য নির্বাচনের আগে নিজের 'ধর্মনিরপেক্ষ' ভাবমূর্তি যাতে অক্ষুন্ন থাকে, সে বিষয়ে নীতীশ খুব সজাগ এবং সেই কারণেও বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া আলগা করার কথা তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
সুযোগ খুঁজছেন বিরোধীরাও
বিজেপি-বিরোধী মহাজোটও এই সুযোগে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রাবড়ি দেবী তো সরাসরি বলেই দিয়েছেন যে নীতীশ চাইলে মহাজোটে আসতে পারেন ফের। অথচ, বছর দুই আগে যখন নীতীশ মহাজোট ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে বিজেপির হাত ধরেন আরও একবার, তখন জোটের তরফ থেকেই বলা হয়েছিল যে তিনি ফিরে আসতে চাইলেও দরজা বন্ধই থাকবে। ভোটের ময়দানে হারলেও অন্তত ভোটের পরে যদি নীতীশ-বিজেপি জোটটি ভেঙে পড়ে, তাহলে সেটিও হবে মহাজোটের নৈতিক জয় এবং পরের রাজ্য নির্বাচনের আগে নীতীশকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি-বিরোধিতার হাওয়াকে চাঙ্গা করার সুযোগ।
কিন্তু মোদী হাওয়ায় কুপোকাত মহাজোট এখন বাধ্য হয়েছে নীতীশের প্রতি অবস্থান বদলাতে।
রাজনীতি বড় বিষম বস্তু।