নাথুরাম গডসে থেকে জঙ্গি আজমল কাসভ, ফাঁসির জন্য প্রথম পছন্দ বক্সার জেলের দড়ি
নাথুরাম গডসে থেকে আজমল কাসভ, ফাঁসির জন্য প্রথম পছন্দ বক্সার জেলের দড়ি
২২ জানুয়ারি সকাল সাতটা। দিল্লির নিম্ন আদালতের নির্দেশে মৃত্যুদণ্ডের সাজা কার্যকর হবে নির্ভয়া কাণ্ডে চার সাজাপ্রাপ্তদের। তিহার জেলের মধ্যে তাদের ফাঁসি দেওয়া হবে। মৃত্যু পরোয়ানাতে বলা হয়েছে, যতক্ষণ না মারা যাচ্ছে ততক্ষণ ঝুলিয়ে রাখা হবে। ফাঁসি দেওয়ার দড়িও প্রস্তুত রয়েছে এবং তা তিহার জেল কর্তৃপক্ষের কাছে তা পৌঁছে গিয়েছে। বিহারের বক্সারের কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে এই দড়ি তৈরি করা হয়।
আফজল গুরু থেকে নাথুরাম গডসের ফাঁসিতেও বক্সরের দড়ি
মৃত্যুদণ্ডের জন্য দড়ি তৈরির একচেটিয়া অধিকার নিয়ে রেখেছে বক্সার জেল। নাথুরাম গডসের ফাঁসির সময়ও এই বক্সার জেল থেকেই ফাঁস বা দড়ি সরবরাহ করা হয়েছিল। ১৯৪৯ সালের নভেম্বরে নাথুরামকে ফাঁসি দেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীকে খুন করে নাথুরাম। তবে বলা যেতে পারে এটাই শুরু। এরপর সংসদ হামলাকারী আফজল গুরু, ১৯৯৩ সালে বোম্ব বিস্ফোরণের দোষী ইয়াকুব মেমন ও ২৬/১১ মুম্বই হামলার দোষী আজমল কাসভকেও ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল এই বক্সার জেলের দড়িতেই।
ব্রিটিশ আমল থেকে তৈরি হচ্ছে ফাঁসির দড়ি
এর পেছনে ছোট্ট একটি ইতিহাস যদিও লুকিয়ে রয়েছে। যার জন্য ফাঁসির দড়ির একচেটিয়া অধিকার নিয়ে রেখেছে এই জেল। বক্সারের যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা থেকে উত্তরপ্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলটির উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার ১৬ বছর পরে ১৮৮০ সালে ব্রিটিশ শাসকরাই প্রথম এই প্রথা চালু করেন। এর চার বছর পর ১৮৮৪ সালে ব্রিটিশরা ফাঁসির দড়ি প্রস্তুত করার জন্য বক্সার জেলে মেশিন নিয়ে আসেন। এর আগে ফাঁসির দড়ি আমদানি করা হত ফিলিপিনসের রাজধানী ম্যানিলা থেকে, যার নাম ছিল ম্যানিলা দড়ি, যেটি তার ফাঁসের জন্য জনপ্রিয় ছিল খুব। এরপর ভারতীয় কারখানার আইন বক্সার জেলকে বিশেষভাবে একতরফা অধিকার দেয় এই ফাঁসির দড়ি তৈরি করার। অন্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়।
অন্য দড়ি থেকে অনেকটাই আলাদা ধরনের হয় এই ফাঁসির দড়িগুলি। নরম হলেও খুব শক্ত। আবহাওয়া ও জেলের কাছে জল থাকায় ব্রিটিশরা সিদ্ধান্ত নেয় যে বক্রার জেলকেই এই দড়ি তৈরির বিশেষ অধিকার দেওয়া হবে। বক্সার জেলের কাছেই রয়েছে গঙ্গা নদী এবং কুয়োও। এ ধরনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য আজও ভারতীয় কারাগারে দেখা যায় না। বন্দীদের কুয়োয় আত্মহত্যা থেকে বিরত রাখতে জেলগুলিতে কুয়ো তৈরির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসকদের যুগে এ ধরনের অনেক আত্মহত্যার খবরই পাওয়া গিয়েছিল।
সাধারণ দড়ি থেকে কেন আলাদা বক্সারের ফাঁসির দড়ি
জে-৩৪ নামে বিশেষ ধরনের এক সুতো বক্সার জেলে এই ফাঁসির দড়ি তৈরি করতে প্রয়োজন হয়। এই সুতোর তন্তুর চাষ হয় পাঞ্জাবে, এরপর কাঁচা মাল বক্সার জেলে পাঠানো হয়। তবে এখন আর এই সুতোর কাঁচা মাল পাঠানো হয় না। বরং সরবরাহকারীরা একেবারে সুতো তৈরি করে জেলে পাঠিয়ে দেয়। ফাঁসির দড়ি তৈরি করার নির্দিষ্ট সূত্র রয়েছে। এই কাজের জন্য মনোনীত কর্মীরা তা তদারকি করেন। বক্সার জেলে এ ধরনের কাজের জন্য চার-পাঁচটি জায়গা খালি রয়েছে। তাঁরা বন্দীদের ফাঁসির দড়ি তৈরি করা শেখান। সাধারণত, কোনও বন্দীর যদি যাবজ্জীবন সাজা হয় তবে তাকেই ফাঁসির দড়ি তৈরির কাজে লাগানো হয়। তবে এই কাজে মৃত্যুদণ্ডের কোনও আসামিকে কাজে লাগানো হয় না। জেলের কারখানার কোনও কাজেই তাদের নিয়োগ করা হয় না। জে-৩৪ তন্তুগুলিকে বেঁধে সুতোয় পরিণত করা হয়, ১৫৪টি এ ধরনের সুতো বুনে তৈরি হয় ১৫৪টি বিনুনি। ছ'টি বিনুনি দিয়ে একটি দড়ি প্রস্তুত হয়। ফাঁসির দড়িকে নরম করতে অনেক জল ব্যবহার করা হয়।
বিশেষ গুণ রয়েছে এই দড়িতে
ফাঁসির ক্ষেত্রে নিয়ম হল আসামীর মৃত্যু হলেও তার গলায় যেন কোনও দাগ না পড়ে। ফাঁসি হয়ে যাওয়ার পর পোস্ট মর্টেম হওয়ার সময় বিষয়টি লক্ষ্য রাখা হয়। এইসব বিশেষ গুণ রয়েছে বক্সার জেলে তৈরি ফাঁসির দড়িতে। বক্সার জেলে তৈরি হওয়া ফাঁসির দড়ি একটা মৃত্যুদণ্ডের পর আবারও তা ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা ভারতে একেবারেই সম্ভব নয়, কারণ ভারতে ফাঁসির সাজা খুব কমই হয়। গত ২০ বছরে মাত্র চারজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।