আঞ্চলিক দলের তকমা শেষ, পাঞ্জাবে ইতিহাস গড়ার পর এবার আপের লক্ষ্য গুজরাত
আঞ্চলিক দলের তকমা শেষ, পাঞ্জাবে ইতিহাস গড়ার পর এবার আপের লক্ষ্য গুজরাত
২০২২ সাল, ১০ মার্চ। পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল। পাঞ্জাবের সাত দশকের ইতিহাস গোটাটাই বদলে গেল শুধু একটি রাজনৈতিক দলের কারণে। তারা হল দিল্লির আম আদমি পার্টি তথা আপ। শিরোমণি অকালি দল ও কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটিতে আপ দেখিয়ে দিয়েছে যে এবার রাজ্যের প্রয়োজন নতুন দল ও নতুন মুখ্যমন্ত্রী। দিল্লির পর পাঞ্জাবে আপের জয় সত্যিই নতুন এক ইতিহাস সৃষ্টি করল।
আঞ্চলিক দল থেকে জাতীয় দলে পরিণত আপ
২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর, সংবিধান দিবসের দিন, ইঞ্জিনিয়ার তথা সরকারি কর্মী তথা আন্দোলনকারী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, তাঁর সঙ্গে দুর্নীতির বিপক্ষে ভারত (আইএসি)-এর সদস্যরা একত্রিত হয়ে আম আদমি পার্টি (আপ), নতুন রাজনৈতিক দলের সূচনা করেন। আপ প্রতিশ্রুতি দেয় যে রাজনীতির বিকল্প পদ্ধতি তারা নিয়ে আসবে। ন'বছর পর কেজরিওয়াল নেতৃত্বাধীন আপ ভারতের দ্রুততম বর্ধনশীল রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে এবং আপের ঝাঁটায় বিধানসভা নির্বাচনে পাঞ্জাবে নিশ্চিহ্ন হয়েছে দুই শক্তিশালী দল। প্রথম আঞ্চলিক দল হিসাবে আপ দিল্লির পর ভারতের দ্বিতীয় রাজ্য পাঞ্জাবেও জয়লাভ করল। পাঞ্জাবে জয়ের পর আপের পরবর্তী লক্ষ্য কি তা নিয়ে ইতিমধ্যেই গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার দলের শীর্ষ নেতৃত্বরা জানিয়েছেন যে আপের পরর্বতী পদক্ষেপ হল এ বছর ডিসেম্বরে গুজরাত নির্বাচনে 'ভালো' লড়াই করা। দিল্লি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনে নিজেদের জয় আপ নিশ্চিত করলেও, এটা এখনও অজানা যে কবে এমসিডি নির্বাচন হবে, কারণ কেন্দ্র সরকার জাতীয় রাজধানীতে তিনটে সিভিক বডিকে (এমসিডি, এনডিএসসি, এসডিএমসি) একত্রিত করার পরিকল্পনা করছে।
আপের পরবর্তী লক্ষ্য গুজরাত
গুজরাতে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) শক্ত ঘাঁটি রয়েছে, আপ সেখানেই তার লক্ষ্যকে বাস্তব রূপ দিতে চাইছে। গুজরাত নির্বাচনের জন্য আপের পরিকল্পনা হল প্রাথমিকভাবে বিরোধী দল হিসাবে উঠে আসা এবং কংগ্রেসকে তৃতীয় নম্বরে কোণঠাসা করে দেওয়া। গুজরাতে আপের দায়িত্বে থাকা গুলাব সিং বলেন, 'আজকের ফলাফল গুজরাতে দলের ক্যাডারকে অনুপ্রাণিত করেছে। গুজরাতে বিজেপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার জন্য আমাদের কাছে এই নয় মাস যথেষ্ট। গত ২৭ বছর ধরে গুজরাত কংগ্রেসকে পরিত্যাগ করেছে। পাঞ্জাবে আপের জয় এ রাজ্যে দলের সমর্থকদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।' তিনি আরও বলেন, 'পাঞ্জাবে আপের জয় উদযাপন করতে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে গুজরাতে আসবেন কেজরিওয়াল ও ভগবন্ত মান। ততদিন আমাদের দলের পক্ষ থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত গুজরাতের প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে আপের বিজয় মিছিল করা হবে। আমরা কংগ্রেসের পতন ঘটাতে আত্মবিশ্বাসী।'
চারটে রাজ্যে আপের প্রতিদ্বন্দ্বিতা
পাঁচটি রাজ্য, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, গোয়া, উত্তরাখণ্ড ও মণিপুরের মধ্যে আপ চারটিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। বৃহস্পতিবারের ভোট গণনার পর কেজরিওয়ালের এক লাইনের টুইটই বুঝিয়ে দিয়েছে পাঞ্জাবে আপের জয়। কেজরিওয়াল তাঁর সঙ্গে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ভদবন্ত মানের সঙ্গে ছবি শেয়ার করেন টুইটারে। সেখানে তিনি লেখেন, 'এই বিপ্লব আনার জন্য পাঞ্জাববাসীকে অনেক অনেক অভিনন্দন।' গোয়াতে আপ দ্বিতীয়বারের জন্য লড়লেও এ রাজ্যে এখনও সেভাবে খাতা খুলতে পারেনি। গোয়ায় আপের ঝুলিতে এসেছে মাত্র ২টি আসন। কেজরিওয়াল টুইটে লিখেছেন, 'গোয়ায় আপ ২টি আসন পেয়েছে। ক্যাপ্টেন ভেঞ্জি এবং ইর ক্রুজকে অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা। এটা গোয়ায় সৎ রাজনীতির সূচনা।' অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড, যেখানে আপ প্রার্থীরা প্রথমবার লড়েছেন, সেখানে যেমনটা আশা করা গিয়েছিল সেই ফল দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে কেজরিওয়ালের দল, জানিয়েছেন আপের দিল্লির আহ্বায়ক গোপাল রাই। মণিপুরে আপ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি।
পাঞ্জাবের ওপর মনোযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি
পাঞ্জাব বাদে বাকি রাজ্যগুলিতে দলের খারাপ পারর্ফম্যান্স প্রসঙ্গে দিল্লির উপ-মুখ্যমন্ত্রী ও শীর্ষ আপ নেতা মণিশ সিসোদিয়া জানিয়েছেন যে এটা হওয়ার কারণ পাঞ্জাবের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে গিয়ে অন্যান্য রাজ্যগুলি অবহেলিত হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমরা গোয়া, উত্তরাখণ্ড ও উত্তরপ্রদেশে পরার্থী দিয়েছিলাম, কিন্তু কোথাও যেন আমাদের পুরো মনোযোগ ছিল পাঞ্জাবের ওপর। ধীরে ধীরে এই রাজ্যের মানুষরাও আমাদের দলের ওপর বিশ্বাস করতে শুরু করবেন।' পাঞ্জাবে আপের সহ-দায়িত্বে থাকা ও দিল্লির রাজেন্দ্র নগরের বিধায়ক রাঘব চাড্ডা জানিয়েছেন যে তাঁর দল 'জাতীয় বাহিনী'তে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, 'দল হিসাবে আপের জন্য এটা খুবই বড় দিন। আজকে আমরা আর কোনওভাবেই আঞ্চলিক কোনও দল নয়। আমরা এখন জাতীয় দলে পরিণত হয়েছি। আমি নিশ্চিত যে কেজরিওয়াল একদিন দেশকে নেতৃত্ব দেবেন এবং ২০২৪ সালের মধ্যে আপ একটি জাতীয় দলে পরিণত হবে এবং কংগ্রেসের স্বাভাবিক বিকল্পে পরিণত হবে। এমনকী বিজেপিও আপের তুলনায়, যা ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, দু'টি রাজ্য জিততে অনেক সময় নিয়েছিল।'
কেজরিওয়াল সরকারের মডেলকে গ্রহণ করেছে পাঞ্জাব
সিসোদিয়া জানিয়েছেন যে নির্বাচনের ফলাফল দেখিয়ে দিয়েছে যে জাতীয় স্তরেও কেজরিওয়াল সরকারের মডেল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি বলেন, 'কেজরিওয়াল মডেলের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং অন্যদের মধ্যে মহিলাদের সুরক্ষার উপর ফোকাস করা। কেজরিওয়াল স্বাধীনতা সংগ্রামী বিআর আম্বেদকর এবং ভগৎ সিংয়ের স্বপ্ন পূরণ করেছেন। এটি আপ-এর জয় নয় বরং সাধারণ মানুষের জয়...পাঞ্জাব কেজরিওয়াল সরকারের মডেলকে সুযোগ দিয়েছে। আজ তাঁর শাসনের মডেল জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।' আপ মুখপাত্র অক্ষয় মারাঠে জানান যে জাতীয় রাজনীতিতে দলের বৃদ্ধি কেবল দ্রুততম নয়, সবচেয়ে সাংগঠনিকও। তিনি বলেন, 'এটা আপ ও ভারতীয় গণতন্ত্রের কাছে ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আপ মাত্র চতুর্থ (জাতীয়) দল হয়ে উঠেছে (কংগ্রেস, বিজেপি এবং বামপন্থীদের পরে) একাধিক রাজ্যে সরকার গঠন করে। এটা দেশের নতুন জাতীয় দল। দিল্লি ছিল কেজরিওয়াল মডেলের ধারণার প্রমাণ যা পাঞ্জাব আজ গ্রহণ করেছে। যেখানেই দিল্লির মতো সাংগঠনিক চাহিদা দেখা দেবে, আপ সেখানে এগিয়ে যাবে এবং কাজ করবে।'
আম আদমি পার্টির অভূতপূর্ণ উত্থান
আপ দলের প্রতিষ্ঠা হওয়ার এক বছরের কম সময়ের মধ্যে ২০১৩ সালে দিল্লিতে আপ প্রথম নির্বাচন লড়ে। সেই সময় আপ শুধুমাত্র কংগ্রেসের ১৫ বছরের শাসনকে উচ্ছেদ করতে সক্ষম হয়নি, বরং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত শীলা দীক্ষিতকেও তাঁর নির্বাচনী এলাকা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। ৭০টি আসনের মধ্যে ২৮টি আসনে জয়লাভ করে আপ দিল্লিতে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে সরকার গঠন করে। কিন্তু, রাজ্য বিধানসভায় দুর্নীতি বিরোধী বিল অবরুদ্ধ হওয়ার পর কেজরিওয়াল তাঁর শাসনের মাত্র ৪৯ দিনের মধ্যে পদত্যাগ করেন। তবে এই আপ দল ২০১৫ সালে ঘরে দাঁড়ায় এবং ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। ২০২০ সালে দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে আপের ঝুলিতে আসে ৭০টির মধ্যে ৬২টি আসন। আপ-এর ২০২০ সালের বিজয় অসাধারণ ছিল কারণ ভারতের কোনও বড় রাজ্যে কোনও দলই দু'বার ৫০ শতাংশের বেশি ভোটের ভাগ নিয়ে পুনরায় নির্বাচিত হতে পারেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল ১৯৮০ এবং ১৯৮৫ সালে গুজরাতে কংগ্রেসের পরপর জয়। যদিও আপের বিধানসভা নির্বাচনের জয় ২০১৪ ও ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে কোনও ক্যারিশমা দেখাতে পারেনি, সংসদীয় কেন্দ্রে কোনও আসনই জিততে পারেনি আপ।