এই তো জীবন! পড়ন্ত বেলায় নিঃসঙ্গ দিন গুনছেন মূক বাজপেয়ী
যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, নিত্যদিন লেগে থাকত কৃপাপ্রার্থীদের ভিড়। দলের হেভিওয়েটরা পড়ে থাকতেন পায়ের কাছে।
আজ শব্দহীন তিনি। কথা বলতে পারেন না। ফ্যালফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে থাকেন। নিজের দলের অফিস অশোক রোডে, বাড়ি থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে। অথচ দু'-তিনজন ছাড়া আর কোনও বিজেপি নেতা ওঁর কাছে আসা তো দূরে থাক, খোঁজ পর্যন্ত নেন না ফোনে।
তিনি অটলবিহারী বাজপেয়ী। দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। এখন বাকশক্তিরহিত ব্রাত্য একজন। ক্ষোভ-অভিমানে কখনও দু'চোখ সজল হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই কষ্ট ব্যক্ত করতে পারেন না। মনে মনেই গুমরে যান।
অটলবিহারী বাজপেয়ী ভারতের রাজনীতিতে একটা যুগ। একটা চলমান ইতিহাস। ১৯৯৬ সালে ১৩ দিনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তবুও ক্ষমতায় থাকার লোভে সাংসদ কেনাবেচা করেননি। ১৩ দিন পর পদত্যাগ করে বলেছিলেন, "ইয়ে হ্যায় জিন্দেগি।" ১৯৯৮ সালে লোকসভা ভোটে জিতে ফের প্রধানমন্ত্রী হন। জোট রাজনীতির খেলায় এক বছরের মাথায় যখন সেই সরকারও পড়ে গেল, তখনও আশা ছাড়েননি তিনি। ১৯৯৯ সালে ভোটে জিতে ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন। কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত যেমন, পোখরানে পরমাণু বিস্ফোরণ, সোনালি চতুর্ভুজ প্রকল্প ইত্যাদি ফলপ্রসূ হয়েছিল অটলবিহারী বাজয়েপীর দৃঢ় সিদ্ধান্তের জেরেই।
২০০৪ সালে চতুর্দশ লোকসভা ভোটে যখন বিজেপি হেরে যায়, তখন নৈতিক দায় মাথায় নিয়ে পদ ছেড়েছিলেন তিনি। কিন্তু রাজনীতিতে তখনও ছিলেন সক্রিয়। কবিতা লেখা ছাড়েননি, নিয়মিত লেখালিখি করতেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। ২০০৯ সালের এক রাতে হঠাৎ জীবনটা বদলে গেল। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হলেন। দীর্ঘ চিকিৎসায় উঠে বসার ক্ষমতা পেলেন বটে, কিন্তু চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল বাকশক্তি। সেই থেকে হুইলচেয়ারে বসে সময় কাটে তাঁর। মস্তিষ্ক এখনও সক্রিয়। কেউ কিছু বললে বুঝতে পারেন। কিন্তু প্রত্যুত্তরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করতে পারেন না। এখনও নিজে হাতে খেতে ভালোবাসেন চিংড়ি মাছ। তবে ডাক্তারের নির্দেশে অল্প পরিমাণ খেতে হয়।
এখনও জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানান মনমোহন সিং
পালিতা কন্যা নমিতা ছাড়া অটলবিহারী বাজপেয়ীর নিয়মিত খোঁজখবর নেন হাতে গুনে চারজন। এন এম ঘাটাটে, কলেজ জীবনের বন্ধু। বি সি খাণ্ডুরি, উত্তরাখণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। ইনি এখনও অটলবিহারী বাজপেয়ীর একান্ত অনুগত। এ ছাড়া তাঁর কৃষ্ণ মেনন মার্গের বাড়িতে নিয়মিত আসেন লালকৃষ্ণ আদবানি।
আরও একজন আছেন এই তালিকায়। নামটা শুনলে অনেকেই অবাক হবেন। তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। কাজের চাপে আসতে না পারলেও হামেশাই ফোন করেন। কেমন আছেন, কী খেলেন, কী বই পড়লেন ইত্যাদি শুধিয়ে যান এক নাগাড়ে।
ঘাটাটে বললেন, "অটলজির বাড়ি থেকে বিজেপি সদর দফতর একটুখানি। অথচ কেউ খোঁজ নেয় না। কিন্তু দেখেছি মনমোহন সিং ওঁর স্বাস্থ্য নিয়ে নিয়মিত খোঁজ নেন। জন্মদিনে কখনও শুভেচ্ছা জানাতে ভোলেন না।"
মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে অটলবিহারী বাজপেয়ীর এই সখ্য কীভাবে হল?
মজার ঘটনা বললেন ঘাটাটে। তিনি জানান, তখন পি ভি নরসিমহ রাও দেশের প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং। এক বার তাঁর পেশ করা বাজেট নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন অটলবিহারী। তাতে বেজায় দুঃখ পান মনমোহন। তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। বিষয়টি নরসিমহ রাও বলেন অটলবিহারী বাজপেয়ীকে। সব শুনে তিনি নিজে যান মনমোহন সিংয়ের বাড়িতে। বলেন, এগুলো রাজনীতিক বিষয়। ব্যক্তি মনমোহন সিংকে তিনি আক্রমণ করেননি। বাজপেয়ীর সৌজন্যে অভিভূত হয়ে যান তিনি। সেই থেকে দু'জনের বন্ধুত্ব গভীরতর হয়।
কিন্তু লোকসভা ভোট মিটে গেলে বিজেপি নেতারা কী আসবেন? যদি কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হয়, তা হলে কি অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজ, রাজনাথ সিংরা এসে ওঁর আশীর্বাদ নেবেন? ঘাটাটে জানান, যদি সেটা হয়, তা হলে অটলজি খুব খুশি হবেন।
এ
তো
গেল
যদি,
কিন্তু
ইত্যাদি
সাময়িক
প্রসঙ্গ।
তার
পরও
যথারীতি
দিন
যাবে,
মাস
যাবে,
বছর
যাবে।
দুনিয়া
চলবে
আপন
নিয়মে।
নিঃসঙ্গ
জীবন
কাটাবেন
'ভীষ্ম'
অটলবিহারী
বাজপেয়ী।
নিজের
লেখা
কবিতা
'যক্ষ
প্রশ্ন'-তে
তিনি
বলেছিলেন,
"জো
কল
থে,
ওয়ে
আজ
নেহি
হ্যাঁয়/
জো
আজ
হ্যাঁয়,
ওয়ে
কল
নেহি
হোঙ্গে/
হোনে,
না
হোনে
কা
ক্রম,
ইসি
তরহ
চলতা
রহেগা/
হম
হ্যাঁয়,
হম
রহেঙ্গে,
ইয়ে
ভ্রম
ভি
সদা
পলতা
রহেগা"
(
যা
কাল
ছিল,
তা
আজ
নেই/
যা
আজ
আছে,
তা
কাল
থাকবে
না/
থাকা
না
থাকার
ঘটনাক্রম
এভাবেই
চলবে/
আমি
আছি,
আমি
থাকব,
এই
ভ্রমও
সদা
বিরাজ
করবে)।
শব্দগুলো নিজের জীবনে এত রূঢ়ভাবে প্রযোজ্য হবে, সেটা বোধ হয় ভাবেননি অটলবিহারী বাজপেয়ী।
ইয়ে হ্যায় জিন্দেগি! এই তো জীবন।