বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত গোষ্ঠ পালের জন্মদিনেই, শোকাহত ক্রীড়া মহল
সমর (বদ্রু) বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত। ভারতীয় দলের প্রাক্তন অধিনায়ক রাত ২টো ১০ মিনিটে এসএসকেএম হাসপাতালের বাঙ্গুর ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়ান্সেজে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। বয়স হয়েছিল ৯২। তিনি ভারতীয় ফুটবল দলকে ১৯৫৬ সালের অলিম্পিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বেশ কয়েক বছর সুনামের সঙ্গে খেলেছেন মোহনবাগানে। তাঁর নাম সমর হলেও বেশি পরিচিত ছিলেন বদ্রু ডাকনামেই।
|
প্রয়াত বদ্রু
বেশ কিছুদিন ধরেই স্নায়ুরোগ-সহ বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। গত ২৭ জুলাই তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল বিআইএনে। করোনা আক্রান্ত হওয়ায় তাঁকে এম আর বাঙ্গুর হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। সেখান থেকে ফের বিআইএনে আনা হয় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। প্রথমে কেবিনে রাখা হলেও অবস্থার অবনতি হওয়ায় সিসিইউতে স্থানান্তরিত করে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। যদিও চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে গোষ্ঠ পালের জন্মদিনেই চিরবিদায় নিলেন ভারতীয় ফুটবলের আরেক কিংবদন্তি বদ্রু ব্যানার্জি। তাঁর চিকিৎসার ব্যাপারে নিয়মিত খবরাখবর রাখার পাশাপাশি যাবতীয় ব্যবস্থা করেছিলেন রাজ্যের ক্রীড়া ও যুবকল্যাণমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস।
|
ছোটবেলা থেকেই ফুটবলপ্রেম
১৯৩০ সালের ৩০ জানুয়ারি হাওড়ার বালিতে জন্ম। বাড়িতে নিয়ম করে বসতো ময়দানের ফুটবল নিয়ে আড্ডা। শৈশব থেকেই তাই ফুটবলের প্রতি আকৃষ্ট হন বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়। স্কুল থেকে ফিরে কখনও বালি হিন্দু স্পোর্টিং ক্লাব, কখনও বা বালি ওয়েলিংটন ক্লাবে ফুটবল খেলতে যেতেন। সেই সময় থেকেই বুটে খেলায় অভ্যস্ত হওয়ায় জাতীয় দলে খেলার সময়ও অসুবিধা হয়নি। ১৯৪৮ সালে যোগ দেন বালি প্রতিভা ক্লাবে। পেশাদার ফুটবল সেখান থেকেই শুরু। কলকাতা ফুটবল লিগে তৃতীয় ডিভিশনে খেললেও প্রথম মরশুমেই নজরে পড়ে যান একাধিক ক্লাবের। পরের মরশুমেই চলে যান বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে ক্লাব বা বিএনআরে। বিএনআরকে প্রিমিয়ার ডিভিশনে নিয়ে যেতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৯ অবধি খেলেছেন মোহনবাগানে। সবুজ মেরুন জার্সি গায়ে ডুরান্ড কাপ, কলকাতা ফুটবল লিগ, আইএফএ শিল্ড ও রোভার্স কাপ জয়ের সাক্ষী থেকেছেন।
|
ডাক্তারি ছেড়ে ফুটবলে
এরই মধ্যে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে বেছে নেন ফুটবলকেই। ১৯৫৩ সালে মোহনবাগানের ডুরান্ড জয়ের পিছনেও তাঁর অবদান ছিল। সেমিফাইনালে হায়দরাবাদ পুলিশের বিরুদ্ধে জয়সূচক গোল করেছিলেন, ফাইনালেও ন্যাশনাল ডিফেন্স আকাদেমির বিরুদ্ধে ৪-০ গোলে জয়ে গোল করেছিলেন বদ্রুও। ১৯৫৪ সালে মোহনবাগান কলকাতা লিগ ও আইএফএ শিল্ড জেতে। শিল্ড ফাইনালে হায়দরাবাদ পুলিশের বিরুদ্ধে গোল করেন বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়। ততদিনে তিনি সৈয়দ আবদুল রহিমের প্রশিক্ষণাধীন ভারতীয় দলে নিয়মিত সদস্য হয়ে উঠেছেন। বাগানকে রোভার্স কাপ জেতানোর পিছনেও অবদান ছিল বদ্রুর। মহমেডান স্পোর্টিংয়ের বিরুদ্ধে ফাইনালে ২-০ গোলের জয়ে একটি গোল ছিল তাঁর। বাংলার হয়ে সন্তোষ ট্রফিও জিতেছেন।
|
অলিম্পিকে নেতৃত্ব
১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিকে ভারতীয় ফুটবল দলকে নেতৃত্ব দেওয়া তাঁর কেরিয়ারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়। সেবার হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে ওয়াকওভার পাওয়ার পর ভারত কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে হারায় ৪-২ গোলে, তবে সেমিফাইনালে যুগোস্লাভিয়ার কাছে পরাস্ত হয়েছিল বদ্রুর ভারত। অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে নেভিল ডি সুজা হ্যাটট্রিক করেছিলেন। সেই ম্যাচে ভারতের গতির সঙ্গে পেরে ওঠেনি অজিরা। নেভিলের সঙ্গে তাঁর জুটির কথা বারবার বলতেন বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৫৮ সালে মোহনবাগানের অধিনায়ক হয়েছিলেন বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে সেবার তিনটি টুর্নামেন্টে রানার-আপ হয় সবুজ মেরুন। বাগান জার্সি গায়ে ইস্টবেঙ্গল ও মহমেডানের বিরুদ্ধে বদ্রুর যথাক্রমে চার ও পাঁচটি গোল রয়েছে।
|
অবসরের পর
১৯৫৯ সালে বার্মা শেল কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে শিলিগুড়ি চলে যান। সেখান থেকে ট্রেনে করে কলকাতায় খেলতে আসলেও বেশিদিন তা চালিয়ে যেতে পারেননি। ১৯৫৯ সালের মরশুমের শেষেই তিনি অবসর নেন। ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি বড়িশার কোচ হয়েছিলেন। তাঁর কোচিংয়ে বাংলা সন্তোষ ট্রফিও খেলেছে। ভারতীয় দলের নির্বাচকের দায়িত্বও সামলেছেন। তাঁকে খেল সম্মান প্রদান করেছে রাজ্য সরকার। ভারতীয় ফুটবলে অবদানের জন্য তাঁর ছবি দেওয়া ডাকটিকিটও প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা কিংবা সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেওয়ার ক্ষেত্রে বয়স কখনও প্রতিবন্ধকতা হয়নি। যদিও বৃষ্টিমুখর রাতেই চিরঘুমে শায়িত হলেন বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়।
|
শোকবার্তা মুখ্যমন্ত্রীর
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শোকবার্তায় লিখেছেন, "তারকা ফুটবলার সমর (বদ্রু) ব্যানার্জির প্রয়াণে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। তিনি আজ কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। তিনি ১৯৫৬ সালে মেলবোর্নে সামার অলিম্পিকসে জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন। এছাড়া মোহনবাগান, বালি প্রতিভা ক্লাব, বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে দলেও খেলেছিলেন। অংশ নিয়েছেন ডুরান্ড কাপ, কলকাতা ফুটবল লিগ, আইএফএ শিল্ড, রোভার্স কাপে। তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল অতুলনীয়।পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১৬-১৭ সালে তাঁকে 'লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড' প্রদান করে। তাঁর প্রয়াণে ক্রীড়া জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হল। আমি সমর (বদ্রু) ব্যানার্জির পরিবার-পরিজন ও অনুরাগীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।"
(ছবি- সোশ্যাল মিডিয়া)