প্রদীপের নীচের অন্ধকার আজ আরও গভীর, হাজার ওয়াটের ঔজ্জ্বল্য ঠিক যেন ঝলসানো রুটি
প্রদীপের নীচের অন্ধকার আজ আরও গভীর, হাজার ওয়াটের ঔজ্জ্বল্য ঠিক যেন ঝলসানো রুটি
প্রদীপের জ্যোতি ঠিকরে চারিপাশকে আলোকিত করার দৃশ্য নজরে পড়লেও চর্মচক্ষুতে এর থেকে বেশি দেখার প্রয়োজন পড়ে না, কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন এই আলো দিতে গিয়ে সলতেকে কী ভাবে তাপ সহ্য করে প্রতিটা মুহূর্তে পুরতে হয়। ভাবার প্রয়োজন পড়ে না আমাদের, বিশেষ করে ব্যস্ত জীবনে দার্শনিক হওয়ার প্রয়োজন নেই কারোরই। কিন্তু এই সলতের পরিবর্তে যদি মানুষের জীবনকে এই ভাবে আহুতি দিয়ে এক একটা লাশের ভিতের উপর মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে বিলাস বহুল বিশ্বকে তাক লাগানো স্টেডিয়াম বা অট্টালিকা, তখন কী ভেবে দেখার সময় আসবে।
হাজার ওয়াটের আলোর রোশনাই, মনোরঞ্জনে বিবিধি উপাদান এবং প্রাচুর্য্যে কিছু দিনের মধ্যেই বিশ্বের সমস্ত নজর কাড়তে চলেছে কাতারে হতে চলা ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২। বিশ্বকাপের ঔজ্জ্বল্য সমগ্র পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ছড়িয়ে থাকা মানুষের মধ্যে আলাদা উন্মাদনা নিয়ে এলেও দক্ষিণ নেপালের গঙ্গা সাহানির বাড়ির বাল্বটা টিম টিম করেই আলো দেবে, এক প্রান্তে তাঁর স্মৃতিকে আঁকড়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ব্রতী থাকবে তাঁর পরিবার।
পেটের টানে, সংসারের অভাবের তাড়নায় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বহু মানুষ পারি দেন মধ্যপ্রাচ্যে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহী. ইরান, কাতার সহ বিভিন্ন দেশে দক্ষিণ পূর্ব থেকে বহু শ্রমিক যান কাজের আশায়। তেমনই পরিবারকে কিছুটা স্বচ্ছ্বল জীবন দিতে অচেনা-অজানা ভিন দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন নেপালের বাসিন্দা গঙ্গা সাহানি। কিন্তু যেই পরিবারকে ভাল রাখতে অচেনা একটা মরু দেশে পারি দিয়েছিলেন সেখান থেকে যে তিনি আর ধরে প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরবেন তা হয়তো নিজেও কখনও ভাবেননি এই পৌঢ়। যেই স্টেডিয়ামগুলিতে কাতারে খেলাব হবে ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২ তারই একটিতে কর্মরত ছিলেন গঙ্গা।
এই বছরের শুরু দিকে কাতারে কর্মরত অবস্থায় প্রয়াত হন গঙ্গা সাহানি। তাঁর পরনে ছিল ইউনিফর্ম কিন্তু কর্মস্থলে মারা গেলেও কোনও রকম আর্থিক সাহায্য করা হয়নি তাঁর পরিবারকে, যেই কোম্পানির হয়ে তিনি কাজ করতেন সেই কোম্পানি যেমন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি তেমনই ব্যস্ত কাতারি সরকার খবর রাখেনি এদের। শুধু গঙ্গা সাহানি একা নন, এমন বহু মানুষ রয়েছে যাঁরা প্রয়াত হয়েছে কাজের মধ্যেই। তাঁদের পরিবার আজও সেই মানুষদের ছবি আঁকড়ে বাঁচে, জীবন কাটানোর শপথ নেয়।
বাবা নেই তা আজও যেন বিশ্বাস করতে পারেন না রাম পুকার সাহানি। বাবার ছবি আজও বুকে আঁকড়ে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। তিনি আজও বুঝতে পারেন না কী ভাবে একটা সুস্থ মানুষ প্রয়াত হল। রাম বলছিলেন, তাঁর বাবার মৃত্যুর খবর তিনি জানতে পারেন এক জন বন্ধুর থেকে। অবিশ্বাসে তিনি কাতারে বাবার নম্বরে ফোন লাগান। ওপার থেকে ফোন উঠলেও পরিচিত গলা তিনি শুনতে পাননি। তাঁর বাবার এক বন্ধু ফোন ধরে এবং এই মর্মান্তিক খবর নিশ্চিত করেন। তাঁর কথায়, "আমার হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায় ওই কথা শোনার পর।"
প্রয়াণের মুহূর্তে গঙ্গা সাহানির পরনে ছিল ইউনিফর্ম, তিনি সেই সময়ে কাজের মধ্যেই ছিলেন। কিন্তু কোনও রকম আর্থিক ক্ষতিপূরণ তাঁরা পাননি কারণ ডেফ সার্টিফিকেটে লেখাছিল, 'হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে স্বাভাবিক ভাবে মারা গিয়েছে।' কাতারের শ্রমিক আইন অনুযায়ী, পর্যাপ্ত তদন্ত না করে 'স্বাভাবিক কারণ'-এ হওয়া মৃত্যুকে কাজ সম্পর্কিত হিসেবে বিবেচনা করা হয় না এবং এর জন্য কোনও রকম ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না। ঠিক যেমনটা পাননি বহু সুস্থ, কম বয়সী শ্রমিকের পরিবার। সেই শ্রমিকরা কাতারে 'স্বাভাবিক ভাবে' প্রয়াত হয়েছে। রামের কাছে এই বিষয়টা একেবারেই বোধগম্য নয়। তাঁর প্রশ্ন, "কী ভাবে এক জন এত সুস্থ এবং সবল মানুষ কী ভাবে মারা যেতে পারে? আমি বিশ্বাস করতে পারিনি খবরটা।"
বিশ্বকাপের পরিকাঠামো তৈরির কাজে যুক্ত বহু ভিনদেশী শ্রমিক কাজের শেষে যোগ্য পারিশ্রমিক পাননি এবং বঞ্চিত হয়ে হয়েছে কাজের শেষের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে। এমনকী এই কাজের মধ্যে মারা যাওয়া শ্রমিকের পরিবার কোনও রকম ক্ষতি পূরণ পায়নি তাঁদের কোম্পানি থেকে বা কাতারি সরকারের পক্ষ থেকে। ফিফা, কাতারি সরকার রামের বাবা বা তাঁর মতো হাজারো মানুষকে ভুলে যেতে পারে কিন্তু তাঁর স্মৃতি সারা জীবন রয়ে যাবে রামের সঙ্গে। বাবার ফোনের ফোচ গ্যালারি উপর-নীচ করতে করতে নাম বলছিলেন, "দেখুন এটা আমার বাবা। আমি যখন কোনও সমস্যায় পড়ি তখন বাবর অভাব খুব অনুভব করি। ওনার ফোন উপর-নীচে করি স্বস্তি পাওয়ার জন্য।"
প্রয়াত শ্রমিকদের পরিবারকে এই ভাবে বঞ্চিত না করে বিশ্বকাপ শুরুর আগেই কাতারি সরকার এবং ফিফার উচিৎ বিধ্বস্ত, পরিবারের কর্তাকে হারানো মানুষগুলির পাশে দাঁড়ানো, প্রিয় জন হারানো মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটানো হয়তো যাবে না কিন্ত অনন্ত তাঁদের ভবিষ্যৎ যেন সুরক্ষিত থাকে সেই দিকে বিচার করা।
টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৩-এর ফাইনাল খেলা হবে এই মাঠে, লর্ডসের প্রতীক্ষা বাড়ল আরও দু'বছর