'অসম্ভব' শব্দটা তাঁর অভিধানেই ছিল না, তাই তো দুর্বল শরীরেও লড়াইটা চলছিল!
চিরকালই সোজা সাপ্টা কথা বলতে ভালবাসতেন তিনি। কাউকে তোয়াজ করে চলা তাঁর ধাতে সইত না। কাউকে জবাব দিতে হলে তাঁর মুখের শব্দ নয়, কলমের ধারই কথা বলত। এমনই ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। কাউকে পছন্দ হলে কাছে টেনে নিতে তাঁর একটুকু সময় লাগত না। আবার অপছন্দের ব্যক্তিকে ধারেকাছে ঘেঁষতে দিতেন না। এমনই ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। তাঁর দৃঢ় সাবলীল চিন্তার সঙ্গে কাজের এতটুকু ফারাক থাকত না।
লেখা ছিল তাঁর ভালবাসা, তা বলে কখনও শুধু লেখার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি প্রবীন এই সাহিত্যিক। মানুষের স্বার্থে মানুষের হয়ে বারে বারে পথে নেমেছেন। আদিবাসী, দুঃস্থদের মানবাধিকারের জন্য লড়াই করেছেন। বাংলায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনে তদকালীন বাম সরকারের বিরোধিতায় অন্যতম মুখ হয়ে উঠেছিলেন তিনি।[নব্বইয়ে বিদায়, চলে গেলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী!]
১৯২৬ সালে ঢাকার একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। বাবা মণীশ ঘটক ছিলেন কল্লোল আন্দোলনের প্রখ্যাত সাহিত্যিক। কাকা প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। মা ধরিত্রী দেবী ছিলেন স্বনামধন্য লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী। ছোট বেলা থেকেই এমন সাহিত্য পরিবৃত পরিবেশেই বেড়ে ওঠা ছোট্ট মহাশ্বেতার। আর সেই থেকেই তার মধ্যে সাহিত্য সত্ত্বার উদ্ভব।
দেশভাগের পর ঢাকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে এসে থাকতে শুরু করেন তিনি। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যাল থেকে ইংরাজিতে স্নাতক হওয়া। তারপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতোকত্তর। ১৯৪৮ সালে প্রখ্যাত নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে সাত পাকে বাঁধা পড়েন মহাশ্বেতা দেবী। ১৯৫৯ সালে বিবাহ বিচ্ছেদও হয়ে যায় তাদের। তাঁদের সন্তান নবারুণ ভট্টাচার্য বাংলা এমনকী ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্যিক ছিলেন। ২০১৪ সালের জুলাই মাসেই মৃত্যু হয় 'ফ্যাঁতাড়ু'-র।
১৯৬৪ খ্রীষ্টাব্দে তিনি বিজয়গড় কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন । সেই সময় সৃজনশীল লেখিকা ও সাংবাদিক হিসাবে কাজ করতেন তিনি। বাংলার একাধিকা উপজাতি, দলিত , মহিলা শোষণের উপর নানা ধরনের কাজ করেন মহাশ্বেতা দেবী। তাঁর আন্দোলন শুধু বাংলায় সীমাবদ্ধ ছিল না। বিহার, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড়েও আদিবাসীদের অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
২০১১-র বাংলায় পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনে পথে নেমেছিল এপিডিআর। আন্দোলনের পরও আন্দোলনে সামিল হওয়া একাদিক বুদ্ধিজীবী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষেই সরব হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। কিন্তু পরিবর্তনের পর একাধিকবার বর্তমান সরকারের শিল্পনীতি র বিরুদ্ধে সরব হয়ে সরকারের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। তবু তিনি পরোয়া করেননি। তাঁর পথের বাধাকে কিস্তিমাত দেওয়াই যে ছিল তার নেশা।