ডোনাল্ড ট্রাম্পের দৌলতে কি উঠেই যাবে এব্রাহাম লিঙ্কন, রোনাল্ড রেগনদের রিপাবলিকান পার্টি?
এবারের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রিপাবলিকান পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাণ্ডকারখানা নিয়ে প্রতিপক্ষ ডেমোক্র্যাট বা সাধারণ মানুষজন আলোড়িত তো বটেই, খোদ ট্রাম্পের দলের মধ্যেই দেখা দিয়েছে তুমুল অশান্তি।
সম্প্রতি এক দশক আগে ট্রাম্পের মহিলাদের সম্পর্কে কুরুচিকর মন্তব্য রেকর্ড করা একটি টেপ জনসমক্ষে বেরিয়ে পড়তেই ট্রাম্পের প্রকাশ্য বিরোধিতায় নেমেছেন একাধিক রিপাবলিকান নেতা। ট্রাম্পও কোনওরকম অনুশোচনার পরিবর্তে পাল্টাঘাতে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠছে রিপাবলিকান পার্টির ভবিষ্যৎ নিয়ে। ১৬২ বছর বয়সী দলটির কি তাহলে পথ এখানেই শেষ?
গত শনিবার (অক্টোবর ১৫) নিউ ইয়র্ক টাইমসে সেই দৈনিকের সাংবাদিক ডেকলান ওয়ালশ একটি সম্পাদকীয়তে সেই আশঙ্কার কথাই তুলেছেন। "ডোনাল্ড ট্রাম্প অ্যান্ড জিওপি: দ্য পার্টি অফ লিঙ্কন, রেগন অ্যান্ড পারহ্যাপ্স এক্সটিঙ্কশন" নামে এই সম্পাদকীয়তে ওয়ালশ জানিয়েছেন কিভাবে রিপাবলিকান পার্টির বিভিন্ন নেতা হাল ছেড়ে দিয়েছেন এবং জানাচ্ছেন যে তাঁদের দলের কার্যত মৃত -- এতটাই খারাপ পর্যায়ে পৌঁছেছে ট্রাম্পকে ঘিরে দলের মধ্যে কলহ।
তবে মার্কিন ইতিহাসে এই ঘটনা এই প্রথম নয়, মনে করিয়েছেন ওয়ালশ। ১৮৫২ সালে তদানীন্তন হুইগ পার্টির পতন শুরু হয় ক্রীতদাস প্রথাকে কেন্দ্র করে। এর দু'বছরের মধ্যে হুইগ পার্টির অস্তিত্ব লোপ পায় এবং তার জায়গায় এব্রাহাম লিঙ্কনের নেতৃত্বাধীনে রিপাবলিকান পার্টির উত্থান ঘটে।
মার্কিন মুলুকের গৃহযুদ্ধে লিঙ্কন নেতৃত্বে ক্রীতদাস-বিরোধী শক্তি জয়লাভ করে এবং বিভাজনের আতঙ্ক কাটিয়ে সেই শুরু সেদেশের জয়যাত্রা।
কিনতু ভাগ্যের এমনই ফের। আজ সেই সঙ্কটের একশো বাষট্টি বছর পর আবার একবার এক গুরুতর বিভাজনের মুখে দাঁড়িয়ে রিপাবলিকান পার্টি আর এবার সমস্যা একজন ব্যক্তিকে ঘিরে। তাঁর নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্প এ পর্যন্ত নয় যাহোক, তাহোক করে চালিয়ে যাচ্ছিলেন কিনতু সাম্প্রতিক টেপকাণ্ডটি তাঁর দলকে রীতিমতো বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে। রিপাবলিকান পার্টির বেশ কয়েকজন অর্থদাতা ট্রাম্পকে পরিত্যাগের প্রস্তাব দিয়েছেন। শতাধিক রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্পের পিছন থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছেন। আবার দলের বেশ কিছু কেষ্টবিষ্টু নিউ ইয়র্কের এই ধনকুবের প্রার্থীর পিছনে এখনও রয়েছেন।
আবার, ট্রাম্প এসবে একটুওমাত্র বিচলিত না হয়ে তাঁর নিজের দলের বিরুদ্ধেই তোপ দাগছেন। যাঁরা তাঁর পিছন থেকে সমর্থন তুলে নিয়েছেন, তাঁদেরকে "দেখে নেওয়ার" হুমকিও দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে, রিপাবলিকান পার্টির এখন ছত্রভঙ্গ অবস্থা। প্রায় এক দশক ক্ষমতার বাইরে থাকা রিপাবলিকানরা এবারেও ক্ষমতায় ফিরতে পারবেন কি না, সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ এখন বিশেষজ্ঞ মহলের।
রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে এমনিই এখন প্রচুর দলাদলি; তার উপর জুটেছেন ট্রাম্প
আসলে রিপাবলিকান দলের মধ্যেকার এই সমস্যা আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল শিবিরের এক টানাপড়েনেরই পরিচায়ক বলে জানাচ্ছেন ওয়ালশ। বিশেষ করে ২০০৮ সালে সে-দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বারাক ওবামার নির্বাচন এই রক্ষণশীলতাকে আরও ক্রুদ্ধ করে এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই শেতাঙ্গদের প্রতিনিধি হিসেবে ট্রাম্প উঠে আসেন এবছরের নির্বাচনে।
এমন নয় যে রিপাবলিকানরা ট্রাম্পকে খুব পছন্দ করছিলেন প্রথম থেকে কিনতু এই বছরের প্রাইমারি পর্যায়ে যেভাবে ট্রাম্প একের পর এক ষোলোজন প্রতিদ্বন্দীকে পরাস্ত করে দলের মনোনয়নটি দখল করেই ছাড়েন, তখন আর তাঁদের কিছু করার ছিল না, বলছেন ওয়ালশ।এর পর ট্রাম্প আক্রমণ শানাতে থাকেন বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী এমনকি বিদেশিদের বিরুদ্ধে আর রিপাবলিকানরা তা চুপচাপ হজম করতে থাকেন।
রিপাবলিকানদের সার্বিক পরিকল্পনায় এখন ট্রাম্প প্রায় জল ঢালতে চলেছেন
ওয়ালশ তাঁর সম্পাদকীয়তে জানাচ্ছেন, এতদিন রিপাবলিকানদের চিন্তাভাবনায় ছিল যে যদি ট্রাম্প হেরেও যান ৮ই নভেম্বর এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে, প্রতিনিধিসভায় এবং সিনেটে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার সুবাদে তাঁরা মার্কিন রাষ্ট্রনীতিতে যথেষ্ট শক্তিশালীই থাকবেন।
এমনকি, প্রাদেশিক স্তরেও রিপাবলিকানদের আধিপত্য থাকার ফলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়-পরাজয় নিয়ে বিশেষ ভাবিত ছিল না জিওপি নেতৃত্ব।
কিনতু ট্রাম্পের কুমন্তব্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর রিপাবলিকানদের সে পরিকল্পনা এখন বিপদের সম্মুখীন। কারণ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ে প্রতিনিধিসভার ৪৩৫টি এবং সিনেটের ৩৪টি আসনের প্রার্থীও নির্বাচিত হবেন আর ট্রাম্প যেভাবে এলোপাথাড়ি মন্তব্য করে আম মার্কিন নাগরিককে ক্ষিপ্ত করেছেন, তাতে মূল্য চোকাতে হতে পারে পুরো রিপাবলিকান পার্টিকেই, বলছেন ওয়ালশ। এই আশঙ্কাতেই এখন জিওপি ত্রস্ত।
দেড়শো বছর আগে লিঙ্কন ভেঙে পড়া একটি দলকে ফিরিয়ে এনেছিলেন বাস্তবে এবং সেই দল পরে ডোয়াইট আইসেনাওয়ার এবং রোনাল্ড রেগনের পরে রাষ্ট্রপতি উপহার দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। আজ একজন ব্যক্তির কারণে সেই দলের ভিতরেই নাভিশ্বাস উঠেছে। রিপাবলিকান পার্টির ভবিষ্যৎ আবার একজন লিঙ্কন এসে বাঁচাতে পারেন কি না, সেটাই এখন দেখার।