হিন্দুত্ববাদীরা ট্রাম্পকে পছন্দ করলেও সব আশাই যে তিনি পূরণ করবেন, এমন ভাবার কারণ নেই
ট্রাম্প এবং তাঁর রিপাবলিকান পার্টির দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীলতার সঙ্গে ভারতের হিন্দুত্ব ব্রিগেডের চিন্তাভাবনায় বিশেষ তফাৎ নেই।
কয়েকমাস আগে দিল্লিতে হিন্দু সেনা সমর্থকরা ধুমধাম করে রিপাবলিকান রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুজো অনুষ্ঠিত করেন। এই বছরের নির্বাচনে যেন ট্রাম্পই যেতেন বলে তাঁরা প্রার্থনা করেন কারণ তাঁদের মতে, নিউ ইয়র্কের এই ধনকুবেরই পারেন মুসলিম মৌলবাদকে নিশ্চিহ্ন করতে।
এর পর অক্টোবর মাস। নিউ জার্সির এডিসনে এই বিতর্কিত রিপাবলিকান প্রার্থী অংশ নেন রিপাবলিকান হিন্দু কোয়ালিশন-এর 'হিউম্যানিটি ইউনাইটেড এগেনস্ট টেরর' নামে একটি অনুষ্ঠানে যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে চলতে থাকা অভিযানের জন্য অর্থ জোগানো। এই অনুষ্ঠানের বিশেষ লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশ এবং কাশ্মীরের হিন্দুদের সুরক্ষা।
এরপর ট্রাম্প তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে ভারতের, হিন্দুদের এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসা করেন এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলার অঙ্গীকার করেন।
হিন্দুত্ববাদীরা ট্রাম্পকে এত ভালোবাসেন কেন?
কিনতু যেখানে আমেরিকার মধ্যে এবং বাইরেও বিতর্কিত ট্রাম্পের সমর্থন ক্রমেই নিম্নমুখী, সেখানে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা তাঁর প্রতি এত অগাধ ভরসা এবং ভালোবাসা দেখাচ্ছে কেন?
আদর্শগত অবস্থান প্রায় একই
এর প্রথম কারণ, দুই পক্ষেরই আদর্শগত অবস্থান। ট্রাম্প এবং তাঁর রিপাবলিকান পার্টির দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীলতার সঙ্গে ভারতের হিন্দুত্ব ব্রিগেডের চিন্তাভাবনায় বিশেষ তফাৎ নেই। ট্রাম্প যেমন মার্কিন দেশকে তার "হারানো গৌরব" ফিরিয়ে দিতে চান, তেমনই ভারতের হিন্দুবাদীরাও চায় নিজেদের দেশকে আবার "শ্রেষ্ঠ" প্রমাণ করতে। যদিও এই চাওয়ার কারণের মধ্যে তফাৎ রয়েছে (ট্রাম্পের চাওয়া অনেকটা সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে আর হিন্দুত্ববাদীদের এই চাহিদার ভিত্তি অনেক বেশি সাংস্কৃতিক-ইতিহাসগত) তবু তা শেষমেশ এই দু'পক্ষকেই মিলিয়ে দেয় এক বিন্দুতেই।
ট্রাম্পের উত্থানের অন্যতম কারণ যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল মানুষের মধ্যে আট বছর আগে কৃষ্ণাঙ্গ বারাক ওবামার নির্বাচনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ, তেমনই ভারতে বর্তমানে হিন্দুত্ববাদের এই রমরমার প্রধান কারণ হচ্ছে কংগ্রেসের শাসনকালে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের নাম সংখ্যালঘু তোষণ।
ট্রাম্প এবং তাঁর সমর্থকরা যেমন প্রচার করে এসেছেন যে ওবামার শাসনকালে মার্কিন মুলুক পিছু হটেছে তাই তাঁদের দায়িত্ব তাকে আবার এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, হিন্দুত্ববাদীদের তত্ত্ব অতীতের মুসলমান এবং ব্রিটিশ শাসনের ফলে হিন্দুদের অগ্রগতি ব্যাহত হয় তাই এবার সময় হয়েছে ইতিহাসের চাকা পিছনে ঘোরানোর।
আর দুইপক্ষেরই এই আগ্রাসী মানসিকতার প্রমাণ আমরা পেয়েছি আমেরিকার বিভিন্ন কদর্য বিতর্কে (যেমন ওবামার মার্কিন নাগরিকত্ব নিয়ে) বা ভারতে দাদরির মতো কলঙ্কময় কাণ্ডের মধ্যে দিয়ে। চামড়ার রং বা ধর্মবিশ্বাসের সংখ্যাগুরুত্বই হচ্ছে এই রক্ষণশীল শিবিরগুলির ভাবনাচিন্তার প্রধান ভিত্তি।
সাফল্যের প্রশ্নে আপসহীনতা আর তাই নিরাপত্তার প্রশ্নে দুশ্চিন্তা
এই দুই পক্ষের চিন্তায় মিল থাকার আরেকটি কারণ হচ্ছে সাফল্যের প্রশ্নে আপসহীনতা। এই ব্যাপারে অবশ্য ভারতের হিন্দুত্ববাদী কর্মী সমর্থকদের থেকে আমেরিকান রক্ষণশীলদের সঙ্গে বেশি মিল সেদেশে বসবাসকারী প্রবাসী ভারতীয়দের, যাঁরা প্রচুর মেহনত করে ওদেশে আজ প্রতিষ্ঠিত।
ভুললে চলবে না, আজকের আমেরিকানরাও কিন্তু একসময়ে সেদেশে বাইরে থেকে গিয়েই সেখানে পসার পেতেছে। তাই পরিশ্রম করে সাফল্য অর্জন করা এই দুই দেশের মানুষের কাছেই সমৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা খুব বড় ব্যাপার। আর তাই সন্ত্রাসবাদী বিপদের আশঙ্কা দু'পক্ষকেই কাছে নিয়ে আসে।
দুই দেশের শত্রু এক : ইসলামিক কট্টরপন্থা
তৃতীয়ত, এই বন্ধনকে আরও দৃঢ় করেছে ইসলামিক কট্টরপন্থা। ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র -- এই দুই দেশের কাছেই আজ ইসলামিক সন্ত্রাস আজ এক বড় মাথাব্যথার কারণ। দু'হাজার এক সালে কয়েক মাসের ব্যবধানে নিউ ইয়র্ক এবং নয়াদিল্লিতে দু'টি বড় ধরনের জঙ্গিহানা হয় আর দু'টিতেই জড়িত ছিল ইসলামিক গোষ্ঠী।
আবার, আজকের আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত -- এই দুই দেশকেই ইসলামিক সন্ত্রাসকে মাথায় রাখতে হচ্ছে। অতএব, শত্রু এক হওয়াতে ট্রাম্প এবং হিন্দুত্ববাদীরা একে ওপরের মধ্যে বিশ্বস্ত বন্ধু খুঁজে পেয়েছেন।
গণতন্ত্র, বাণিজ্য, বাজার, চিন -- ইত্যাদি নানা কারণেও আত্মীয়তা বেড়েছে এই দুই দেশের
আসলে, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আজ সন্ত্রাসের প্রশ্ন ছাড়াও আরও অনেক ব্যাপারেই কাছাকাছি। দু'টি দেশই যেহেতু গণতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক প্রশ্নে যেহেতু ভারত আজ নেহেরুবাদী চিন্তাভাবনা ত্যাগ করে খোলা বাজারকে গ্রহণ করেছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই মার্কিন নেতৃত্বের কাছে ভারত আজ অনেক কাছের দেশ।
এদেশের শিক্ষিত অথচ সস্তায় প্রাপ্ত কর্মী, বিরাট জনসংখ্যা অর্থাৎ বাজারের হাতছানি এবং সর্বোপরি চিনের বিরুদ্ধে উভয়ের শত্রুতা ভারত এবং আমেরিকাকে সরকারি এবং পিপল-টু-পিপল --দু'পর্যায়েই ঘনিষ্ঠ করেছে। আর তার উপর ট্রাম্পের মতো রক্ষণশীল-জাতীয়তাবাদী নেতা আসার ফলে তো সোনায় সোহাগা।
তবে প্রার্থী ট্রাম্প আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক হবেন বলে মনে হয় না
তবে ট্রাম্প যদি রাষ্ট্রপতি হতে সফল হন, তখন তাঁর সত্ত্বা কতটা ব্যবসায়িক হিসেবে কাজ করবে আর কতটা রাষ্ট্রনেতা, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর সেক্ষেত্রে, আজকের হিন্দুত্ববাদীরা যতটা আশা করছেন তাঁর থেকে, ততটা আশাপূরণ তিনি নাও করতে পারেন।