সিপিএম-এর বৃদ্ধ কমরেডগণ, ইগো ছেড়ে মমতার হাত ধরুন, ওটাই আপনাদের একমাত্র পথ এখন
শুনতে অবিশাস্য লাগলেও মমতাই এখন সিপিএম-এর একমাত্র ভরসা টিকে থাকার; নোট বাতিলের বিতর্কে তৃণমূল নেত্রীর হাত ধরলে ভবিষ্যতে রাজ্যতেও তাঁরা অক্সিজেন পাবেন
২০১৯ কে সামনে রেখে তিনি গুটি গুটি এগোচ্ছিলেন। আর এবারে কেন্দ্র সরকারের নোট বাতিলের পদক্ষেপের পর তিনি রীতিমতো জেগে উঠেছেন। শনিবার (নভেম্বর ১২) নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় থাকার মৌলিক অধিকার হারিয়েছে বলে আক্রমণ তো করলেনই, সঙ্গে সঙ্গে আর সকল বিরোধীদের সাথে হাত মেলানোর উদ্যোগের কথাও জানালেন। এবং সেই বিরোধীদের মধ্যে রয়েছে তাঁর চিরশত্রু সিপিএমও।
রাজনীতিতে সবই সম্ভব। কিনতু মমতা সিপিএম-এর হাত ধরতে পারেন একথা বিশ্বাস করা কষ্টকর হলেও মোদী শেষ পর্যন্ত হয়তো তাঁদের মিলিয়েই ছাড়বেন। এর আগেও একবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে রাজ্যের কিছু শীর্ষ বাম নেতাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আপ্যায়ন সহকারে জানিয়েছিলেন বিজেপিকে আটকানোর কথা। সেবার কথাবার্তা আর বেশিদূর এগোয়নি। কিনতু এবারের নোট বিতর্কের পরে মমতার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হচ্ছে মোদীকে চ্যালেঞ্জ জানাতে তিনি যে কোনও সীমায় যেতে প্রস্তুত।
একা বা কংগ্রেসের সঙ্গে ধোকা খেললেও সিপিএম-এর লাভ নেই
আর আজব শোনালেও এটাই বঙ্গীয় সিপিএম-এর সুযোগ। তাঁরা নিশ্চই এতদিনে বুঝে গিয়েছেন যে একার জোরে বা কংগ্রেসের মতো ক্ষয়িষ্ণু দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁদের গাড়ি আর এক ইঞ্চিও আগে যাবে না। কলোপযোগী নেতৃত্বের অভাব, সাংগঠনিক শক্তির চূড়ান্ত ক্ষয় ইত্যাদির কারণে বামেরা সমকালীন ভারতীয় রাজনীতিতে প্রায় ফসিলে পরিণত হয়েছেন সেকথা নতুন কিছু নয়।
কিনতু যেটা নতুন তা হল তাঁরা এই নোট ডামাডোলের বাজারে মমতার মতো শক্তিশালী বিরোধী নেতৃত্বের হাত ধরে বঙ্গীয় কুয়োর বাইরে গিয়ে জাতীয় স্তরে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়ে মনস্তাত্ত্বিক একটা বল জোগাড় করতে পারেন।
সূর্য্যকান্তের কথা শুনে মনে হয় না তিনি ইচ্ছুক; কিনতু একরোখামী করে কার লোকসান?
পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম সেক্রেটারি সূর্য্যকান্ত মিশ্রের কথা শুনে অবশ্য মনে হয় না বামেরা বড় লক্ষ্যের কথা বিন্দুমাত্র ভাবছেন বলে। সূর্য্যবাবু জানান সারদা বা নারদ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকা একটি দলের সঙ্গে তাঁরা হাত মেলাবেন না।
সিপিএম-এর এই অর্থহীন একরোখামীই তাদের আর বড় হতে দিল না। আজকের দিনে যেখানে ইস্যুতে-ভিত্তিক রাজনীতি ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে সেখানে সব বিষয়কেই একই নিক্তিতে মাপতে গেলে চিরকাল বঞ্চিতই থাকতে হবে সিপিএম-এর মতো 'সর্বহারার' দলকে।
বাম নেতৃত্বের বোঝা দরকার যে সারদা বা নারদ এখন মৃত বিষয়, অন্তত এই মুহূর্তে। গত বিধানসভা নির্বাচনে মমতা একাই দলকে জয় পাইয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে ওই অধ্যায়গুলি তাঁর ব্যক্তিগত আবেদনের চেয়ে বড় হতে পারেনি। আর ওই জয়ের ফলে মমতা এখন রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে জাতীয় রাজনীতিতে বড় ভূমিকা পালন করতে চাইছেন। কিনতু বামেরা মুখে মোদীর বিরুদ্ধাচরণ করলেও মানসিকভাবে তাঁরা আটকা পড়ে আছেন রাজ্য রাজনীতিতেই। কূপমণ্ডুক-এর চেয়ে উচ্চতর ভাবনা তাঁদের কাছে আশা করাটাই যেন ভুল।
মমতার জনদরদী রাজনীতির অংশীদার হয়ে সিপিএম কিছুটা সুফল পেতে পারে
মোদীর ঘোষণার পড়ে মমতা যে উদ্যোগটি নিয়েছেন সেটা রাজনৈতিক তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মোদী 'বড়লোকদের পক্ষে' দেখিয়ে নিজের জনদরদী দিকটিকেই তিনি জাতীয় পর্যায়ে প্রমাণ করতে চাইছেন যাতে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে তিনি একটি বিকল্প মঞ্চের নেতৃত্ব দিতে পারেন। ব্যাপারটা যদিও সহজ নয় কিনতু তাও মমতার মতো সংগ্রামী নেত্রী চেষ্টা ছাড়তে রাজি নন। আর তিনি যখন নিজেই বলছেন যে এব্যাপারে তিনি বামেদের হাত ধরতেও রাজি, তখন বামেদের বেঁকে বসার কোনও কারণই থাকতে পারে না।
আর তাছাড়া, সাধারণ মানুষের জন্যেই যদি তাঁরা কাজ করে থাকেন, তখন মমতাকে উপেক্ষা করলে সে এজেন্ডাও হাতছাড়া হবে।
নীতীশ-লালু পারলে মমতা-বাম পারবে না কেন?
যদি বিহারের দুই শত্রু নীতীশ কুমার এবং লালুপ্রসাদ একসঙ্গে এসে মোদীকে ঠেকাতে সফল হন, তাহলে এই রাজ্যের দু'টি প্রধান শক্তিই বা তা পারবে না কেন? অবশ্য পারার প্রশ্ন আসবে তখনই যখন তার গুরুত্ব সিপিএম নেতৃত্ব প্রকৃত অর্থে অনুধাবন করতে পারবেন।
সিপিএম-এর এটা বোঝা প্রয়োজন যে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তাঁদের কৌশল বদলের সময় এসেছে এবং টিকে থাকতে গেলে সেই কৌশল তাঁদের নিতেই হবে। আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে প্রধান শক্তি হিসেবে লড়বে তৃণমূল এবং বিজেপিই। অশীতিপর বাম এবং বহু-বিভক্ত কংগ্রেস যতই হাত মেলান, তৃতীয় এবং চতুর্থ শক্তি হিসেবে তারা কিছুই করতে পারবে না। আর তাই জাতীয় নয়, রাজ্যেই নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে বামেদের আজ মমতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে মোদীর বিরুদ্ধে হাত মেলানো আশু প্রয়োজন।
বৃহত্তর শক্তি হিসেবে মমতা সে আহ্বান দিয়ে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন আর এবার দুর্বলতর শক্তি হিসেবে তাতে সাড়া দেওয়ার দায়িত্ব বামেদের ঘাড়েই বর্তায়। কিনতু সেটা করতে গেলে আগে বাম শিবিরের বৃদ্ধতন্ত্রকে নিজের অর্থহীন অহং ত্যাগ করতে হবে। বুঝতে হবে যে সাহায্য ছাড়া তাঁদের পক্ষে এই যুগে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কার্যত অসম্ভব।
বিজেপির সঙ্গে তাঁরা আদর্শগত ভাবে যাবেন না আর কংগ্রেসের যা অবস্থা, তাতে তাঁদের সঙ্গে গিয়ে যে লাভ নেই সেটা এবছরের বিধানসভা নির্বাচনেই দেখা গিয়েছে। তাই মমতাই এখন শেষ ভরসা লাল দুর্গের।