বিভক্ত জার্মানি 'অস্টপলিটিক'-এর মাধ্যমে শান্তির রাস্তা দেখিয়েছিল; ভারত-পাক পারে না সেরকম কিছু?
দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তির কোনও সম্ভাবনাই নেই, প্রায়ই শোনা যায় বিভিন্ন মঞ্চ-মহলে। এই ভারত-পাক সমস্যা যতদিন থাকবে, অন্যথা হওয়ার পরিস্থিতি তৈরিই হবে না বলে অনুশোচনা কানে আসে। ঠিকই, যদ্দিন সন্ত্রাসবাদের কালো হাতকে এই অঞ্চল থেকে উৎখাত না করা যায়, সীমা সমস্যা মিটিয়ে না ফেলা যায়, তদ্দিন কিছুই হওয়ার নয়।
কিনতু রাজনৈতিক-কূটনৈতিক স্তরে আকচা-আকচি কবে শেষ হবে কেউ জানে না। আদৌ এর কোনও শেষ হবে কিনা তাও কেউ জানে না।
কিন্তু তাই বলে কি আর সামনের কোনও পথই খোলা থাকবে না? রাজনৈতিক বিবাদ বিশ্বের বহু দেশের মধ্যেই রয়েছে কিনতু তাই বলে কি সেটাকেই শেষ কথা ধরে নিতে হবে? সম্প্রতি উরিতে ভারতীয় জওয়ান নিধন এবং তার পরে ভারতীয় সেনার সার্জিক্যাল স্ট্রাইককে ঘিরে দেশের সুশীল সমাজে খুব বড় আলোড়ন তৈরি হয়। ভারতে কাজ করা পাকিস্তানি অভিনেতা-শিল্পীদেরও টার্গেট করা হয়। কেউ তাঁদের পাশে দাঁড়ান, কেউ বিপক্ষে বলেন।
কিনতু এই সময়ে যে হার্ড পলিটিক্স নয়, সফ্ট পিপল-তো-পিপল কন্ট্যাক্ট-ই যে বরফ গলানোর কাজে আসে, তা ভেবে দেখেন না কেউই। আর দেখবেনই বা কিভাবে? প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষে তো আমরা সবাই রাজনৈতিক নেতাদের হাতের পুতুলে পরিণত। আর তার উপর আছে সংবাদমাধ্যমের নামে আগুনে ঘৃতাহুতি দেওয়া কিছু গোষ্ঠী। নিজেদের ব্যবসার খাতিরে যারা নিজের বাড়িতেও আগুন লাগাতে পিছপা হয় না।
উইলি ব্রান্ডট ষাটের দশকের শেষ দিকে 'অস্টপলিটিক' নীতি নিয়ে পথ দেখিয়েছিলেন
১৯৬০-এর দশকে ঘোর ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে বিভক্ত জার্মানিতেও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। কমিউনিজম-প্রভাবিত পূর্ব জার্মানিকে বয়কট করে পশ্চিম জার্মানি। হালস্টেইন ডকট্রিন মাফিক যে সমস্ত দেশ পূর্ব জার্মানির সঙ্গে সম্পর্ক রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের থেকেও দূরত্ব বজায় রেখে চলে পশ্চিম জার্মানি।
কিনতু এই কট্টরপন্থী নীতি আদতে যে ব্যুমেরাং হবে তা বোঝেন উইলি ব্রান্ডট, যিনি পরবর্তীকালে জার্মানির চ্যান্সেলর হন। পূর্ব জার্মানির প্রতি কট্টরপন্থা থেকে সরে এসে ব্রান্ডট প্রস্তাব দেন 'অস্টপলিটিক' বা পূর্ব নীতির যার লক্ষ্য ছিল দুই জার্মানির মধ্যে সম্পর্কে উন্নতি ঘটানো, বিশেষ করে অর্থনৈতিক।
কারণ ব্রান্ডট-এর মতে, যদি দুই জার্মানির মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নত হয় তাহলে কমিউনিস্টদের প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে এমনই খর্ব হবে। কট্টরপন্থা দিয়ে যে কাজ আগের সরকার পারেনি, ব্রান্ডট-এর নরমপন্থা সেটাই করে দেখায়। অন্যান্য পশ্চিমী শক্তিগুলিও এতে সায় দেয় এবং মহাযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপে জার্মানিকে নিয়ে উৎকণ্ঠা অনেকটাই প্রশমিত হয়।
অতএব, সবসময় যে মারকাটারি মেজাজেই সমস্যার সমাধান হবে, তার কোনও মানে নেই। যেখানে যুদ্ধের কোনও চিহ্ন নেই, সেখানে গোলাগুলি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি হওয়ার কোনও কারণ থাকে না। ভারত এবং পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা প্রযোজ্য। যদি রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সংঘাত বাড়তেই থাকে, তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে সহজাতভাবে গড়ে ওঠা সম্পর্ককে বাহবা দেওয়াই উচিত কাজ। তাঁদের মধ্যেও বিভাজনের রাজনীতি খেলা নয়।
শিল্পীরা তো আর সন্ত্রাস করেননি; তাঁদের টার্গেট করা কেন?
সীমান্তে জঙ্গিহানা নিয়ে যখন পারদ চড়ছে তো চড়ছেই, তখন অভিনেতা-শিল্পীদের ভারত ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা মানে শান্তির সব সম্ভবনাকেই জলাঞ্জলি দেওয়া। এখন কেউ যদি প্রশ্ন করেন যে এই শিল্পীরা কিভাবে শান্তি আনবেন যখন তাঁদের সরকারই শান্তি চায় না, তখন তাঁদেরকে বলা দরকার যে কবুতর উড়িয়ে ভ্রান্ত শান্তি-শান্তি খেলা রাষ্ট্র খেলে, সাধারণ মানুষের মধ্যে যে শান্তির বাতাবরণ, তা চোখে না দেখা গেলেও তাতে জল কম মেশানো থাকে।
তাই অভিনেতা-শিল্পী-খেলোয়াড়দের পারস্পরিক মিলমিশকে কখনওই নিচু চোখে দেখা উচিত নয়। সীমানা ওঁরাই খুলে দিতে পারেন, সৈন্যরা তা শুধুই বন্ধ করে। আর উইলি ব্রান্ডট-এর মতো আমাদেরও বোঝা দরকার যে তালা বন্ধ করে রাখলে ভালো প্রতিবেশী হওয়া যায় না আর ভালো প্রতিবেশী না হতে পারলে শান্তি চিরকালই অধরাই থেকে যাবে।
ব্রান্ডট সাহেব যেভাবে দরজা খুলে কমিউনিস্টদের মাত করার কথা ভেবেছিলেন, আমাদেরও উচিত আরও বেশি করে ট্র্যাক-টু বা পিপল-তো-পিপল ডিপ্লোম্যাসিকে উৎসাহিত করা। তাহলেই দুই দেশের -- বিশেষ করে পাকিস্তানি রাষ্ট্রব্যবস্থায় যারা অহরহ ঝামেলা পাকানোর চেষ্টায় ব্যস্ত, তারা কোনঠাসা হবে। আর যদি আমরা একে অন্যের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ভাবি যে এটাই যোগ্য জবাব, তাহলে তা সম্পূর্ণই ভুল।
তাই আসুন একে অপরের সঙ্গে ক্রিকেট খেলি, গান শুনি, অভিনয় দেখি, সাধারণ মানুষের কথা বুঝি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সেনা তাঁদের কাজ করুক। এই সময়ে সব রাস্তাই খোলা রাখা জরুরি। শুধু লাগামহীন হিংসা দিয়ে কোনও কাজ হয় না, নিজের উপকারেও নয়।
জার্মানি যদি 'অস্টপলিটিক'-এর মাধ্যমে পথ দেখায়, আমরা পারি না?