জ্যোতিবাবুর লিলিপুট বংশধরেরা মেরুকরণ সামলাবেন কীভাবে, সেই চিন্তাতেই ত্রস্ত
একে তো কোচবিহার আসনটিতে দেওয়ার মতো প্রার্থীই খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁরা। তার উপর আসন্ন দু'টি লোকসভা উপনির্বাচনে (কোচবিহার ছাড়াও তমলুক) কংগ্রেসের সঙ্গে রফায় যাওয়া হবে না সাফ জানিয়ে দিয়েছে রাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্ব। আর তারও উপর যোগ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে ক্রমশও মেরুকরণের রাজনীতির বিস্তার। সব মিলিয়ে, রাজ্যের অশীতিপর বাম নেতৃত্ব আতঙ্কিত -- কীভাবে তাঁরা এত্ত ঠ্যালা সামলাবেন!
জ্যোতি বসুর আমলে বামেদের নেতৃত্ব এবং সংগঠন এত শক্তিশালী ছিল যে গেরুয়া বাহিনীর পক্ষে পশ্চিমবঙ্গে ভিত শক্ত করা সম্ভবপর হয়নি। অযোধ্যা-রাম রাজনীতি নিয়ে যখন নব্বই দশকের গোড়ার দিকে গোবলয় উত্তাল, তখন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গে তাঁর আঁচটুকুও পড়তে দেননি।
'সেকুলার লিগ্যাসি অফ দ্য লেফট' বলতে যা বোঝায়, তখন ঠিক তাই ছিল বাংলায়। ঠাকুর-দেবতা-ধম্ম ইত্যাদির রাজনীতি তাই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি, শহীদ মিনারে রাজীব গান্ধী সরকারের বিরুদ্ধে অটলবিহারী বাজপেয়ির সঙ্গে জ্যোতিবাবু হাত মেলালে বা লালকৃষ্ণ আদবানির দাবি মাফিক: জ্যোতিবাবুর গোপনে বিজেপি নেতৃত্বের কাছে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের সরকারের সমালোচনা করলেও না।
পরবর্তীকালে বর্ষার গঙ্গার ক্ষয়িষ্ণু পাড়ের মতোই ক্ষয়ে যায় বামেদের শক্তি। জ্যোতিবাবু ছাড়াও অনিল বিশ্বাস বা সুভাষ চক্রবর্তীর মতো সাংগঠনিক নেতারা প্রয়াত হন। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জ্যোতিবাবুর উত্তরসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারের শিল্পায়ন নিয়ে আত্মঘাতী প্রয়াস ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে এসে কুপোকাত করে বামেদেরই, ধসে যায় চৌত্ৰিশ বছরের সাজানো অট্টালিকা। ক্ষমতায় আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বামেদের পতনের পর সে জায়গা ভাগাভাগি করেছেন মমতা এবং গেরুয়াবাহিনী
বামেদের পতনের পর যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে, তার সিংহভাগ মমতার তৃণমূল কংগ্রেস গ্রাস করলেও গেরুয়া বাহিনীও যে খেলায় একদমই নেই তা নয়। তার একটি কারণ হচ্ছে তৃণমূল পূর্বতন বামেদের মতো সংগঠন-নির্ভর দল নয়, তা ব্যক্তিনির্ভর দল। তাই তৃণমূল সেভাবে সংগঠনের জায়গাটি একা ধরতে না পারার ফলে বিজেপি, বা ঠিকঠাক করে বললে আরএসএস-এর মতো আরেকটি সংগঠনবাদী শিবির তার সুবিধাটা নিয়েছে।
কিন্তু মমতার মতো কোনও ম্যাচ-উইনিং নেতা না থাকার ফলে তাদের সংগঠনের কাজ সেভাবে রাজনৈতিকভাবে সামনে আসতে পারছে না। তাই অশান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চলছে।
কিনতু পশ্চিমবঙ্গের বামেরা কেরলের বামেদের মতো গেরুয়া শিবিরের মোকাবিলা করছে না কেন? কেরলের মতো ডান-বামের হিংসার রাজনীতি মোটেও কাম্য নয়, কিনতু বাংলায় তো বামপন্থীদের টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত করতে শোনা যাচ্ছে না। তাঁরা দরজা এঁটেই ভিতরে কাঁপছেন -- কখনও মমতার ভয়ে, কখনও বা মেরুকরণের রাজনীতির। আর একা চলতে ভয় পেয়ে ভাবছেন কংগ্রেসের পিছনে লুকোনোর কথা। যেন তাঁদের নিজস্ব কোনও রাজনৈতিক পরিচয়ই নেই। যে জ্যোতিবাবু একদা একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে একটি জাতীয় দলের বিপজ্জনক রাজনীতি তাঁর রাজত্বে ঘেঁষতে দেননি, তাঁর বংশধরদের আজ এ কী অবস্থা!
মেরুকরণের মোকাবিলা করবেন কিভাবে?
আসলে এ রাজ্যে ধর্মকেন্দ্রিক রাজনীতির মাধ্যমে মেরুকরণের চল সেভাবে না থাকাতে বামেরা এব্যাপারে কিভাবে পাল্টা কৌশল সাজাবেন, তা নিয়ে দিশেহারা। যেখানে কংগ্রেসের মতো জাতীয় দলই আজ ধর্মীয় মেরুকরণের বিরুদ্ধে যুঝে উঠতে পারছে না, সেখানে একটি দুর্বল প্রান্তিক দল হয়ে বামপন্থীদের পক্ষে কতটা কী করা সম্ভব তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে তাঁদের ঘরে ক্রমশ ভাঙ্গন এবং তৃণমূলের আক্রমণ এড়াতে বাম শিবিরের নিচুতলার মানুষের বা তৃণমূলের উপর বিরক্ত মধ্যবিত্তের বিজেপির ছাতার তলায় গিয়ে দাঁড়ানো। এতে মমতাকেও এড়ানো গেল, আবার বামেদের ডুবন্ত নৌকোতেও থাকতে হল না।
তৃণমূল কংগ্রেস একটি নিতান্তই ডানপন্থী দল; বিজেপির সঙ্গে তার আদর্শগত সংঘাত কম হওয়ারই কথা
আর তার উপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লাগামছাড়া তোষণের রাজনীতি গেরুয়াবাহিনীকে আরও উৎসাহিত করছে। তৃণমূল কংগ্রেসও দল হিসেবে কংগ্রেসের মতোই নিতান্ত ডানপন্থী -- শুধু প্রত্যক্ষ সংখ্যাগুরুর রাজনীতিতে করে না এই যা। আর তাই বিজেপির সঙ্গে বাংলার শাসকদলের আদর্শগত সংঘাত হওয়ার সম্ভাবনা কম, সে সামনাসামনি মমতা এবং মোদী যতই পরস্পরের উপর আক্রমণ শানান না কেন। গেরুয়া শিবির থেকে তো বলেও হাসিয়েছে অতীতে যে তৃণমূল কংগ্রেস তাঁদের স্থায়ী দুশমন নয়, আসল লড়াই হচ্ছে বামেদের সঙ্গে।
আছে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ, সীমান্ত এলাকাগুলিতে নানা অসন্তোষ
তাছাড়া, ওপারে বাংলাদেশে ইসলামিক কট্টরপন্থার উত্থান বা উত্তরবঙ্গের সীমান্ত লাগোয়া অঞ্চলগুলিতে নানা অসন্তোষের হাওয়াও কার্যত ইন্ধন যোগাচ্ছে বিজেপি-আরএসএসকে। কলকাতায় বসে রাজ্যের আনাচেকানাচে কিভাবে এই ডানপন্থী শিবিরের শিকড় শক্ত হচ্ছে, তা বোধকরি শাসকদল আঁচ করতে পারছে না।
শাসন করতে হলে মমতাকে তোষণ করে যেতেই হবে কারণ তাঁর আর কোনও ম্যাজিক জানা নেই
আর পারলেও বিশেষ কিছু ফারাক পড়ে না। কারণ বাম-পরবর্তী রাজ্য রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেসকে মানুষের মনে টিকে থাকতে গেলে এলোপাথাড়ি জনপ্রিয়তাবাদ দেখিয়েই যেতে হবে, তাতে সংখ্যাগুরু আবেগ ব্যাথা পাক বা না পাক কারণ ও দলের কোনও আদর্শগত, সংগঠনগত বা নেতৃত্বগত কর্মসূচী নেই। ব্যাস, ওতে শুধু মমতা আছেন আর তিনি যতদিন থাকবেন রাজনীতিতে, তৃণমূল কংগ্রেসকে হারানো প্রায় অসম্ভব কাজ।
কিনতু এর মূল্য চোকাতে হচ্ছে চালচুলোহীন বামেদের। বয়সের ভারে অথর্ব পুরোনো নেতৃত্ব, অপরিণত শ্রমবিমুখ নতুন নেতৃত্ব এবং ভঙ্গুর সংগঠন দিয়ে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করাই ঘোর কঠিন কাজ, জেতা তো বহুদূরের কথা।