বাংলায় বিরোধী শিবিরে লাগামহীন ভাঙন; মমতার মোকাবিলা করতে এখন ভগবানই ভরসা
২০০৪ সালে তিনিই ছিলেন তাঁর দলের একমাত্র সাংসদ। দুঃখ করে তাঁকে একবার বলে শোনা গিয়েছিল: "ওরা আমাকে বলতে দেয় না পার্লামেন্টে। একা যেহেতু আমি।" সেই সময়ের পর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। আজ ২০১৬-তে দাঁড়িয়ে সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে প্রায় অপ্রতিরোধ্য। [ মোদি সাবধান! ২০১৯-এ কিন্তু দিদি আপনাকে প্রবল চ্যালেঞ্জ দিতে চলেছেন]
গত এপ্রিল-মে মাসে হওয়া রাজ্যের বিধানসভা ভোটে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে মমতা একা হাতে দলকে অবিস্মরণীয় জয় এনে দেন। মোট ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২১১টি যেতে তৃণমূল একাই - যা বহু দশক পরে প্রথম রাজ্য রাজনীতিতে। বিরোধীরা সম্মিলিত হয়েও উড়ে যায় খড়কুটোর মতো। কিন্তু তৃণমূলের জয়রথ নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু থেমে যায়নি। ভোটের কয়েকমাস পরেও বিরোধীদের ঘর ভেঙে পড়ছে তো পড়ছেই।
২১১ থেকে তৃণমূল এখন ২১৭, বললেন যুব নেতা
সম্প্রতি বিরোধী শিবির থেকে ৬জন বিধায়ক শাসকদলে যোগ দিয়ে ২১১কে ২১৭তে নিয়ে গিয়েছেন বলে তৃণমূলের যুব সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন। বঙ্গে কংগ্রেসের অন্তিম দূর্গ মুর্শিদাবাদও ভেঙে পড়েছে বঙ্গেশ্বরীর ঝড়ের সামনে। এছাড়াও, রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে বিধায়ক-নেতা-কর্মীরা দল বেঁধে তৃণমূলে যোগদান করছেন নিয়মিত। প্রশ্ন উঠছে: এইভাবে কি তৃণমূল 294 টি আসনই দখল করে বিধানসভা তথা সম্পূর্ণ রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করে দিতে পারে?
প্রত্যক্ষ কোনও উত্তর তৃণমূল নেতৃত্ত্ব না দিলেও ব্যাপারটা যে তাঁরা উপভোগ করছেন, সে বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। আর করবেন নাই বা কেন? একপেশে মার খেতে খেতে এখন যখন চাকা একশো আশি ঘুরে গিয়েছে, তখন তো খুশির আমেজ থাকাটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু আসল প্রশ্ন অন্য জায়গায়। যদিও বিরোধীরা বলছেন যে শাসকদল ভয় এবং প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের ঘর ভাঙছে, কিন্তু আসল কথা হল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আজ যাঁরা বিরোধী আসনে আসীন, তাঁরা নিতান্তই অক্ষম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ঠাণ্ডা স্টুডিওতে বসে তাঁরা যতই বিষোদ্গার করুন না কেন, পথেঘাটে তাঁদের দেখলে একটির বেশি দু'টি ঘাড় ঘুরবে না।
ভয়, প্রলোভন থাকতে পারে; কিন্তু আসল কথা বিরোধীদের অপদার্থতা
ঠিক এঁদের জায়গাতেই মমতা যখন ছিলেন, তখনও রাজ্যে শাসকদলের একাধিপত্য চলত। কংগ্রেসের 'বোঝাপড়ার' রাজনীতিতে অতিষ্ট হয়ে নেত্রী ১৯৯৮ সালে নিজের দল প্রতিষ্ঠা করেন কিন্তু ২০০১ এবং ২০০৬ সালে পর্যায়ক্রমে কংগ্রেস এবং বিজেপিকে সঙ্গে নিয়েও বামফ্রন্টের চুলও বাঁকা করতে পারেননি।
মমতা বিরোধী নেত্রী হিসেবে যতটা পরিশ্রম করতেন, আজ বিরোধীপক্ষের কতজন তা করেন?
কিন্তু মমতা কোনওদিনই হাল ছাড়েননি এবং ২০০৬ সালের সিঙ্গুর আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তৃণমূল নেত্রীর রাজনৈতিক যাত্রা নতুন অভিমুখ নেয়। রাজ্যে পরিবর্তন আসুক না আসুক, নেত্রীর জীবনে অবশ্যই পরিবর্তন আসে পরবর্তী সময়ে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতি সাধারণ ভাবমূর্তি বা নন-এলিট পরিচয় নিয়ে দাম্ভিক বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণী যতই নাক কুঁচকোক না কেন, একথা আজ অনস্বীকার্য যে বাংলায় তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার মতো নেতা বা নেত্রী আর একটিও নেই।
সূর্য, বুদ্ধ, অধীর, দীপা - কোথায় যে সব ছিটকে পড়লেন
যে-ক'জন নেত্রীকে চ্যালেঞ্জ জানানোর কথা ভেবেছিলেন, তাঁরা সবাই একে একে মুখ থুবড়ে পড়ছেন। গত বিধানসভার বিরোধী নেতা সূর্য্যকান্ত তো এবার বিধানসভায় ঢোকার ছাড়পত্রই পাননি। বুদ্ধদেব ভোটে লড়েনইনি। বিমান তো কোনওদিনই ভোটার ময়দানে থাকেন না। অধীর চৌধুরী এখন নিজ গৃহেই পরবাসী। পাহাড়ে বিমল গুরুং কবে হড়কে পরে যাবেন, বলা যায় না।
মানসও মিলিয়ে গেলেন মা, মাটিতে...
মানস ভুঁইয়া এইবেলা এককালে রাহুল গান্ধীকে "এযুগের বিবেকানন্দ বলেছিলেন" ঠিকই, কিন্তু এখন তিনি হয়তো দিদিকে 'বিবেকানন্দের চেয়ে বড়' মনে করছেন তাই মানে মানে যোগ দিয়েছেন শাসকদলেই। দীপা দাশমুন্সিকে খোদ মমতার বিরুদ্ধেই নামানো হয়েছিল কিন্তু হালে পানি পাননি।
বিজেপির কিছু নেত্রী পাল্টা দেওয়ার জন্যে তৈরী হচ্ছিলেন ঠিকই, ভোটের দিন 'হাতও ঘুরিয়েছিলেন', কিন্তু জনগণের তাঁদের উপযুক্ত বলে মনে করেনি। সব মিলিয়ে মমতার সমকক্ষ কাউকে এখনও রাজ্যের সমকালীন বিরোধীপক্ষ খুঁজে পাননি। আর পাবেন কিনা তাও যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
পাহাড় থেকে সমতল... স্রোতের মুখ এখন তৃণমূলের দিকে; এটাই বাস্তব
আর এই সারসত্য ভালো ভাবে বুঝেই শয়ে শয়ে কংগ্রেস এমনকি পাহাড়ের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা কর্মী ঝুঁকেছেন তৃণমূলের দিকে। ভয় বা প্রলোভনের যুক্তি হয়তো এক শতাংশ সত্য (সংগঠনের দিক দিয়ে তৃণমূল এখনো অনিলায়নের মডেল ছুঁতে পেরেছে বলে মনে হয় না )কিন্তু বাকি নিরানব্বই শতাংশ গল্প ওই - মমতার মোকাবিলা করার মতো রাজনৈতিক শক্তি অন্তত এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে আর একটি ও নেই। আর বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে উটপাখির মতো আচরণ করে যে কোনওই লাভ নেই আখেরে, তা বিরোধী দলগুলির নিচুতলার কর্মীরা বুঝে গিয়েছেন, বোঝেননি জনবিচ্ছিন্ন উচ্চস্তরের নেতৃত্ব।