যৌন দাসত্বের কারবারে ভারতের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ
গত এক দশকে ভারতের জিডিপি প্রায় ৭৬ শতাংশ বেড়েছে। তবে প্রদীপের তলায় অন্ধকারের মতোই চাপা পড়ে গিয়েছে এই অর্থনৈতিক হাওয়া বদলের মাঝে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যার মধ্যে একেবারে উপরের দিকে রয়েছে যৌন ব্যবসার লক্ষ্যে মানব-পাচার।
দেশের জিডিপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রায় ২০ শতাংশ হারে বেড়েছে নাবালিকা বা সাবালিকাদের যৌন দাসত্বে পরিণত করার ঘৃণ্য পরম্পরা। কমবয়সী হোক বা কিছুটা সামলে নেওয়া বয়স, নানাভাবে ফাঁদে ফেলে তাঁদের দিয়ে সেজেছে যৌন পেশার পসরা। আর এখানে জনৈক পিঙ্কি হোক বা অনামিকা, সকলেই ভোগ্যপণ্য ছাড়া আর কিছুই নয়। আর বলা যায়, এভাবেই মানব-পাচার ও তাদের দিয়ে যৌন পেশায় কাজ করানোর স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ।
মাত্র ১১ বছরে পিঙ্কি নেমেছে যৌন পেশায়
পিঙ্কির (আসল নাম পরিবর্তিত) বয়স এখন ১৬। প্রায় আঠারো মাস আগে উদ্ধার হয়েছে মুম্বইয়ের উল্লাসনগর থেকে। তাকে উদ্ধার করেছে মুম্বইয়ের মানব-পাচার বিরোধী সংগঠন 'এএইচটিইউ'। উত্তর ২৪ পরগনায় নিজের বাড়ি থেকে ১৯০০ কিলোমিটার দূরে পিঙ্কির এই হারিয়ে যাওয়া যে কোনও অন্ধকারময় জীবনের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর নয়।
মাত্র ১১ বছর বয়স হওয়ার পরই পিঙ্কিকে যৌন পেশায় ঠেলে দেওয়া হয়। যে সময়টাকে জীবনের সবচেয়ে 'অন্ধকারময়' বলে নিজেই জানিয়েছে সে। আর সবচেয়ে বিস্ময়ের, পিঙ্কিকে এই পেশায় ঠেলে দেয় তার মা-ই।
১৫ বছরের আমিনার কাহিনি
পিঙ্কির চেয়ে আমিনা খাতুনের (আসল নাম পরিবর্তিত) কাহিনি খানিকটা সুখের। আমিনা বাংলাদেশের সাতক্ষীরার মেয়ে। নিজের মামা জোর করে এক বিবাহিত পুরুষের গলায় ঠেলতে চেয়েছিল আমিনাকে। সেই পুরুষের আবার আগের পক্ষের দুই সন্তানও ছিল। তা থেকে রক্ষা পেতেই আমিনার বাড়ি ছেড়ে পালানো।
'আমার মায়ের কিছু করার ছিল না। বাবাও মারা গিয়েছিল। কেউ দেখার ছিল না আমাদের'। আর সেই সুযোগে মামা বিয়ে দিয়ে দেয়। তবে শ্বশুরবাড়িতে না গিয়ে একেবারে সোজা ছুট লাগায় আমিনা। ছুটতে ছুটতে একটা ব্রিজ আসে। সেটা পার করার পরই বুঝতে পারে, বাংলাদেশে নয়, সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে এসে দাঁড়িয়েছে সে।
কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না আমিনা। সঙ্গী বলতে তখন গায়ে পরা কাপড় আর মনে একরাশ কষ্ট। তবু সেগুলিকেই মনের জোর করে হাওড়া স্টেশনে এসে উপস্থিত হয় সে। তিনদিন পরে সেখানে পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে একটি হোমে গিয়ে তুলেছে।
সারা দেশে পশ্চিমবঙ্গই পাচারে ফার্স্ট বয়
নরেন্দ্রপুরের স্বেচ্ছ্বাসেবি সংস্থা 'সংলাপ'-এর দৌলতে আমিনা আর পিঙ্কির নাম আমাদের গোচরে এল। এমন নাম না জানা, অজানা ভবিষ্যতকে সঙ্গী করে হাজারো-লাখো নাবালিকা যৌন দাসত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে।
এশিয়ার সবচেয়ে বড় রেডলাইট এলাকা যৌনপেশার আঁতুরঘর সোনাগাছিতে এসে ঠাঁই হচ্ছে হাজারো নাবালিকার। যাদের পালানোর পথ সেখানে গিয়েছে শেষ হচ্ছে। ২০১৪ সালের পরিসংখ্যানে চোখ রাখলেই দেখা যাবে সারা ভারতে মানব-পাচার বেড়েছে প্রায় ৩৮.৭ শতাংশ।
জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর এই রিপোর্টই বলে দিচ্ছে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে আপনি যদি পশ্চিমবঙ্গবাসী হন, তাহলে তা দ্বিগুণ হওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ ভারতে মানব-পাচারের মোট ঘটনার এক-পঞ্চমাংশ (২০.১ শতাংশ) হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। অর্থাৎ এরাজ্যে এমন ঘটনার সংখ্যা ১০৯৬টি। এর পাশাপাশি নাবালিকা পাচারে সারা দেশের মধ্যে ৪২ শতাংশ হয় এরাজ্য থেকে। এমন ঘটনা সংখ্যায় ৮৫০- টির কিছু কম বেশি।
কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উদাসীন মনোভাব
কেন মানব-পাচার বা যৌন দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে নাবালিকা মেয়েদের উদ্ধার করে আনা যাচ্ছে না? উত্তরটা বোধহয় স্পষ্ট, কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের গা ছাড়া মনোভাবই এর জন্য মূলত দায়ী।
২০১১ সালে কেন্দ্র এই সমস্যা ঠেকাতে সমস্যাপ্রবণ জায়গাগুলিতে ৩৩৫টি পাচার-বিরোধী কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয়। এর পাশাপাশি দশ হাজার পুলিশকে ট্রেনিং দেওয়া, বিচারক ও অন্যান্যদের এই কাজে যোগ দেওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু তাতে কোনও কাজ দেয়নি।
কারণ ২০১৬-র জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ২৭০টি এমন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। ২০১০-২০১৫ সাল পর্যন্ত এই কেন্দ্রগুলিকে প্রতি মাসে গড়ে ১ লক্ষ টাকা করে দেওয়া হয়েছে। তবে বেশিরভাগ কেন্দ্রই তার সঠিক ব্যবহার করেনি। একটি কেন্দ্র তো দশটি টেবল, কম্পিউটার ও ৩ হাজার টাকার একটি মোবাইল কিনেই টাকা খরচ করে ফেলেছে।
কেন মানব-পাচার বিরোধী কেন্দ্রগুলি ফেল করেছে
প্রতিটি রাজ্য়ে ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে এমন মানব-পাচার বিরোধী কেন্দ্র তৈরির প্রস্তাব ছিল। কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ও জাতিসংঘের ড্রাগ ও ক্রাইম বিভাগের উদ্যোগে তা তৈরির কথা হয়েছিল। তবে উপযুক্ত কর্মী, অর্থ ইত্যাদি অভাবে পরে তা মুখ থুবড়ে পড়ে বলে জানা গিয়েছে।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গে মানব-পাচার বিরোধী কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল ৪টি। যা আদতে হওয়ার কথা ১৯টি জেলা মিলিয়ে ৯টি। তবে ২০১২ সালে সেখান থেকেও একটি কমে দাঁড়ায় তিনটিতে। কেন্দ্রের অনুদানও ৩০ লক্ষ টাকা থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২২.৭০ লক্ষ টাকায়।
অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না। বাংলাদেশের সঙ্গে ২২১৭ কিলোমিটার সীমান্ত ভাগ করে নেওয়া পশ্চিমবঙ্গ নেপালের সঙ্গে ৯২ কিলোমিটার ও ভূটানের সঙ্গে ১৭৫ কিলোমিটার সীমানা ভাগ করেছে। পাচারকারীদের স্বর্গরাজ্য এমন একটি প্রদেশে আরও বেশি করে নজর দেওয়ার কথা ছিল। অথচ তা না হওয়ায় কলকাতা ও শহরতলি এলাকা একেবারে নৈরাজ্যের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছে।
NOTE : প্রতিবেদনটি IndiaSpend এ প্রকাশিত হয়েছে। লেখক হিমাদ্রী ঘোষ সাংবাদিক হিসাবে রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা ইস্যুগুলিকেই মূলত তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে সামনে তুলে আনেন।