পশ্চিমবঙ্গের ডেঙ্গু চ্যালেঞ্জ: রাজনীতি কি জনস্বাস্থ্যের পথেও অন্তরায়?
গত অগাস্ট মাসে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং জানিয়েছিলেন ডেঙ্গুর ব্যাপারে তাঁর প্রশাসনের কোমর বেঁধে নামার কথা। তার পরেও সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী: দেশের সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু-প্রভাবিত রাজ্যটির নাম হল পশ্চিমবঙ্গ। আর রাজ্যের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের মতে, রাজ্যের স্বাস্থ্য আধিকারিকরা কেন্দ্রের এই রিপোর্ট বেরোনোর পরেই মুখে তালা এঁটেছেন। অগাস্ট মাস পর্যন্ত দৈনিক হিসেবে পাওয়া যাচ্ছিল রাজ্যস্তরে কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকে তা নাকি অমিল। ফলে, পশ্চিমবঙ্গ ডেঙ্গু প্রতিরোধে আদৌ কতটা সফল হতে পারল তা ঠাহর করতে পারছে না কেউই - বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রক বা সাধারণ মানুষ।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের ওয়েবসাইটের মতে অগাস্টের শেষ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মারা যান মাত্র একজন অথচ বাস্তবের সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। কেন্দ্র জানাচ্ছে, রাজ্য থেকে নিয়মিত রিপোর্ট তাদের কাছে না পৌঁছনোর কারণেই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কলকাতা পুরসভার বিরুদ্ধে তাও অভিযোগ কম কিন্তু মহানগরীর লাগোয়া পুরসভাগুলি যে প্রায় কোনও তৎপরতায় দেখাচ্ছে না, সেটা মালুম হচ্ছে ওইসব অঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপের মাত্রা দেখে। দক্ষিণ দমদম, হাওড়া, বিধাননগর, শ্রীরামপুর ইত্যাদি অঞ্চলে এই রোগ বড় আকার ধারণ করেছে। মৃত্যুর হিসেবও উদ্বেগজনক। শুধু দক্ষিণ দমদমেই দশজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে; বেসরকারি হিসেব নাকি আরও বেশি।
তবে ডেঙ্গু-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান চেপে যাওয়ার অভিযোগের কিছুটা সত্যতা প্রকাশ পাচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে ভর্তি হওয়া রোগীর ভিড় দেখে। কলকাতা শহরের বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা জুলাই থেকে ক্রমশ বাড়ছে। এবং তাঁদের অনেকেই শহরতলি এবং জেলার বাসিন্দা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য মেতেছেন পুজোর আনন্দে। রাজনৈতিকভাবে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর সামনে কোনও চ্যালেঞ্জ এইমুহূর্তে রাজ্য রাজনীতিতে নেই ঠিকই, কিন্তু পরিকাঠামোগত দিকে দিয়ে চ্যালেঞ্জের কোনও অন্ত নেই।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ডেঙ্গু প্রশাসনের কাছে নতুন কোনও সমস্যা নয়। ২০১২ সালেও এর প্রকোপে রাজ্য সরকারকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। সেবার তো মমতা ক্ষিপ্ত হয়ে ডাক্তারদেরও একহাত নেন। বলেন, তাঁদের একাংশ যে কোনও মৃত্যু কারণ হিসেবেই ডেথ সার্টিফিকেটে ডেঙ্গু লিখে দায় সারছেন আর মানুষের মধ্যে আরও ভয় সৃষ্টি করছেন। ছাড়েননি বেসরকারি হাসপাতাল এবং নার্সিংহোমগুলিকেও। তাঁর আগের বাম জমানাতেও অবস্থা ভালো ছিল না বলে জানান।
কিন্তু এখন আর তাঁর দোষারোপ বা আগে কী হয়েছিল, সেসবের ফিরিস্তি বিশেষ কাজে আসে না। বিশেষ করে তথ্য চেপে দেওয়ার অভিযোগটি যদি সত্য প্রমাণিত হয়, তবে তা জনপ্রিয় নেত্রীর পক্ষে বেশ অস্বস্তির পরিস্থিতি তৈরি করবে। হ্যাঁ, একথা ঠিকই যে, জনসাধারণের এইসমস্ত অসুবিধার দিকগুলোতে মনোনিবেশ করার মতো সময় বা ইচ্ছে বাংলার রাজনীতি-সর্বস্ব জনপ্রতিনিধিদের নেই, কিন্তু রাজধর্ম পালন করার প্রশ্নে এগুলিও যে সমান গুরুত্বপূর্ণ সেকথা অনস্বীকার্য।
প্রশ্ন হল: রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভঙ্গুর অবস্থাটি যখন ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে পরে, তখনও কি রাজ্য এবং কেন্দ্রের মধ্যে সমন্বয় চোখে পড়ছে এই চ্যালেঞ্জ সামলানোর ব্যাপারে? রোগনির্মূল করার লক্ষ্যে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কি মমতা এবং মোদী লড়তে আগ্রহী নাকি সেখানেও 'আমরা-ওরা'-র রাজনীতিটাই বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে? একই কথা দিল্লির আপ সরকার এবং কেন্দ্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন যে বাকি সমস্ত রাজনৈতিক ঝগড়া সরিয়ে রেখে প্রথমে একসঙ্গে ডেঙ্গুর মোকাবিলা করার। বিরোধী কংগ্রেস অভিযোগ জানায় যে কেজরিওয়াল এবং মোদী সরকার ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যর্থ কারণ তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। ডেঙ্গুর মতো একটি মারাত্মক জনস্বাস্থ্য বিষয়ক ইস্যুর ক্ষেত্রেও কেন এদেশে সমন্বয়ের জন্যে তদ্বির করতে হয়? বাজেট সেটার উত্তর পাওয়া জরুরি।