বঙ্গীয় 'কমনিষ্ঠ' দাদারা, কংগ্রেস না বিজেপি পরে ভাববেন; আগে ভাবুন আপনারা 'জীবিত না মৃত'
দু'জনেই প্রায় সাইনবোর্ডে পরিণত। অতীতে দাপটের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ শাসন করা কংগ্রেস এবং সিপিএম কয়েক মাস আগে এক কিম্ভূত 'জোট' বাঁধেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্যে। কিন্তু সে তো দূরস্থান, উল্টে নির্বাচনে গো-হারা হেরে দু'পক্ষই ছিটকে পড়েন এদিক ওদিক।
রাজ্যস্তরে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সিপিএম-সহ বামফ্রন্ট; নিজের গড়েই হেরে যান গত বিধানসভার বিরোধীনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। আর জেদাজেদি করে পুরোনো 'শ্রেণীশত্রু' কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে হারার ফলে দলের মধ্যে দেখা দেয় অসন্তোষ কারণ পার্টির অন্যান্য নেতৃবৃন্দ (যেমন কেন্দ্রীয় কমিটি বা কেরল) এতে সায় দেননি প্রথম থেকেই।
কিন্তু বাংলার অশীতিপর নেতৃত্বকে বোঝাবে কে? তাঁরা কিছুতেই মানতে রাজি নন যে জোট ছাড়া কোনও ভবিষ্যৎ আছে বলে।
'হারি জিতি নাহি লাজ, জোট করাই আমাদের কাজ'
অতএব, কলকাতায় অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিকতম প্লেনামেও হল সেই একই বিতণ্ডা। সিপিএম-এর রাজ্য সম্পাদক সূর্য্যকান্ত কংগ্রেসের সঙ্গে জোট চালিয়ে যাওয়ার নীতিরই জোরালো সমর্থন করলেন। কংগ্রেস এবং বিজেপি একই ধরনের দল নয় যে তাদের সঙ্গে সমদূরত্ব রাখতে হলে বলে তাঁর মতামত। কিন্তু এব্যাপারে কিন্তু সূর্য্যবাবু ফাঁকা মাঠ পাননি। রাজ্যের নিম্নস্তর থেকে উঠে এসেছে ভিন্ন মত।
বর্তমান নীতি নিয়ে চললে পার্টির ভবিষ্যৎ যথেষ্ট বিপদে পড়তে পারে বলেও অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এমনকী, রাজ্যস্তরের নেতারা নিজেদের পছন্দের লোককে দলের নানা পদে বসিয়ে দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। সব মিলিয়ে, রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর পাঁচ বছরের মধ্যে সিপিএম-এর এখন রীতিমতো অস্তিত্ত্বের সঙ্কট।
কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই ঘোর দুর্দিনেও পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন শীর্ষ নেতা কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের রাস্তা ছাড়তে রাজি নন; এমনকী, মাস ছয়েক আগে খাওয়া নাকানিচোবানি পরও। কী করতে চাইছেন এই নেতারা?
মমতার মোকাবিলা কার্যত অসম্ভব বুঝে এই নেতারা এখন লুকোতে চাইছেন
আসলে লুকোতে চাইছেন। এঁরা ভালো করেই জানেন যে মমতা নয়, চৌত্রিশ বছরের একপেশে ক্ষমতাই ওঁদের বারোটা বাজিয়েছেন। এতদিন একটানা রাজত্ব করে যে জং এনাদের মানসিকতায় পড়েছে, তা এত সহজে যাওয়ার নয়। চেয়ারে বসে থেকে চেয়ারম্যানবাবুরা (সত্যিই, রেজিমেন্টেড পার্টিতে পদের বাহার দেখলে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না ) পরবর্তী নেতৃত্ব তৈরী করার কোনও ন্যূনতম আগ্রহ কোনওদিন দেখাননি (প্রমোদ দাশগুপ্তের থেকে কেউ শিখলেন না)। আর যখন ঠেকায় পড়ে নির্বাচনের মুখে রাতারাতি নেতা তৈরী করতে যাকে-তাকে 'তরুণ তুর্কি' বলে ময়দানে নামিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন, পুরো ব্যাপারটাই হাস্যকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
'তরুণ তুর্কি'রা একদিনে তৈরি হয় না
বামপন্থী নেতা হওয়া একদিনের কাজ নয়, তার জন্যে একটা বিবর্তন প্রয়োজন। মরণকালে হরিনাম করে আর যাই করা যাক, রাজনীতিতে বিশ্বাসযোগ্যতা জেতা যায় না। তবে, নতুন নেতৃত্ব তৈরী করার এই অনীহা বোধহয় মূর্খের স্বর্গবাসের কারণে তৈরী হয়েছিল। "কে আর আমাদের হারাবে," জাতীয় বেপরোয়া চিন্তাভাবনা যে ব্যুমেরাং হয়ে ফিরেছে, তা বুদ্ধ-সূর্য্য-বিমান সব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
কংগ্রেস না বিজেপি? আগে ভাবুন আপনারা ভারতীয় রাজনীতিতে জীবিত না মৃত
এক দশক আগেও সিপিএম-এর মুখে 'বিজেপি না কংগ্রেস' বিতর্ক প্রাসঙ্গিক মনে হত। এখন ওনাদের মুখে এই প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হলে মস্করা মনে হয়। তার প্রথম কারণ, বিজেপি আর বামেদের পরিস্থিতি এখন সূর্য আর চন্দ্রের মতো ভিন্ন।
বিজেপি যেখানে কংগ্রেসকে হটিয়ে একের পর এক রাজ্যে ক্ষমতাবিস্তার করছে, বামেরা সেখানে পিছু হটতে হটতে প্রায় বিলুপ্তির পথে। করলে তাঁরা ক্ষমতায় ফিরলেও ভবিষ্যতে দক্ষিণের ওই রাজ্যটিতে বিজেপির উত্থানের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আর ত্রিপুরাতে তৃণমূল প্রবেশ করার ফলে সেখানে বামেরা নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন বলে অনেকেরই ধারণা। অতএব, কংগ্রেস না বিজেপি তক্কে না গিয়ে এখন সিপিএম-এর বঙ্গীয় নেতৃত্বের ভাবা উচিত ওনারা জীবিত না মৃত।
মমতাকে হারানো যে এ জীবনে খোয়াবই থেকে যাবে, তা বুঝে গেছে পার্টির সব স্তরের নেতৃত্বই। ক্ষমতায় থেকে মমতাকে সামলানো আর ক্ষমতা হারিয়ে তাঁকে টলানো যে এক জিনিস নয়, তা বুঝে গিয়েছে আলিমুদ্দিন। আর তৃণমূল নেত্রীকে হারানোর জন্যে যে জনভিত্তি চাই, কে তা নতুন করে তৈরী করবে? ওই কিছু শহুরে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে জ্ঞান দেওয়া নেতা?
এক কাজ করুন না, পার্টিটাকে তুলে দিয়ে কংগ্রেসে যোগ দিয়ে ফেলুন
বঙ্গীয় রাজনীতিতে এ এক স্টেলমেট অবস্থা যা ঠিক ছিল বামেদের দীর্ঘ রাজত্বের সময়েও। কিন্তু নিচুস্তরের ভাবনাচিন্তা না বুঝে বাম নেতাদের এই চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতি দেখে সত্যি চমৎকৃত হতে হয়। এ বিশ্বাসভঞ্জনের জন্যে পুরনো বৈরী -- সিপিএম এবং কংগ্রেস -- দুই দলকেই মাসুল চোকাতে হচ্ছে নির্বাচনের পর আর মজা দেখছে তৃণমূল। যদি এই অধুনা সিপিএম নেতৃত্বের বিরোধিতার রাজনীতি হয়, তবে পার্টিটা উঠিয়ে দিয়ে সবাই কংগ্রেসে যোগ দিলেই তো পারেন। ইতিহাসে তো কত কীর্তিই স্থাপন করেছেন আপনারা। আরও একটা না হয় করবেন।