পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি নেহাতই ইঞ্জিনবিহীন রেলগাড়ি, তাতে করে গন্তব্যে পৌঁছনো সম্ভব নয়
মমতা আমাদের ভয় পেয়েছেন বলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি নিজেদের সংগঠনকে চাঙ্গা করতেই পারে কিন্তু নির্বাচনের ময়দানে রাতারাতি পরিবর্তন আনা সহজ ব্যাপার নয়
পশ্চিমবঙ্গে ভালো কিছু করে দেখতে উঠে পড়ে লেগেছে বিজেপি৷ রাজ্যে মমতা-বিরোধী রাজনীতির জায়গাটি যত ফাঁকা হচ্ছে দিন দিন, ততই উজ্জীবিত দেখাচ্ছে গেরুয়া শিবিরকে৷
সম্প্রতি বিজেপি যুব মোর্চার বীরভূম জেলা সম্মেলনে রাজ্য বিজেপি সভাপতি এবং বিধায়ক দিলীপ ঘোষ সমর্থকদের আরও একবার মনে করিয়ে দিলেন যে আসন্ন তিনটি উপনির্বাচন থেকে শুরু করে পরের পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলের অবস্থান ক্রমে শক্তিশালী করে তোলাই তাঁর লক্ষ্য৷ এইভাবে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের ৪২টি আসনের অর্ধেকের বেশিতে এবং শেষমেশ ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে শেষ কামড় দেওয়ার লক্ষ্যে এগোবে বিজেপি নেতৃত্ব৷
দিলীপবাবুর এই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অন্যতম বড় প্রেরণা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং৷ যেভাবে তৃণমূল নেত্রী বিভিন্ন সময়ে তাঁর দলকে বিজেপির মোকাবিলায় আরও আঁটঘাঁট বেঁধে নামার নির্দেশ দিয়েছেন এবং জাতীয় পর্যায়ে বিজেপিকে ঠেকানোর জন্য ফ্রন্ট গড়ার ডাক দিয়েছেন, তাতেই বেজায় উৎসাহিত রাজ্য বিজেপি নেতারা৷
তাঁদের মতে, মমতা ভয় পাচ্ছেন এবং তাঁদের দলকে সমীহ করতে শুরু করেছেন যেটা আগামী দিনের পক্ষে ইতিবাচক সংকেত৷ রাজ্যের পুরোনো শক্তি বাম এবং কংগ্রেস-এর মুখ থুবড়ে পড়াতেও বিজেপি নিজেদের কলেবরবৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখছেন৷
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ১৭ শতাংশ ভোট পেয়ে এবং এবছর বিধানসভা নির্বাচনে তিনটি আসন জেতার পরে বিজেপির এই ইতিবাচক মনোভাব হওয়াটা স্বাভাবিক৷ কিনতু, রাজনীতি সবসময়ে গাণিতিক হিসেবে যেহেতু চলে না, তাই বিজেপির আত্মসমীক্ষারও প্রয়োজন রয়েছে৷
২০১৯-এ কিন্তু মোদী হওয়াও ২০১৪-র মতো ঝোড়ো গতিতে বইবে না
দিলীপ ঘোষ-রূপা গঙ্গোপাধ্যায়- রাহুল সিংহদের বোঝা আশু প্রয়োজন যে দলের সংগঠন না থাকলেও হয়তো চলে যাবে, কিনতু মুখ তৈরি করা চাই-ই চাই৷ সর্বোচ্চ নেতা নরেন্দ্র মোদীকে ভাঙিয়ে যে রাজ্য রাজনীতিতে বেশিদিন কল্কে পাওয়া যায় না, তা ভোট শতাংশের হার ২০১৪-র ১৭ থেকে ২০১৬-র ১০-এ নেমে যাওয়ার মধ্যেই প্রমাণিত৷ আর মনে রাখতে হবে, ২০১৯-এ স্বয়ং মোদী সাহেবকেও প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার মোকাবিলা করতে হবে৷ তাই তাঁর মুখোশ পরে রাস্তায় ঘুরলেই যে ভোট উড়ে উড়ে আসবে বিজেপির ঝুলিতে ২০১৪-র মতো, তা আশা করা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়৷
মমতা যদ্দিন সক্রিয় রাজনীতিতে রয়েছেন, বিজেপির আশা প্রায় নেই বললেই চলে
আর দিলীপবাবু যে বলছেন মমতা ভয় পেয়েছেন এবং তাতে তাঁরা আশাবাদী নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে, তাতেও বোধহয় বোঝার ভুলচুক থেকে যাচ্ছে৷ মমতার এই "ভয় পাওয়া" কৌশলগত ভয় ছাড়া কিছু নয়৷
সারদা-নারদ কাণ্ডের পরেও যখন ওনার বিশেষ ক্ষতি হয়নি, তখন বিজেপির ইঞ্জিনহীন রেলগাড়িতেও ওনার চাপা পড়ার ভয় বিশেষ নেই৷
অন্তত যতদিন মমতা সক্রিয় রাজনীতিতে আছেন (শারীরিকভাবে ষাটোর্ধ নেত্রী এখনও যা কর্মঠ তাতে উনি পাঁচ বছরের মধ্যে মুটিয়ে যাবেন বলে মনে হয় না), ততদিন পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির করণীয় কিছু নেই৷
দিলীপবাবুদের লক্ষ্য রাজ্য রাজনীতিতে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা৷ সে পর্যন্ত ঠিকই আছে কিনতু এক নম্বর স্থানে উঠে আসতে গেলে যে লড়াই তাঁদের করতে হবে, তা করতে গেলে প্রয়োজন সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য নেতা বা নেত্রী৷ বা সোজা কথায়, মমতার খাঁটি বিকল্প৷ এবং সেরকম নেতৃত্ব টেলিভিশনের শিল্পীরা দিতে পারবেন না৷
মনে রাখা দরকার যে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলেও এখন প্রচুর শিল্পী সাংসদ এবং বিধায়ক রয়েছেন কিনতু তাঁরা সবাই মমতার জোরেই জিতেছেন৷ বিজেপির পক্ষে এক বাবুল সুপ্রিয় রয়েছেন সেলিব্রিটি রাজনীতিবিদ হিসেবে এবং তিনিও জেতেন মোদী হওয়াতে ভর করেই৷
সাধারণ মানুষ আগে মুখ দেখতে চায়
পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির এটা বোঝা জরুরি যে সে রাজ্যের সাধারণ মানুষ বাকি দেশের মতোই নেতৃত্বের মুখ দেখতে আগ্রহী৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন এই মুহূর্তে রাজ্যের রাজ্যের সর্বোচ্চ নেত্রী এবং মুখ বা মোদী দেশের, তেমনি রাজ্য বিজেপিরও চাই একটি মুখ৷
অবশ্য সেই মুখ কোনও সেলিব্রিটি বা উচ্চ পদাসীন নেতা হলেই যথেষ্ট নয়৷ মানুষের মধ্যে ঢুকে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হবে মমতার উচ্চতায় পৌঁছে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে৷ কয়েক দশক ধরে তৃণমূল নেত্রী যে পরিশ্রম এবং অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আজ মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, তাঁকে তুড়ি মেরে পাঁচ বছরের মধ্যে গদিচ্যুত করা সহজ ব্যাপার নয়৷ এমন দিবাস্বপ্ন দিলীপ ঘোষরা না হয় নাই দেখলেন৷
দিলীপ ঘোষরা কি দেখতে পাচ্ছেন না খোদ মোদীর রাজ্যে বিজেপির অবস্থা?
আর তাছাড়া, রাজনীতিতে মুখ না থাকলে অবস্থা যে নিমেষে প্রতিকূল হয়ে যেতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ তো খোদ মোদির রাজ্য গুজরাতেই দেখা যাচ্ছে৷ মোদী গান্ধীনগর ছাড়ার পরেই গেরুয়া দলের কালঘাম ছুটতে শুরু করেছে নিজদের ওই দূর্গকে রক্ষা করতে৷
বিরোধী কংগ্রেস যে দারুন কিছু করেছে তা নয় কিনতু তাও মোদীর উত্তরসূরিরা রাজ্য চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন৷ এমনকী, সামনের বছর যে বিজেপি একটানা প্রায় দুই দশক রাজত্ব করা গুজরাতে যে ক্ষমতায় ফিরবেই, তা হলফ করে বলতে পারছে না তার অতি বড় সমর্থকও৷
অতএব, শক্তিশালী স্থানীয় নেতৃত্ব ছাড়া রাজ্যস্তরে জেতা প্রায় অসম্ভব
বিজেপির যে শক্তিবৃদ্ধি হচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গে তা নয় কিনতু তা প্রধানত বাম এবং কংগ্রেস-এর পতনের ফলে৷ উত্তরবঙ্গের সীমান্ত অঞ্চলে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে বিজেপি হয়তো জনপ্রিয়তা পেতে পারে বা প্রতিবেশী বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যকলাপ বৃদ্ধির ফলে বা মমতা সরকারের 'সংখ্যালঘু তোষণ'-এর ফলে হয়তো বিজেপির নৈতিক অবস্থান শক্ত হতে পারে কিনতু ওই পর্যন্তই৷ বিজেপির পক্ষে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার প্রশ্ন এখনও আলোকবর্ষ দূরে৷ পাঁচ বছরে সেই দূরত্ব পাড়ি দেওয়া কতটা সম্ভব, তা বোধকরি দিলীপ ঘোষ এবং তাঁর দল আঁচ করলেও স্বীকার করতে চাইছে না৷