কূটনীতির খাতিরেই পাকিস্তান ছাতাটা মাসুদ আজহারের মাথা থেকে সরিয়ে নিজের মাথায় ধরল
অবশেষে জয়েশ-ই-মহম্মদ (জেইএম) সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের হোতা মৌলানা মাসুদ আজহারকে 'আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী' তকমা দেওয়ার পথ থেকে সরে দাঁড়াল চিন। ভারতের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জে এই নিয়ে অনেকবার তদ্বির করা হলেও প্রতিবারই চিনের 'ভিটো' ক্ষমতার প্রয়োগে ব্যাপারটা আটকে যাচ্ছিল। বেইজিং চার-চার বার রাষ্ট্রপুঞ্জের সিকিওরিটি কাউন্সিলে তার ভিটো প্রয়োগে আটকে দেয় আজহারকে এই তকমা দেওয়ার উদ্যোগ। সেই নিয়ে ভারতে নিন্দার ঝড় উঠলেও চিন ভাবলেশহীন থেকেছে। উল্টে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছে।
তার পরেও আচমকা এই নাটকীয় মোড় দেখে ভারতের মানুষ চমৎকৃত। লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন এই ঘটনা ঘটার দরুন উল্লসিত শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টির নেতারাও। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীই যে এই কূটনৈতিক জয়ের প্রধান কারিগর, তা তাঁরা বারবার করে দাবি করছেন। নির্বাচনের মধ্যে এই ঘটনা ঘটার কারণে স্বাভাবিকভাবেই শাসকরা আরও আত্মবিশ্বাসী জয় নিয়ে।

চিনের ভারতপ্রেম বেড়ে গিয়েছে আচমকা, এটা ভাবা ঠিক হবে না
তবে আজহারের উপরে চিনের এই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়ার পিছনে যে অনেক গূঢ় কারণ রয়েছে, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
প্রথমত, চিন ভারত ও পশ্চিমি দুনিয়ার চাপে নতিস্বীকার করেছে বললেও এই সমস্ত বিষয়টিতে পাকিস্তানের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না কারণ আজহারের ব্যাপারে প্রথমে আসে তাদেরই প্রসঙ্গ। আজহারকে আন্তর্জাতিক দরবারে 'সন্ত্রাসবাদী' চিহ্নিত হতে দিয়ে কি পাকিস্তান ও তার দোসর চিন কোনও বিশেষ পরিকল্পনামাফিক খেলল?

চিন কিন্তু এখনও পাকিস্তানকে যথেষ্ট সমর্থন করছে
সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একথা ভুলে চলবে না যে আজহারকে রাষ্ট্রপুঞ্জে 'আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী' আখ্যা দেওয়া হলেও চিন কিন্তু তাদের পাকিস্তানকে সমর্থ করার নীতি থেকে একচুলও সরে আসেনি। বেইজিং ভবিষ্যতেও পাকিস্তানের 'সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই'-এর পিছনে থাকবে বলে খোলাখুলি জানিয়েছে চিনের বিদেশমন্ত্রক।
অতএব, রাতারাতি যে চিন-পাকিস্তান অক্ষ ভারতবন্ধু হয়ে পড়েছে, সেটা না ভাবাই ভালো। বরং, এটা ভাবা বরং ভালো যে পাকিস্তান এখন নিজের ভাবমূর্তি ফেরাতে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কয়েকদিন আগেই সেদেশের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান চিনে যান বেল্ট এন্ড রোড ফোরাম-এর সম্মেলনে যোগ দিতে। সেখানে তাঁর চিনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং-এর সঙ্গে আলোচনা হয়। আজহারের কথা যে সেখানে উচ্চারিত হয়নি তা কেউই ধরতে চাইবে না কারণ এই বিষয়টিতে ইসলামাবাদ ও বেইজিং যে পরিকল্পনামাফিক এগিয়েছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। আর তারপরেই এই বড় ঘটনা ঘটার ফলে ধরে নেওয়াই যায় যে জেইএম-এর হোতার ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েই গিয়েছিল।
[আরও পড়ুন: মাসুদকে গোপন ডেরায় লুকিয়ে ফেলছে পাকিস্তান! জঙ্গি নেতা এখন কোথায় ]

আজহারের থেকে সমর্থন সরিয়ে পাকিস্তান বার্তা দিল বিশ্বকে
আজহারের ব্যাপারে যদি পাকিস্তান নরম হয় তার অন্যতম কারণ তাদের নিজেদের দেশের চলতি অস্থিরতা। পাকিস্তানের আইএসপিআর-এর কর্তা মেজর জেনারেল আসিফ গফুর কিছুদিন আগেই সেখানে পশতুন তাহাফুজ আন্দোলনের (পিটিএম) প্রেক্ষিতে কড়া সাবধানবাণী দিয়ে বলেছেন পাকিস্তানের মাটিতে কোনওরকম চরমপন্থী কাজকর্ম বরদাস্ত করা হবে না। পশতুন তাহাফুজ আন্দোলনের মাথারা ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা 'র'-এর থেকেও আর্থিক ও অন্যান্য নানা সাহায্য পাচ্ছে বলেও অভিযোগ তোলেন গফুর। পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও যে সন্ত্রাসবাদীরা এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সে দেশের ইসলামিক সমাজব্যবস্থার মধ্যে সন্ত্রাসের শুঁড়গুলি এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছে যে পাকিস্তানের দন্ডমুন্ডরা জানেন যে মুখে ভারতের বাপান্ত করলেও এই সমস্যাগুলির মোকাবিলা করা আসলে কতটা শক্ত। আর তার উপরে আন্তর্জাতিক মহলের চাপ তো রয়েছেই।
এই অবস্থায় ইসলামাবাদের মনে হয়েছে আজহারের মাথায় ধরে থাকা ছাতাটা সরিয়ে নিজের মাথায় ধরলে বিশ্বের সামনে একটা ভাবমূর্তি শোধরানোর ভালো সুযোগ পাওয়া যাবে আর সেটাই তারা চিনের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করেছে। এখন আজহারের পিছন থেকে সমর্থন সরিয়ে নিয়ে পাকিস্তান এবারে অপেক্ষা করবে তাদের মাটিতেও উগ্রপন্থাকে সমর্থন জোগানো বিদেশি শক্তিগুলিকে পাল্টা অভিযুক্ত করে আন্তর্জাতিক দরবারের সাহায্য আদায় করতে। আর পাকিস্তানের দাবিমতো ভারত যেহেতু সেই শক্তিগুলির একটি, তাই নয়াদিল্লিকেও প্রস্তুত থাকতে হবে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের তরফ থেকে আরও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে।
খেলা জমে উঠছে ক্রমশই।
[আরও পড়ুন:২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফের মাওবাদী হামলা! গড়চিরৌলি, গয়ার পর সুকমায় মৃত ২]