তৃণমূল কোনওদিনই সংগঠন-নির্ভর দল নয়, তাই বেনোজলের তোড়ে তার ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা কম
বিরোধী শিবির থেকে হুড়মুড়িয়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার রেওয়াজে কোনও খামতি দেখা যাচ্ছে না। এমনকী, মুর্শিদাবাদ বা নদীয়ার মতো কংগ্রেসের দূর্গগুলিতেও দেখা দিয়েছে অভূতপূর্ব ভাঙ্গন। পাহাড়েও গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার ভিত্তিতে বড়সড় ফাটল ধরিয়েছে শাসক দল।
প্রশ্ন উঠছে, এই যে এত দলছুটদের ভিড় জমছে দলে, এতে আখেরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষতি হবে না তো? কারণ বহিরাগতদের উপস্থিতিতে দলের কাডারদের অসন্তোষ বাড়তে পারে; যা গত নির্বাচনের দুর্দান্ত ফলাফলের পরেও নাড়িয়ে দিতে পারে তৃণমূলের সংগঠন।
"খারাপ অভিসন্ধি নেই"
দলের যুব নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এতে খারাপ কিছু দেখছেন না। তাঁর মতে, এর পিছনে শাসকদলের কোনও সংকীর্ণ স্বার্থ কাজ করছে না। আর যদি কেউ দলে আসতে চায়, তবে তাকে নিষেধ করা হবে কীভাবে? স্বয়ং দলনেত্রীরও এব্যাপারে কোনও আপত্তি না থাকাতে দলের অন্দরমহলে এই নিয়ে আর কোনও ওজর আপত্তি কেউ তুলছেন না। কিন্তু, তাই বলে অজানা আশঙ্কা যে নেই তা বলা যাবে না।
মেকি বিরোধী বানিয়ে রাখার মতো নেত্রী মমতা নন
কলকাতার এক প্রথম সারির দৈনিকের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, তৃণমূলের এক অভিজ্ঞ নেতা বলেছেন যে কোনও দলই, তা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, কখনও পুরো ভোট একার ঝুলিতে আনতে পারে না। তাকে একটা মেকি বিরোধী বানিয়ে রাখতে হয়, যেমন বামফ্রন্ট রেখেছিল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মেকি বিরোধী বলতে তিনি কাকে বোঝাতে চাইছেন? কংগ্রেস না মমতা (দল মানে তো তিনিই)? যদি কংগ্রেসকে বোঝাতে চান, তবে হ্যাঁ। কথাটা কিছুটা হলেও সত্যি। প্রবল বাম শাসনেও কংগ্রেসের দূর্গ অটুটই থেকেছে। উত্তরে জিএনএলএফ পাহাড়ে প্রভাবশালী থেকেছে।
কলকাতা-সহ বাকি রাজ্যে ছড়ি ঘুরিয়েছে বামেরা। কিন্তু মমতাকে কতটা মেকি বিরোধী বানিয়ে রাখতে পেরেছেন বাম নেতৃত্ব? কংগ্রেসের মেকি বিরোধিতার বিরোধিতা করেই তিনি সে-দল থেকে বেরিয়ে এসে তৈরী করেন তৃণমূল কংগ্রেস এবং খুব শিগিরিই তাকে করে তোলেন রাজ্যের প্রধান বিরোধী শক্তি।
বেনোজল ঢুকে জ্যোতি-পরবর্তী বামেরা ডুবেছিল কারণ তাঁদের পার্টি ছিল সংগঠন নির্ভর
মমতার দল যখন রাজ্যে বড় শক্তি হিসেবে ডানা মেলতে শুরু করে, তদ্দিনে জ্যোতি বসু পশ্চিমে হেলে পড়েছেন। বঙ্গের সরকার তখন পুরোপুরি দলের কর্তৃত্বাধীন। জ্যোতিবাবুর উত্তরসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আলিমুদ্দিনের প্রভাবের জেরেই দু'টি নির্বাচন (২০০১ এবং ২০০৬) দাপটের সঙ্গে জেতেন কিন্তু অনিল বিশ্বাস এবং সুভাষ চক্রবর্তী এবং তারপরে জ্যোতি বসুর মৃত্যুর পর বামেদের সেই দলীয় দাপটও ক্ষীণ হয়ে আসে।
মেকি বিরোধী বানিয়ে রাখার জন্যে যে বলশালী নেতৃত্ব প্রয়োজন, তা জ্যোতিবাবু-পরবর্তী যুগে বামেদের ছিল না এবং ২০০৬-০৭- এর সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম বৃত্তান্তের সময়ই তা প্রমাণিত হয়ে যায়।
আর তাছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির মৌলিক পাঠ হচ্ছে সিপিএম-বিরোধিতা করা। তিনি আপোস করেন বলে কোনওদিন শোনা যায়নি -- তা রাজীব গান্ধী-পরবর্তী কংগ্রেস-এর সঙ্গেই হোক বা বামফ্রন্টের সঙ্গে। সুতরাং, আজ যে তিনি বিরোধীদের জন্যে কোনও জায়গা ছাড়বেন না, তা অনুমান করতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না।
তবে কি তৃণমূলের অন্দরমহলের আশঙ্কা অমূলক? আশঙ্কাটি যে ঠিক অমূলক তা বলা চলে না, অতীতে বেনোজলে ঢুকে এইভাবেই বামেদের ঘর ভেঙেছে। কিন্তু এর মধ্যে একটি শর্ত রয়েছে। আর তা হল নেতৃত্বের আবেদন। জ্যোতি বসু-পরবর্তী বামেদের যেটা নেই।
বামেরা যখন ক্ষমতায় ছিল, বিকল্প নেত্রী হিসেবে মমতা সেই সময়ে তাঁর কেন্দ্রীয় (রেল) মন্ত্রীত্বকে কাজে লাগাতেন নিজের জনপ্রিয়তাবাদী ভিত্তিকে জোরদার করতে। সঙ্গে ছিল তাঁর স্বচ্ছ ও সাধারণ ভাবমূর্তি। তাই, আজকে তৃণমূলে বেনোজলে ঢুকছে বলেই যে দলের মধ্যে কোন্দল শুরু হয়ে যাবে তার সম্ভাবনা বেশ কম কারণ যাঁরা তাতে অসন্তুষ্ট হবেন, তাঁদের সামনে আর কোনও বিকল্প নেই আজকে।
আরাবুল ইসলামের ক্ষেত্রে আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি। বিতাড়িত সিপিএম নেতা আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা, যিনি একসময়ে মমতাকে নানাভাবে আক্রমণ করেও ভোটের ঠিক আগে তৃণমূলে যোগদান করে আরাবুলকে 'বঞ্চিত' করেন। কিন্তু তাতেও আরাবুল কদ্দুর কী করতে পারলেন?
উত্তরে কমল গুহর পুত্র উদয়ন রাজনীতিশিবির বদল করে জিতলেন ভোটে। দলছুট হলেই যে ভোটে দাঁড়ানোর নৈতিক অধিকার খুইয়েছেন এবং তিনি অবধারিতভাবে হারবেন, এমন ভাবনার কোনওই কারণ নেই রাজনীতিতে। কারণ ভারতের মানুষ ব্যালট দান করেন ব্যক্তিকে -- তা সে অতীতে ইন্দিরা গান্ধীই হন বা বর্তমান সময়ে নরেন্দ্র মোদী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাকি কে কী করল, কোন দলের হয়ে দাঁড়াল, তা গৌণ।
যদ্দিন মমতা রয়েছেন আর তৃণমূল জিতছে, দলের 'বহিরাগত-সম্পর্কিত' সমস্যা প্রায় নেই বললেই চলে
অন্তত তৃণমূল যতদিন নির্বাচনী লড়াইতে জিতবে, এই বেনোজলের তত্ত্ব বাস্তবে খাতার সম্ভাবনা কম। আর তৃণমূলকে অদূর ভবিষ্যতে হারানোর মতো শক্তি অন্তত এই মুহূর্তে বঙ্গীয় রাজনীতিতে নেই। বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস এখন অশীতিপর বৃদ্ধ আর বিজেপি নেহাতই নাবালক।
হ্যাঁ, হুমায়ুন কবীর, কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী বা অজয় দে'র মতো দলছুটরা সাম্প্রতিককালে হেরেছেনও বটে কিন্তু এঁরা যেসব জেলাতে হেরেছেন, তৃণমূল কিন্তু সেসব অঞ্চলে প্রথম থেকে যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। প্রার্থীচয়নে দলের ত্রুটি ছিল অবশ্যই। ছিল কোন্দলও।
কিন্তু তার অর্থ তৃণমূল রাতারাতি 'ইমপ্লোশন'-এর মুখে পড়বে ক্ষয়িষ্ণু বামেদের মতো, তা ভাবার কোনও কারণ নেই। ওই দলটি কোনওদিনই সংগঠনের জোরে জেতেনি, জিতেছে একজন ব্যক্তির জনভিত্তির জোরে। আর বিরোধীদের দাবিমতো দলছুটদের হটিয়ে সেই সমস্ত কেন্দ্রে উপনির্বাচন ডাকার নৈতিক কোনও দায় তৃণমূল নেত্রীর উপর বর্তায়নি। ওসব নীতির কথা, বাস্তববাদী রাজনীতিতে বিশেষ মানা হয় না।