বিদেশিনী থেকে ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য!এক অবিশ্বাস্য 'পদচিহ্ন' রেখে অবসরে সনিয়া
ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন সনিয়া। আতঙ্কে বাড়ির বাইরে বের হতে চাইতেন না। কাউকে বিশ্বাস করাটাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু, হাল ছাড়েননি। সে সময় তাঁর পাশে সারাক্ষণ ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বস্ত সহচর অম্বিকা সোনি।
সনিয়া গান্ধী। নামটা এখন আম ভারতীয়র কাছেই পরিচিত। কারণ, তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়। অথচ, একটা সময় এই পরিচয়টাই যেন গলার কাঁটা হয়ে বিঁধেছিল তাঁর গলায়। একদিকে বিরোধী রাজনৈতিকগুলির রোষ অপরদিকে নিজের কংগ্রেস দলের মধ্যেই চোরা-গোপ্তা আক্রমণ। কী করবেন বুঝে পেতেন না সনিয়া। সবসবময় যেন আতঙ্ক তাঁকে গ্রাস করে রাখত। চোখের সামনে দেখেছেন শাশুড়ি ইন্দিরার মর্মান্তিক পরিণতি। আর শাশুড়ি ইন্দিরাবিহীন গান্ধী পরিবারটাকে যখন সবে সামলানোর জায়গায় নিয়ে এসেছেন ঠিক তখনই রাজীবের হত্যা। আকাশ ভেঙে পড়েছিল যেন সনিয়ার মাথায়। কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছিল ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ইতালি ফিরে যেতে অথবা বিদেশে কোথাও বাস করতে।
ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন সনিয়া। আতঙ্কে বাড়ির বাইরে বের হতে চাইতেন না। কাউকে বিশ্বাস করাটাই কঠিন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু, হাল ছাড়েননি। সে সময় তাঁর পাশে সারাক্ষণ ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বস্ত সহচর অম্বিকা সোনি। ছিলেন আহমেদ প্যাটেল। তারাই সারাক্ষণ আগলে রাখতেন সনিয়া ও তাঁর ছেলে-মেয়েদের।
১৯৯৬ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত কংগ্রেস
তৎকালীন কংগ্রস সভাপতি সীতারাম কেশরীর বিরুদ্ধে তখন বিষেদ্বাগার ঝরে পড়ছে। মাধরাও সিন্ধিয়া থেকে পি চিদম্বরম, অর্জুন সিং, রাজেশ পাইলট, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা প্রকাশ্যেই তুলোধনা করছেন সীতারামকে। খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাওয়ার পরিস্থিতি কংগ্রেসের। সংকট মোচনে মাধবরাওরা শরণাপন্ন হলেন 'ম্যাডাম' সনিয়ার। কিন্তু, রাজনীতির অলিন্দে পা বাড়াতে মোটেও রাজি নন 'ম্যাডাম'। অনেক আকুতির পর শীর্ষস্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন সনিয়া। কংগ্রেসের মাহাত্ম এবং মানুষের প্রতি কর্তব্যকে স্মরণ করিয়ে তখনকার মতো প্রশমিত করলেন সেই গৃহযুদ্ধ।
১৯৯৭ কলকাতায় এলেন সনিয়া
গান্ধী পরিবারের সঙ্গে এই শহরের বরাবরই একটা গভীর যোগ। রাজীবের পর গান্ধী পরিবারের প্রতিনিধি হিসাবে সনিয়ার রাজনৈতিক অভিষেকের সাক্ষী থেকেছিল এই শহর কলকাতা। ১৯৯৭ সালে হওয়া কলকাতা প্লেনারি সেশনে সরকারিভাবে কংগ্রেস দলে নাম লেখালেন সনিয়া।
১৯৯৮-এর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ
কংগ্রেস দলের প্রাথমিক সদস্যপদ পাওয়ার মাত্র ৬২ দিনের মাথায় দলের নেত্রী হয়েছিলেন সনিয়া। কিন্তু, শরদ পাওয়ার থেকে শুরু করে পি এ সাংমা, তারিক আনোয়ারদের মতো শীর্ষস্থানীয় তৎকালীন কংগ্রেস নেতারা এর বিরোধিতা করেন। সনিয়ার বিদেশিনী পরিচয়কে তুলে ধরে কংগ্রেসের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠাকেও চ্যালেঞ্জ জানান শরদ, তারিক এবং সাংমারা। পরিণামে এই তিন বিদ্রোহী নেতাকেই কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত করা হয়।
বিদেশিনী বিতর্ক
সনিয়া-র বিদেশিনী হওয়ার প্রথম আক্রমণটা এসেছিল কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই। দলেরই এক শ্রেণীর নেতার কাছ থেকে এমনভাবে আক্রমণ ধেয়ে আসবে তা কল্পনাতেও আনতে পারেননি সনিয়া। কারণ, গান্ধী পরিবারের বউ হয়ে যখন দিল্লিতে পা রেখেছিলেন সনিয়া তখনও তিনি ছিলেন ভীত-সন্ত্রস্ত। কারণ, তাঁর চলন-বলন থেকে কথা-বার্তা ঝরে পড়ত বিদেশিনীর বৈশিষ্ট্য। কিন্তু, সে সব পেরিয়ে এখন এক্কেবারেই ভারতীয় গৃহবধূ তিনি। তিনি ইচ্ছে করলেই রাজীবের হত্যার পর ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ইতালি ফিরে যেতে পারতেন। কিন্তু, তা তো করেননি। মুখ থুবড়ে পড়া গান্ধী পরিবারের হাল ধরেছেন। এমনকী, অস্তিত্ব সংকটে পড়া কংগ্রেসকে ফের ঐক্যবদ্ধ করছেন। তাহলে? দিনরাত তাঁর এই বিদেশিনী তকমা নিয়ে মনকষ্টে ভুগতে শুরু করেছিলেন সনিয়া। মানসিক হতাশাতেও ভুগতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু, হাল ছাড়েননি। একটা সময় শাশুড়ির শেখানো বিভিন্ন কথাকে স্মরণ করে জাতীয় রাজনীতিতে নিজেকে টিকিয়ে রাখার কৌশলটা রপ্ত করার চেষ্টা করছিলেন।
বিজেপি নেতাদের আক্রমণ
এই সময় বিদেশিনী বিতর্কে তাঁকে সবচেয়ে বেশি আক্রমণ শুরু করেছিল বিজেপি। যে কোনও সভায় সনিয়ার বিদেশিনী হওয়াকে আক্রমণ করাটাই ছিল বিজেপি নেতাদের কৌশল। মুরলি মনোহর যোশী থেকে শুরু করে যশবন্ত সিনহা, লালকৃষ্ণ আডবাণী সনিয়ার বিদেশিনী হওয়াকে নিশানা করতে কেউ সুযোগ ছাড়েননি। শেষমেশ অটলবিহারী বাজপেয়ীর নির্দেশে বিদেশিনী লাইন থেকে পিছু হঠতে বাধ্য হয় বিজেপি।
১৯৯৯- এ নির্বাচনে প্রথম প্রার্থী
রাজনীতিতে পা দিয়ে সনিয়া বুঝেছিলেন শুধু বিরোধী দল নয়, তাঁর বিরোধিতা করার জন্য খোদ কংগ্রেস দলের মধ্যেই একাধিক লোক বসে আছে। তাই নরম হয়ে থাকলে যে বিপদ আরও বাড়বে এবং কংগ্রেসের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে তা ভালোই বুঝেছিলেন সনিয়া। সেই কারণে কংগ্রেসের নেত্রী হওয়ার প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দেননি। বরং গান্ধী পরিবারের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কংগ্রেসের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করতে এবার শক্ত হলেন সনিয়া। ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তিনি কর্নাটকের বেলারি ও উত্তর প্রদেশের আমেথি থেকে ভোটে দাঁড়ান। দুটো আসনেই জয়ী হয়েছিলেন সনিয়া। কিন্তু, আমেথি-র প্রতিনিধিত্বকেই তিনি বেছে নেন। কারণ এই আমেথি ছিল স্বামী রাজীবের লোকসভা কেন্দ্র।
১৯৯৯ সালে বিরোধী দলনেত্রী
১৯৯৯ সালে লোকসভায় বিরোধী নেত্রী হন সনিয়া গান্ধী। রাজনীতিতে কার্যত তখনও নবাগত সনিয়া গান্ধী। বিরোধী দলের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি কতটা অভিজ্ঞ? এই নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। কিন্তু, সকলকে অবাক করে দিয়ে বিরোধী দল হিসাবে সংসদের কংগ্রেসের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল .করে তোলেন সনিয়া। কী ভাবে সংসদ অধিবেশনে এনডিএ-কে আক্রমণ করা হবে? কোন কোন বিষয়ে কী ভাবে অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকাররের পদক্ষেপকে আক্রমণ করতে হবে? তার প্রতিটি রূপরেখা নিজে বসে ঠিক করে দিতেন সনিয়া।
২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচন
কংগ্রেসের শীর্ষনেতাদের দেখিয়ে দিলেন সনিয়া কী ভাবে রাজনীতির অঙ্কটা পাল্টাতে হয়। কারণ, সে সময় অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে এনডিএ সরকার দেশজুড়ে বিশাল উন্নয়নেক যজ্ঞ শুরু করেছিল। সোনালী চর্তুভূজ সড়ক প্রকল্প থেকে পরিকাঠামো উন্নয়নে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছিল বাজপেয়ী সরকার। এমনকী, বাজপেয়ী সরকারের উন্নয়নকে তুলে ধরতে বিজেপি ২০০৪ সালে 'ভারত উদয় যাত্রা'-ও শুরু করেছিল। কিন্তু, বাজপেয়ীর উন্নয়ন পদক্ষেপকে চ্যালেঞ্জ করে দেশের আমজনতার দুঃখ-কষ্ঠকে নির্বাচনি ইস্তেহারে স্থান দিয়েছিলেন সনিয়া। দেশবাসীকে বুঝিয়েছিলেন উন্নয়ন যেমন দরকার তেমনি ভারতের গরিব দেশবাসীর জন্য প্রথম দরকার খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-এর সুনিশ্চিত বন্দোবস্ত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদেরও কার্যত অবাক করে দিয়ে কংগ্রেসের পালে ভোটের হাওয়াকে টেনে নিয়েছিলেন সনিয়া।
হয়ে উঠলেন ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য
সুযোগ ছিল। কিন্তু হাজারো কথাতেও কান দেননি সনিয়া। বিদেশিনী থেকে তখন সত্যি তিনি হয়ে উঠেছেন কংগ্রেসের নেত্রী সনিয়া গান্ধী। প্রধানমন্ত্রীত্ব পদে তাঁর পা গলানো হয়তো গান্ধী পরিবারের পক্ষে হয়ে উঠতে পারে বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত। কারণ, ছেলে রাহুল তখনও রাজনীতির জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠেননি। মেয়ে প্রিয়ঙ্কা সঙ্গে থাকলেও রাজনীতিতে পাকাপাকিভাবে নাম লেখানোর ইচ্ছে কতটা তা নিয়ে সন্দেহ ছিল সনিয়ার। তাই, নিজেকে ও পরিবারকে রাজনীতির আঙিনায় আরও পরিপক্ক করে তুলতে সময় নিচ্ছিলেন সনিয়া।
২০০৪ সালের মাস্টারস্ট্রোক
সনিয়া গান্ধী ছাড়া সে সময় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে ছিলেন কংগ্রেসেরই প্রণব মুখোপাধ্যায়। কিন্তু, না নিজে না প্রণব- কারোর নামই প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য নিয়ে আসেননি সনিয়া। বরং, সেই জায়গায় তিনি নিয়ে এলেন মনমোহন সিংকে। গান্ধী পরিবারের প্রতি আন্তরিক এবং নিপাট ভদ্র ও শিক্ষিত মানুষ মনমোহনকে নিয়ন্ত্রণ করাটা তাঁর পক্ষে অনেকটাই সহজ ছিল। কারণ, মনমোহনকে সামনে রেখে তিনি কংগ্রেসের মধ্যে তখন তুষের মতো ধিকিধিকি করে জ্বলতে থাকা বিদ্রোহের আগুনটাকে নির্মূল করতে চেয়েছিলেন।
২০০৬-এ ইউপিএ চেয়ারপার্সন
২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী কেন হলেন না সনিয়া? এই নিয়ে সে সময় প্রশ্নের অন্ত ছিল না। সকলে উত্তরটা পেয়েছিল ২০০৬ সালে। কারণ, সেই বছর ইউপিএ-র চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হয়েছিলেন সনিয়া গান্ধী। এমনিতেই কংগ্রেসের উপর গান্ধী পরিবারের প্রভাব নিয়ে ঘরে-বাইরে বিতর্কের অন্ত ছিল না। তিনি প্রধানমন্ত্রী হলে এই বিতর্ক আরও বাড়ত বই কমত না- তা ভালোই বুঝেছিলেন সনিয়া। এর সঙ্গে জুড়ে যেত বিদেশিনী বিতর্ক। তাই নতুন কোনও বিতর্ক নয়, বরং কংগ্রেসের সর্বেসর্বা হয়ে গান্ধী পরিবারের পরের প্রজন্মের জন্যে রাজনীতির পথকে প্রশস্ত করাটাই সেরা সিদ্ধান্ত বলে মনে করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ তথা রাজীব গান্ধীর স্ত্রী।
সনিয়ার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা
সে সময় বারবারই ঘুরে ফিরে আসত একটাই প্রসঙ্গ যে সনিয়া এতখানি রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিতা কোথায় থেকে পেলেন? আসলে গান্ধী পরিবারে বউ হয়ে আসার পরই সনিয়ার জন্য দিল্লির রাজনীতির অলিন্দে চলা-ফেরা করার শিক্ষার বন্দোবস্তটা করেছিলেন খোদ ইন্দিরা গান্ধী। সে সময় ইন্দিরার সারাক্ষণের সহচর অম্বিকা সোনির কাজই ছিল সনিয়াকে গান্ধী পরিবারের ঐতিহ্য এবং চলন-বলনের সঙ্গে মানানসই করে তোলা। এদিকে, সে সময় সঞ্জয় গান্ধীর স্ত্রী মানেকার একের পর এক বিস্ফোরক বিবৃতিতে তিতিবিরক্ত গান্ধী পরিবার। সনিয়া সে সময় খুব কাছ থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে দেখেছিলেন। দেখতেন কীভাবে শাশুড়ি যাবতীয় বিতর্কের মোকাবিলা করতেন। কী ভাবে রাজনীতির আঙিনায় চলছেন তাও প্রত্যক্ষ করতেন সনিয়া। অবসরে ইন্দিরার কাছে শুনতেন রাজনীতির নানা গল্প। আর এভাবেই নিজেকে গান্ধী পরিবারের বড় বউ হিসাবে পরিণত করেছিলেন সনিয়া। ইন্দিরার শেখানো সেই রাজনীতির শিক্ষা আকরের মতো লালন-পালন করেছিলেন তিনি। কিন্তু, সংকটে পড়তেই এককালে শেখা সেই রাজনৈতিত শিক্ষাই সনিয়ার রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
অবসরের সিদ্ধান্ত
শরীরটা যে আর দিচ্ছে না তা ভালোই টের পাচ্ছিলেন তিনি। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার বড় সময় ধরে তাঁকে হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল। রাহুলকে কংগ্রেসের সর্বোচ্চ তখতে নিয়ে আসার এটাই উপযুক্ত সময় তা টের পেয়েছিলেন তিনি। কারণ, কংগ্রেসে এখন রাহুল-এর বয়সী নেতাদেরই বেশি আধিপত্য। এর সঙ্গে আছেন চিদম্বরম, আনন্দ শর্মা, আহমেদ প্যাটেল, কপিল সিব্বল, গুলাম নবী আজাদদের মতো অভিজ্ঞ নেতারা। যাঁদের গান্ধী পরিবারের প্রতি আনুগত্য প্রশ্নাতিত। সুতরাং, বানপ্রস্থে যাওয়ার এর থেকে সেরা সময় আর কি হতে পারে। তাই এবার রাহুলের হাতে রাজ্য সঁপে সনিয়া ঢুকে পড়লেন অখণ্ড অবসরের জীবনে। তাঁররিটায়ার্ড লাইফ উপভোগ করতে।