সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদের পাশে, সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানো সহজ নয়
যতই ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করুন, সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোর চেষ্টা করুন, এ রাজ্যে ভিত গড়া সহজ হবে না।
কলকাতা, ১৩ এপ্রিল : যতই ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি করুন, সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানোর চেষ্টা করুন, এ রাজ্যে ভিত গড়া সহজ হবে না। রামনবমী পালনের নামে হাতে অস্ত্র নিয়ে তাণ্ডব হোক বা যতই হুঙ্কার ছাড়ুন, কিংবা শিশুদের হাতে অস্ত্র তুলে দিন, এ রাজ্যে গো বলয়ের রাজনীতির নগ্ন প্রকাশ প্রায় অসম্ভব।
সত্যি কথা বলতে কি এসব ভালো চোখে দেখছে না রাজ্যের মানুষ। রাজ্যের হিন্দু সমাজ খাড়াখাড়ি দ্বিধাবিভক্ত না হলেও, একাংশ যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় আসার জন্য, এমন ভাবনায় প্রভাবিত হচ্ছেন। এগুলো তারই বহিঃপ্রকাশ। তবে তা বাংলার সংস্কৃতিতে দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
কয়েকদিন আগের রামনবমী মিছিলগুলো বাংলায় ধর্মীয় মেরুকরণের করুণ বার্তা বহন করেছে। তবু এর মধ্যে স্বস্তির কথা, হিন্দু সমাজের একটা বড় অংশ এসব পছন্দ করছে না। বুঝে বা না বুঝে সংঘের সর্বনাশা ফাঁদে কেউ কেউ পা দিলেও তাঁদের মধ্যে সংশয় রয়েছে এই হিংসাশ্রয়ী নীতিকে ঘিরে। সে কথা তারা স্পষ্ট করে বলতে দ্বিধা করছে না।
পশ্চিমবঙ্গ দীর্ঘ দশক ধরে সম্প্রীতির পীঠস্থান। কখনই গো বলয়ের রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয় রাঢ় বাংলা। একইভাবে মুসলিম ধর্মান্ধতাকেও প্রশয় দেয়নি কখনও। যারা নিজেদেরকে গো মাতার সন্তান মনে করেছে, তারা পাশ কাটিয়ে থেকেছে। যারা তা মনে করে না, তারা সম্প্রীতি, সংহতি, সহিষ্ণুতা আশ্রয় করে মিলেমিশে বাস করেছে।
একই বৃন্তে দু'টি কুসুমের মতো সেই মিলেমিশে থাকাকে ধাক্কা দিয়েছে সাম্প্রতিক রামনবমীর উন্মত্ত মিছিল। হিন্দু সমাজ থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, রাম কি বিজেপির একার? প্রশ্ন উঠেছে, বিজাতীয় সংস্কৃতি কেন এ রাজ্যে? কেন অস্ত্র নিয়ে মিছিল? এসব বন্ধ হোক। গরু নিয়ে রাজনীতিরও তারা পক্ষপাতী নয়। যার যা খাবার তারা খাক, যারা দেবতা মানতে চায়, তারা মানুক।
৩৪ বছরের বাম শাসনে সংখ্যালঘুরা কিছু কিছু দিকে বঞ্চিত হয়েছিল ঠিকই তবে একটা বিষয়ে নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল মানুষের যে, সাম্প্রদায়িক শক্তি কখনই মাথা চাড়া দেবে না। মানুষ দেখেছে কোথাও সম্প্রীতির আবহ নষ্ট হলে বামেরা সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়েও পড়েছে। পুলিশ প্রশাসনও কঠোর হাতে মোকাবিলা করেছে। ফলে তাদের বুকে ভরসা জুগিয়েছিল যে, কোথাও সম্প্রীতি ক্ষুণ্ণ হবে না। বিজেপি সহ সংঘ পরিবারও জানত, বাম শাসনে তারা সাম্প্রদায়িক শুড়শুড়ি দিতে পারবে না। তাই এগোয়নি।
বিজেপি সম্পর্কে বর্তমান তৃণমূল সরকারে দোলাচল অবস্থাই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে এ রাজ্যে সাম্প্রদায়িক তাস ছড়ানোর। নির্বাচন এলে বা কোনও কেলেঙ্কেরিতে ফেঁসে গেলে, তখনই দলনেত্রী-সহ তৃণমূল নেতৃত্ব বিজেপির বিরুদ্ধে ফোঁস করে। বাকি সময়টা এমন এক অবস্থান নেয়, রাজ্যবাসী বুঝতে পারে না, তৃণমূল বিজেপির শত্রু না বন্ধু। দিল্লি গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক সময় বার করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করবেনই। রাজ্যের দাবি আদায়ের বৈঠক হলে তা প্রকাশ্যেই করা যায়।
বিশেষ করে সারদা কেলেঙ্কারি, রোজভ্যালিকাণ্ড, নারদ কেলেঙ্কারি, নোট বাতিল ইস্যুতে তৃণমূলনেত্রী কিছুদিন প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপির মুণ্ডুপাত করেছেন। তারপর ঠিক সময় করে দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেছেন। যার জন্য রাজ্যের বড় একটা অংশের মানুষ সেই বৈঠককে দিদি-মোদি সমঝোতা বৈঠক বলে কটাক্ষ করতেও ছাড়ছে না।
এ রাজ্যের মানুষ রাম, গরু, মন্দির, গীতা, লাভ জেহাদ, ধর্মান্তকরণ, ঘরওয়াপসি- ইত্যাদি বিষয়কে গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে চায় বেকারি, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধ, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সম্প্রীতি ইত্যাদিকে। তাই বিজেপি এত সহজে এ রাজ্যে এগোতে পারবে না। মানুষ বিজেপি-র দিকে পা বাড়াচ্ছে প্লাটফর্ম না পেয়ে। তাও ক্ষণিকের জন্যই। দু-একটা নির্বাচনের পরেই মোহভঙ্গ হচ্ছে।
দীর্ঘদিনের বাম শাসন, তাদের প্রচার মানুষকে আসম্প্রদায়িক করে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। মার্কসীয় সাম্যবাদ ওই সব নষ্ট ভেদবুদ্ধিকে আসর জমাতে দেয়নি। মানুষ সাম্যবাদের সুফল ভোগ করেছেন এতদিন। এবার সুযোগ বুঝে বিজেপি এ রাজ্যে রামচন্দ্রকে রাজনীতিতে নামিয়ে দিয়েছে। যে রামচন্দ্র অকাল বোধন করেছিলেন দুষ্টের দমন করার জন্য, সেই রামকে বিজেপি দাঙ্গাকারীদের দেবতা হিসাবে এ রাজ্যে প্রতিষ্ঠা দিতে চাইছে।
শাসকদলের নিরন্তর প্রচারে ও সরকারি কঠোর পদক্ষেপ পারে সেই বজ্জাতি রুখতে। কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে যাচ্ছে তৃণমূলের বিরোধিতার। সেই সুযোগটা নিচ্ছে বিজেপি ও সংঘ পরিবার। শাসকদল বামশক্তিকে কোমরভাঙা করে দ্বিতীয় স্থানে পরোক্ষভাবে আসতে সহায়তা করছে বিজেপিকে। বিজেপি সেই সুযোগে প্রথম স্থান দখলের পথ তৈরির চেষ্টা করছে।
এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের হিন্দু সমাজের বড় একটা অংশ রামে প্রভাবিত হতে ইচ্ছুক নয়। তারা সম্প্রীতির পক্ষে, সৌহার্দ্যের পক্ষে, শন্তির পক্ষে। তারা সংখ্যালঘুদের পাশেও। ইতিমধ্যে হিন্দু সমাজের পক্ষ থেকে নানাভাবে সমালোচনা, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। তারা ভোট মেরুকরণের নোংরা খেলায় যোগ দিতে ইচ্ছুক নয়।