কাকে নিয়ে গেল কান! দেখব পরে, আগে দৌড় লাগান দেখি
মহোদয়গণ, ভালো করে এঁটে নিন প্যান্টুলুন। চলুন ছুটি কাকের পিছনে। কাকে যে কান নিয়ে গেল!
উঁহু, দেখতে হবে না কানে হাত দিয়ে। ছুটলেই হল। যুগের হাওয়া বৈকি!
প্রসঙ্গ প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের পড়ুয়া সুমন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অকালপ্রয়াণ। অথচ দিনভর কী-ই না দেখা গেল টিভি চ্যানেলগুলিতে। আমরা কেউ কপাল চাপড়ালুম, কেউ হায়-হায় করলুম! সেই সংখ্যা মুষ্টিমেয়। যাঁরা টিভিবাবুদের গিলে নিষিদ্ধ কিছু গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করে শিহরিত হলেন আর মুখরোচক চর্চা চালালেন, তাঁদের সংখ্যাই বেশি।
খবরে প্রকাশ, সুমন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায় জলপাইগুড়ি থেকে পড়তে এসেছিলেন কলকাতায়। থাকতেন মুচিপাড়ার একটি মেসে। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সে এমএসসি পড়ছিলেন। বড়দিনের ছুটি কাটিয়ে গত শনিবার ফিরেছিলেন বাড়ি। শরীর খারাপ ছিল। শনিবার তিনি ও তাঁর রুমমেট সুবর্ণা লামা বাইরে থেকে চাউমিন খান। রাতে মেসের খাবার। শরীর খারাপের কারণে ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ খেয়ে শুয়েছিলেন। যে ঘরে তাঁরা থাকতেন, সেখানে কোনও ভেন্টিলেশন ছিল না। মশার উৎপাত থাকায় কয়েল জ্বেলে ঘুমোতে যান সুমন্তিকা ও সুবর্ণা। রবিবার সকালে সুমন্তিকাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সুবর্ণা গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি।
এটা হল ঘটনা। এ বার আষাঢ়ে গপ্পো শুনুন। দুই ছাত্রীই নিয়মিত মাদক নিতেন। অতিরিক্ত মাদক সেবনে একজন মারা যান, অন্যজন অসুস্থ। শুরু হল হইচই।
মাদকের গল্প এই প্রতিবেদক বানাচ্ছে না। বানাল সর্বক্ষণ এগিয়ে থাকে এবং এগিয়ে রাখে, এমন একটি সংবাদমাধ্যম। কেন বললাম যে, এটি আষাঢ়ে গপ্পো। কারণ হল, যখন মাদকের গল্প বাজারে ছাড়া হল, তখনও সুমন্তিকার শবের ময়নাতদন্ত হয়নি। তা হলে, কীভাবে এই উপসংহারে আসা গেল যে, মাদকের কারণে মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে? ঘটনা বিশ্লেষণ করলে অনেকগুলি সম্ভাবনা উঠে আসছে। প্রথমত, বাইরে থেকে যে চাউমিন খেয়েছিলেন সুমন্তিকা, সেখানে বিষক্রিয়া বা ফুড পয়েজনিং হয়ে থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত, মেসের খাবার হয়তো কোনও কারণে তাঁর সহ্য হয়নি। হয়তো সেখানে বিষক্রিয়া হয়ে থাকতে পারে। তৃতীয়ত, যে ঘরে ওই দুই মেধাবী পড়ুয়া থাকতেন, সেখানে কোনও ভেন্টিলেশন ছিল না। ফলে, মশা তাড়ানোর কয়েলের বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম আটকে সুমন্তিকা মারা যেতে পারেন।
টিআরপি তো একদিনের ব্যাপার, কলঙ্কের দাগ দীর্ঘদিনের
মাদকের তত্ত্ব হাওয়ায় ভাসিয়ে এক শ্রেণীর সংবাদমাধ্যম হয়তো টিআরপি বাড়িয়ে নিল গতকাল, কিন্তু তাতে সামাজিক দায়িত্ব পালিত হল কি? ভাবুন, মেয়েটির বাড়ির লোকজনের অবস্থা। একে প্রিয় সন্তান মারা গিয়েছে, তার ওপর টিভির দৌলতে লোকজন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। কেউ জিজ্ঞেস করছে, তোমাদের মেয়ে নাকি ড্রাগ নিত? যারা অতটা ঠোঁটকাটা নয়, তাদের দৃষ্টিও পড়ে ফেলা যাচ্ছে। অপরিচিত তো বটেই, পরিচিতদের চোখেও সন্দেহের দৃষ্টি তখন ঘোরাফেরা করছে।
অথচ পরে ময়নাতদন্তের রিপোর্টে জানা গেল, মাদকের কারণে মারা যাননি সুমন্তিকা। তিনি নিয়মিত মাদক নিতেন, এমন কথাও বলতে নারাজ পুলিশ। রবিবার যে টিভিবাবুরা ছেড়েছিলেন মাদকের তত্ত্ব, তাঁরাই ঢোঁক গিলে সোমবার বলছেন, মাদক মৃত্যুর কারণ নয়। ফরেন্সিক ও ভিসেরা পরীক্ষার পর সম্ভবত আসল কারণটি জানা যাবে।
মাদক বা সেক্স নিয়ে যদি রং চড়িয়ে কিছু দেখানো হয়, তা হলে পাবলিক হামলে পড়ে খায়, এই ধারণা রয়েছে এক শ্রেণীর সংবাদমাধ্যমের। তাই মিডিয়ার গঠনমূলক ভূমিকার কথা তারা ভুলে যায়। গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যমকে বলা হয় চতুর্থ স্তম্ভ। যদি স্তম্ভে ঘুণ ধরে, তা হলে কাঠামোটা হেলে পড়তে বাধ্য।
এগিয়ে থাকা টিভিবাবুদের কাছে অনুরোধ, আপনারা একবার ভেবে দেখুন মেয়েটির বাড়ির কথা। যে কলঙ্ক আপনারা লেপে দিলেন, তা কি এত সহজে মুছবে? টিআরপি তো একদিনের ব্যাপার, কলঙ্কের দাগ দীর্ঘদিনের। খবর প্রচারের আগে উচিত তা যথাযথভাবে যাচাই করে নেওয়া। যদি সদিচ্ছা থাকে, তবে এটা সহজে সম্ভব। নইলে রোজ কাকে কান নিয়ে পালাবে আর ছুটতে হবে রুদ্ধশ্বাসে।
হে মহোদয়গণ, আপনাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক!